T3 || আমার উমা || বিশেষ সংখ্যায় দেবযানী ভট্টাচার্য

প্রার্থনা

আজ অন্ধকার থাকতেই সুধারাণী বিছানা ছেড়েছেন,রাত কেটেছে আধ ঘুম আধো জাগরণে, তড়িঘড়ি গুরুদেবের ছবিতে প্রণাম সেরে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। কুয়োতলা জুড়ে এখনও চাপ চাপ কুয়াশা , আবছা অন্ধকারে দেখেন বাগানের শিউলি গাছটি যেন প্রাচীনা তিনিই!তারই মতো সাদা ঘোমটা মাথায় দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে,
মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে মৃদু ঢাকের বোল।
আজ উমার বোধন।

ধীর পায়ে তিনি এগিয়ে যান বারন্দায় যেন তারই প্রতীক্ষায় অপেক্ষায় বসে থাকা চেয়ারটির দিকে, আড় চোখে একবার দেখে নেন অপেক্ষমান ঘরগুলি, মৃদু তৃপ্তির হাসি ছড়িয়ে পড়ে ঠোঁটে, নাহ্! বউদের এখনও তিনি চমকে দিতে পারেন, গৃহ সজ্জায় তাঁকে টেক্কা দিতে পারবে না আজও কেউ, এটুকু গর্ব তাঁর বেঁচে থাকাকে সার্থক করে তোলে । সারি সারি বিছানা ,বালিশ, সাজিয়ে রেখেছেন পালঙ্কের ওপর, কখন কোনটা কার কাজে লাগে! ছেলে, বউ,নাতি, নাতনি কারোর যেন কোনো অসুবিধা না হয়। ভাঁড়ার ঘরেও মজুত রেখেছেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী।বছরে এই পাঁচটি দিনই তো তারা এক জায়গায় জড়ো হয় ।

ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করেছে, সে আলোয় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে কলাগাছ কাঁধে বারীন পুরোহিতের ঈষৎ কুঁজো হয়ে যাওয়া দেহ টি, বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই, এখনও একবারের জন্যও পুজোর দ্বায়িত্ব থেকে সরে যাননি, কলকাতার আকর্ষণ তাকে স্পর্শ করেনি কোনোদিন।আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা ! সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সুধারাণীর দুই চোখ, তবু একদলা কষ্ট যেন গলার কাছে অনুভব করেন, কেমন যেন ব্যথা করে ওঠে, দু গাল বেয়ে নেমে আসে অশ্রু ধারা ,আজ কতদিন প্রায় কুড়ি বছর কর্তা চলে গেছেন,শক্ত হাতে তিনি সামলে চলেছেন তাঁর ফেলে যাওয়া রাজ্য পাট।

সুধারাণী চোখ বন্ধ করে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেন, সরিয়ে ফেলতে চান এই ব্যথার অনুভব, জীবন তাঁকে অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে চলেছে, ভেঙে পড়লে চলবে না, সামনে আরো কিছু দ্বায়িত্ব, তিনি স্পষ্ট শুনতে পান ছেলে মেয়েদের ‘মা ‘- ডাক,আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক, গত বছর কেউ কেউ কলকাতার জাঁকজমক ছেড়ে আসতে চায় নি এই মফস্বলের পুজোয়, অথবা তারই টানে! এবারও যেন তা না হয়! কে জানে কোনদিন নিভে যায় জীবন দীপটি !!সমৎসরের প্রতীক্ষার যেন মধুর অবসান ঘটে, নিজের মনেই বিড় বিড় করে ওঠেন, ” দেখ আমার উমা, সন্তানের স্পর্শ সুখ থেকে যেন বঞ্চিত করো না ।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।