মার্গে অনন্য সম্মান ধৃতিমান দত্ত (সেরার সেরা)

অনন্য সৃষ্টি সাহিত্য পরিবার

সাপ্তাহিক প্রতিযোগিতা পর্ব – ৭১
বিষয় – সেই চোখ

অব্যক্ত

সেই অন্ধকার গলির বস্তিটা পেরোলেই তোমার ঘর।
রঙচটা টালির ছাদে অ্যান্টেনা মাথা নাড়তো…..
তোমার কৈশোরকাল কতবার আমাকে
হাতছানি দিয়েছে- চিনিয়েছে শহরতলি নগরজীবন,
তোমার দারিদ্র্যের অহঙ্কার ছিল তোমার অলঙ্কার।
তবু কতবার হেঁটেছি তোমার ভিনশক্তির রাজ্যে-
ঐ পথ হয়েছিলো ভীষণ প্রিয়;
কিন্তু তোমাকে কোনোদিনও বলতে পারিনি।

তবুও স্কুলের পোষাকে এক আনমনা কিশোর
ভোরের শিশিরসিক্ত ঘাস মাড়িয়ে গোপনে
ওই ঘরের সামনে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াতো,
মাটির দাওয়াতে বাসনগুলো তখন তুমি
আধো ঘুমচোখে ধুতে ব্যস্ত;
সৌন্দর্য আর গাম্ভীর্যের মিশেলে তুমি অনন্যা…..
মনে হতো- তুমি কিছু বলতে না কেন?
কিন্তু এ প্রশ্ন তোমাকে কোনোদিনও করতে পারিনি।

মেঘলাদিনের বৃষ্টি তোমাকে ভেজাতো আনমনা……
ফর্সা মুখমণ্ডলে জলবিন্দু দাঁড়িয়ে থাকতো দুই গণ্ডদেশ ভরে।
তোমার উন্মুক্ত কেশরাশি থাকতো পৃষ্ঠদেশে এলায়িত;
আমি বুঝতাম না সিক্ত হওয়ায় কত আনন্দ।
আমি দেখতে চাইতাম তোমাকে প্রাণপণে
কিন্তু তোমার অদ্ভুত দৃষ্টি আমাকে তাকাতে দেয়নি।
সে দৃষ্টি মনে হতো সঙ্গী খোঁজার, কখনও বা একলা থাকার;
কিন্তু তোমার সেই চোখের ঐ ভাষা বুঝিনি আজও- তুমি কি চাও?

তোমার মেয়েবেলা চুরি হয়ে গেলো একদিন
অপ্রত্যাশিত বিকেলের কালবৈশাখী ঝড়ের মতন।
বুকের খাঁচায় যত লুকোনো কবিতা একদিন
প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চাইলো।
অন্ধগলির অন্ধকারে একদল হায়নারা প্রতীক্ষায়
তোমার ক্ষতবিক্ষত মুখে সেই জিজ্ঞাসু চাহনি…..
বলতে কি চেয়েছিলো আমাকে- “তুমি এত কাপুরুষ?
ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচাতে পারলে না আমাকে?”
হয়তো বাঁচাতে পারতাম যদি তোমার চোখের ভাষা বুঝতাম।
ভাষা বুঝতে চাইবো সে সাহস ছিলো না আমার;
তাই সেদিনও কিছু বলতে পারিনি তোমাকে।

আজ তুমি আছো এক চিরকালীন অন্ধগলিতে;
যেখানে পিছন ফিরে তাকানো যায় না…..
শুধু নদীর মতই সামনে গা ভাসিয়ে দেওয়া যায়।
পতিত উপাখ্যান লেখা হয়ে থাকে শরীরে শরীরে, দেওয়ালে।
অন্ধগলির বাইরে দাঁড়িয়ে তোমার দৃষ্টি আজ ভিন্ন;
তোমার এই দৃষ্টির ভাষা আমি বুঝি।
মনে মনে ভেবেছিলাম- আজ তোমাকে কিছু বলবোই,
হেঁটে হেঁটে সোজা চলে আসবো, তোমার সামনে দাঁড়াবো…..
হয়তো তুমি টেনে নিয়ে যাবে সোজা তোমার ঘরে
তোমার একান্ত বিছানায় সঙ্গোপনে…..
যেখানে মুঠো মুঠো কড়ি খেলা করে রোজ সন্ধ্যায়…..
তবু আমি যাবো তোমার সঙ্গে, তোমাকে বলবো সব।
কিন্তু কি আশ্চর্য….কি অদ্ভুত তোমার ভঙ্গিমা;
চোখের দৃষ্টিতে যেন মায়াবী সম্মোহন….
এ দৃষ্টি আমার আরও অচেনা…..আরও অদেখা;
যেন বলতে চাইছে- “চলে যাও আর আমাকে ভুলে যাও।”
এ যেন আমার জন্য নয়…..তুমিও নও…..
কিন্তু কেন চাইলে? ভেবেছিলাম জানতে চাইবো।
বিশ্বাস করো….সেদিনও ফিরে এসেছিলাম;
সেদিনও সাহস করে জানতে পারিনি।

তোমার চোখের ভাষাকে আজও বুঝতে পারলাম না।
বুঝলাম- পৃথিবীর সবথেকে কঠিন ভাষা এই চোখের ভাষা।
বলতে পারো ভয়টা আমার কিসের ভয়?
আজ তোমাদের সেই বস্তিটাও নেই, সেই গলিটাও নেই;
রঙচটা টালির বাড়িটাও কবে স্মৃতিপটে ইতিহাস হয়ে গেছে।
তবু তোমার দুচোখে অনেক কিছু বলতে চাওয়ার
অনেক কিছু না বলা কথা-
আজও আমায় সম্মোহিত করে রাখে মোহমুগ্ধের মতন।
দিনে দিনে জমিয়ে রাখা শত শত ভাবাবেগ
অনুরাগ হয়ে ঝরে পড়ে- অনুভূতির শুষ্ক মাটিতে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।