কথিকা -য় ডরোথী দাশ বিশ্বাস

শ্রাবণীবেলায়
শ্রাবণীবেলায় শেষ রশ্মির ছোঁয়ায় কেমন এক বিষন্নতা যেন ছড়িয়ে পড়েছে… হয়তো সে মনের ভুল… সজল মেঘের ছায়ায় ছায়ায় শিউলি, শালুকও এখনি শরতের প্রফুল্লতাকে সঙ্গী করে ফুটে উঠতে চাইছে যেন, আর দিন পনেরো পরেই শরতের অরুণ আলোকে উদ্ভাসিত হবে নদীর চরের কাশফুল তার হাসি নিয়ে। কোন্ মায়াবলে জানি বাতাসের আর্দ্রতাও হারিয়ে যাবে। হেমন্তিকা দীপ জ্বালবে সন্ধ্যাবেলায়… শিশিরের টুপ্ টাপ্ রাতভোর… এই তো ঋতুচক্র… আহ্নিক গতি… বার্ষিক গতি… ক্রমে কালের গর্ভে বিলীন হবে বর্তমানের এই সময়। উৎসবের মাস শ্রাবণ, বড় পুণ্যমাস। বহু পূণ্যার্থী শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবার তিস্তা নদী সংলগ্ন মন্দিরে দেবতার পূজো দিয়ে থাকেন… এরপর পূন্যার্থীরা জলপূর্ণ ঘট বাঁকে করে পায়ে হেঁটে জল্পেশ মন্দির পর্যন্ত গিয়ে সেখানে বাবা জল্পেশ্বরের পূজো দেন… পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রচুর ভক্তগণের সমাবেশ ঘটে এই শ্রাবণী মেলায়। বহু পুণ্যার্থী নিজেরাই পুজোর উপাচার বাড়ি থেকে নিয়ে আসেন, তিস্তায় নেমে স্নান করে পুজো দিয়ে চলে যান। প্রতিবছর শ্রাবণী মেলা উপলক্ষ্যে ভাল ব্যাবসাও হয় তিস্তা ঘাটে। প্রায় চারশোর মত দোকান বসে তিস্তাসেতুর কাছে ও নদীর পারে। ঘট, শিবের মাথায় জল ঢালার যাবতীয় উপকরণ, পোশাক, মাথায় বাঁধার ফেট্টি, রুদ্রাক্ষের মালা, জলের ঘড়া নেবার সুসজ্জিত বাঁক বিক্রি হয় ছোট বড় স্টলগুলিতে। অতিমারীর প্রথম বছরে মেলায় তেমন ভক্তসমাগম হয়নি, দ্বিতীয় বছরে মেলার অনুমতিও মেলেনি কোথাও কোথাও। সে সময়ে রাতভর বাঁক কাঁধে পদব্রজে চলা ভক্তদের মুখে “বোল্ ব্যোম্” – ধ্বনির বদলে শুধু অ্যাম্বুলেন্সের হুটারের শব্দ শোনা যেত, ঋতুভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পড়ে গিয়েছিল মাথায় হাত। শিবস্থানের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে দূর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলেও। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকেও পুরোহিত এসে পৌরোহিত্য করেন শুনেছি। তারাপীঠ থেকেও সাধুসন্তরা আসেন। এ দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব… প্রবাহমানা তিস্তা… কি করে ভুলে থাকি তোমাকে? তুমি যে জীবন জুড়ে আছো… তোমার আকাশে ভাসমান কিছু আশ্বাসের মেঘ… তোমার সজীব প্রতিকৃতি ক্ষণিকের তরে শীতল অনুভূতি আনে, যদিও তোমাকে ঘিরে আছে রৌদ্রের খরতাপ… এমনই এক শ্রাবনী মেলার দিনে তোমার কাছে কিছুক্ষণের অবকাশযাপন, দেখি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত একজন দু’ জন পূণ্যার্থী তোমার জলে নিজের ছায়া দেখে চলেছে- আর আমি খুঁজে চলেছি সেই ঘূর্ণাবর্ত, যেখানে রহস্যেরা ঘন হয়… কে আমি? এই এক জিজ্ঞাসা অনন্তকাল ধরে কশাঘাত করে যাবে, উত্তর মেলা ভার। কোন্ পথে চলেছি— যে পথ আলোয় পরিপূর্ণ, বাধাহীন, শৈশবের স্বতঃস্ফূর্ততায় গাঁথা— যৌবনের ভরা বৈভব ছড়ানো, পূর্ণতার খোঁজ চলে নিত্য, এ যে যখের ধন, মেলে না— মেলে না, অসম্ভব এর দেখা পাওয়া। ঐ যাঁরা বাঁক কাঁধে প্রায় নীরবে চলেছে, খুব কাছে এলে গুনগুন ‘বোল ব্যোম্’ ছান্দিক গুঞ্জন, তারা দূরে গেলে ছায়াও মিলায়, পড়ে থাকে কায়াহীন মায়া। এ মুহূর্তে তাঁরা সাফল্য অসাফল্যের ঊর্ধে। এক সারি, এক রঙ, এক মনন। অনেকটাই যান্ত্রিক। শুধু উস্কোখুস্খ চুলে উদ্ভ্রান্তির চিহ্ন। এ পথে প্রিয় পরিজন, শত্রুমিত্র, জ্ঞাতঅজ্ঞাত— সব একসারিতে। পথ ঘর মিলেমিশে একাকার।