ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৩৬)

কু ঝিক ঝিক দিন

৩৬

আমার চা খাওয়ার শুরু মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে টেস্ট দেওয়ার পরে যে ছুটি তাতে। জানুয়ারি মাসে বাবার হার্ট অ্যাটাক। আর সেই শুনে আমার দিদা এলেন দেখভালের জন্য। শুধু তো জামাই অসুস্থ তা নয়,বাড়ির বড় নাতনি মাধ্যমিক দেবে।সে এক উৎসবই বটে।তার তদারকি করাটা দিদা মনে করত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় এক কালীপুজোর রাতে দাদু চলে গেলেন। দাদু মনে করতেন আমার দ্বারা আর যাই হোক পড়াশোনা হবে না।কারণ এত নাচুনি,পাড়াচড়ানি ও গল্পের বইয়ে যার তীব্র আসক্তি তার পড়াশোনা হওয়া দুরূহ ব্যাপার। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে দাদু তাই রীতিমত সন্দেহ পোষণ করতেন যে ভালোভাবে খাতা দেখা হয়েছিল কিনা!
বছরে দু’বার কখনো তিনবারও তারা দুজন বড় মেয়ের বাড়ি মানে আমাদের বাড়ি আসত।
আসার পর দাদু বলত,দিদার মন খারাপ করছিল তোদের জন্য।
আর দিদা হেসে বলত,তুমি তাহলে এলে কেন?ছেলেদের কাছেই থাকতে পারতে।আসলে তোদের দাদু বড় মেয়ে আর জামাইকে চোখে হারায়।
দাদু আসত হাতে একটা সুটকেস নিয়ে,আর তার পিছনে দিদার হাতে পানের সরঞ্জাম নিয়ে একটা ঝোলা আর একটা বটুয়া। ওটাতে টাকা পয়সা, চাবি এসব।
দিদা আসা মানে মায়ের কাজ থেকে খানিক বিশ্রাম আর বাবার মনে অপার শান্তি। দিদা যেন কি করে বুঝে যেত বাবার চা খেতে ইচ্ছে করছে।
বাবাও দাদুর জন্য নানা রকম খাবার আনাতো।দাদুর সুগার ছিল।অথচ মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসত।বাবাও নানা মিষ্টি আনত।মা বা দিদা হয়তো দাদুকে একটা দুটো মিষ্টি দিয়ে বাকিটা সবাইকে দিয়ে দিচ্ছে, দাদু তখন নিজের মনেই বলত-রাজার নামে মারে হাঁস,খায় গুষ্টি বারো মাস।
আমরা বুঝতে পারতাম না দাদু কি বলছে! দিদা বলত,আরে দাদুর নাম করে জামাই মিষ্টি এনেছে, আর আমি সবাইকে দিয়ে দিচ্ছি বলে তোর দাদুর রাগ।
বাবা শুনে পরদিনই আবার অন্য কোনো মিষ্টি বা কোনও ভালো রেস্তোরার খাবার নিয়ে আসত।
আমাদের তিনবোনের মধ্যে দাদু সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত ছোট বোন রম্যানিকে।বলত,দিদুভাই তোমাকে আমি বিয়ে করব।তুমি আমার কাছে থাকবে,পাকা চুল বেছে দেবে,তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।
বোন তখন দাদুর গা ঘেঁষে বসে বলত,লাল বেনারসী দেবে?ক্যাডবেরি দেবে?পুতুল দেবে?.
দাদু বলত,সব দেব।সোনার গহনা দেব,হীরের নাকছাবি দেব।
বোনের সে সব গহনার প্রতি কোনও আসক্তি ছিল না।
সে বলত,তাহলে বাপু আমাকে এখনি রসগোল্লা খাওয়ায় দেখি।
বোন ছোট বেলায় রসগোল্লা খেতে খুব ভালবাসত। আমি আর ঝুম যখন সিঙারা,চপ এসব খাচ্ছি, ও সেগুলো না ছুঁয়ে দিব্বি রসগোল্লায় মজে থাকত।
দাদুর খুব আশা ছিল এই ছোট নাতনিকে নিয়ে। বলত, এ মেয়ে বড় হয়ে জজ ব্যারিস্টার হবে।
দিদা আবার ঝুমকে খুব ভালোবাসত। দাদুর কথা শুনে বলত,আমার টুম্পাও জগত বিখ্যাত হবে।
আমি দেখতাম,তারা কেউ আমার বিখ্যাত বা কিছু হবার কথা বলছে না।ফলে একেবারেই চাপমুক্ত হয়ে নিজের মত মেতে থাকতাম।
দাদু ছিল প্রচন্ড রাগী।পড়া না পারলে মার দিত।আর সে মার যে সে মার নয়।হাত পাততে হবে।হাতে স্কেলের আঘাত।কখনো দরজার খিল দিয়েও মারার প্রস্তুতি, যদিও আমি এসব হওয়ার আগেই মামার বাড়ির জানলা লাগোয়া কৃষ্ণচূড়ার গাছ বেয়ে নেমে দৌড়ে সাঁওতাল পাড়া।দাদু ভুলেও সেখানে যাবে না।জাত যাবে যে!
দাদু বোনকে বিয়ে করবে শুনে আমার মাসতুতো ভাই বুম্বা ভীষণ চিন্তা পড়ল।
সাধারণত ওরা পুজোয় কিংবা গরমের ছুটিতে ভূপাল থেকে আসত,আর তখন আমরাও দল বেঁধে মামার বাড়ি।অবশ্য আমার যাবার কোনও মাস,দিন কাল ছিল না।কেউ এলেই আমি রেডি যাবার জন্য।
বুম্বা সারাদিন সেদিন ভেবে গেল রম্যানিকে যদি দাদু সত্যি বিয়ে করে তবে ওর সুন্দর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।সে বলল-এ বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।
এদিকে রম্যানি তখন দাদুকে বিয়ে করবে ভেবে নিয়েছে।
আর ভাই ওকে নানাভাবে বোঝাচ্ছে, এর ফল ভালো হবে না।দেখিস না দিদা দাদুর জন্য সব কাজ করে দেয়,হাতে হাতে সব গুছিয়ে দেয়,এত ভালো রাঁধে, কত সুন্দর দেখতে,তাও দাদু একটু ভুল হলেই বা দেরি হলেই দিদাকে বকে।আর তুই তো ছোটো।এখন ভালো ভালো কথা বলে বিয়ে করে নেবে,আর তারপর খুব খাটাবে তোকে।
বোন তখন চিন্তিত মুখে বলল,তাহলে কি করব?
তোকে নিয়ে পালাব ভূপাল।দাদু যেদিন বিয়ের ডেট ঠিক করবে সেদিন এসে চুপি চুপি তোকে নিয়ে চলে যাব। দাদু জানতেও পারবে না।
এই কথা শুনে বোনের চিন্তা মিটলেও দাদুর ঘুম বন্ধ হয়ে গেল।মা আর মাসিকে ডেকে চিৎকার করে বলল,কি সব দিন কাল এলো!নিজের মাসতুতো বোনকে নিয়ে পালাবার কথা ভাবছে দাদা।এমন দিনও আমাকে দেখতে হবে?
যতই বোঝানো হচ্ছে দাদুকে -ওরা কিছু ভেবে বলেনি,একজনের বয়স আট অন্য জনের চার,দাদু শুনলে তো!
যাহোক,এ হেন দাদুর আমার প্রতি বিশেষ আস্থা না থাকলেও,দিদা কিন্তু আস্থা রেখেছিল,তার বড় নাতনি মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন লেটার নিয়ে পাশ করবে,স্টারও পাবে।
অবশ্য দাদু সে সব দেখার আগেই আকাশের তারা হয়ে জ্বলছিল এক কোণে।
এখন দিদা একাই আসে মামাদের সঙ্গে। মামারা ফিরে যান,দিদা থাকে।আর মা সে কদিন নিশ্চিন্তে স্কুল থেকে ফিরে তার মায়ের হাতের চা খায়।
দিদা নিরামিষ খেত।দাদু চলে যাবার পর সাংঘাতিকভাবে বৈধব্য পালন করত।অধিকাংশ দিন ঘি,আতপ চালের ভাত আর পোস্ত।
ঝুম অবশ্য নানারকম নিরামিষ পদ রাঁধত দিদার জন্য। তখন ওরই বা বয়স কত!চোদ্দ বছর বয়সে তো সে মাধ্যমিকই দিল।
দাদুর যেমন সাংঘাতিক পানের নেশা,দিদার তেমনি চায়ের।ফলে বাবার খুব সুবিধা হয়েছিল।দিদা বারবার চা করত আর বাবাকে জিজ্ঞেস করত-বৈশম্পায়ন চা খাবে?
আমি তখন সদ্য জেনেছি আমার কারনেই বাবার হার্ট অ্যাটাক। অংকে টেস্টে তিন পেয়েছি জেনে বাবার এমন হল।ফলে রাত জেগে দিন জেগে অংক মুখস্থ করছি আর পড়ছি।পাশ আমাকে করতেই হবে।ডাক্তার বলেছেন,আরেকবার কিছু হলে আর বাঁচান যাবে না।আমার দুটো ছোটো বোন,মায়ের স্কুলের চাকরি তখনো পার্মানেন্ট নয়।কাজেই আমাকে যেভাবেই হোক ভালো রেজাল্ট করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে।
এই রাত জেগে পড়ার সময় যাতে ক্লান্তি না আসে তার জন্য দিদা বারবার আদা এলাচ দিয়ে চা করে দিত।আস্তে আস্তে চায়ের প্রেমে পড়ে গেলাম।দিদা চা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যাতে পড়াতে বিরক্তি না আসে চা সংক্রান্ত নানা গল্প শোনাতো।আমাদের দেশে চা কিভাবে এল,পৃথিবীতে কত রকম চা আছে,কি কি প্রথায় চা পান করা হয়,কোথায় সব চেয়ে বেশি চা হয় এসব ভূগোল বইয়ের বাইরে গিয়েও জেনে গেলাম সেই রাতগুলোয়।
ক্রমশ পরীক্ষা এগিয়ে এলো।আমার চা পান আরও বাড়লো।
এসব দিনগুলোতে মাঝে মাঝে মনে হত বাবার মতো যদি একটা সিগারেট ধরাতে পারতাম!পেন্সিলটা মুখে নিয়ে বাবার স্টাইলে ঠৌঁট বেঁকিয়ে আয়নার সামনে খানিক দাঁড়াতাম সেই রাতগুলোতে।আরেক হাতে চায়ের কাপ।নিজেকে মনে হত কোনো সিনেমার নায়িকা।অপর্ণা সেন বা মৌসুমীর মতো গজ দাঁত বের করে হেসে দেখতাম লোকে যা বলে সত্যি কিনা!আমি সত্যি তাদের মতো দেখতে কিনা!খানিক এসব উল্টো পাল্টা ভাবনার পর কিছুটা নাচ করে আবার ফিরে যেতাম পড়ার টেবিলে।ভোর বেলা মা ঘুম থেকে উঠে দেখত এক প্রবীণা সারা রাত জেগে এক নবীনাকে পড়ায় উৎসাহ যুগিয়ে এখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সূর্য স্তব করছেন,আর তার নাতনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে-ঔঁ জবা কুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং ধ্বান্তারিং সর্ব পাপঘ্নং প্রানতোহস্মি দিবাকরম্…
বাইরে পূবের আকাশ তখন সবে লাল হচ্ছে, পাখিরা রাত ঘুমের পর আলোর স্পর্শে জেগে উঠছে,সারারাত পাতারা গাছের সঙ্গে আদরে সোহাগে মেতে এখন লাজুক মুখ করে।
আর এক বছর পঞ্চাশের দিদা তার আদরের নাতনিকে বলছে,পৃথিবীতে না বলে কোনও শব্দ নেই। হ্যাঁ আছে বলেই না এসেছে।নিজেকে বল,হ্যাঁ আমি পারব,আমিই পারব,তাহলে কোনও শক্তি নেই তাকে হারাবার।একটু ঘুমিয়ে নে,সাতটা নাগাদ ডেকে দেব।
জানুয়ারি মাসের সেই শীতের দিনগুলো থেকে মার্চের ১৩ তারিখ আমার পরীক্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত দিদা প্রায় না ঘুমিয়ে নাতনি আর তার সদ্য হাসপাতাল থেকে ফেরা জামাইয়ের সেবা করে গেছে,আর তার নাতনি পণ করেছে কোনও অবস্থাতেই সে বাবাকে হারাবে না,দাদুর কথাও সত্যি হতে দেবে না।দাদু তো দেখছে তাকে ভোরের শুকতারা হয়ে,রাতের ধ্রুবতারা হয়ে।রেজাল্ট বেরোলে দেখাতে হবে তাঁকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।