।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

দুই শিবির

লেখক – সুধীর নাওরোইবম
ভাষান্তর – বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

ছোটবেলা মানেই আমাদের পরাজয়হীন খেলা। যেখানে আনন্দকে আড়াল করে নেয় হারের কোন আঁচড় । নুংশিতোম্বী এবং আমি। আমাদের সেই খেলনাপাতির দিনগুলিতে কোন লুকোছাপা ছিল না। নদীর জলে নামার সময় নিজের প্যান্ট জামা পটপট করে খুলে রেখে নুংশিতোম্বী বলত – সাঁতার শেখাবি ? এই দুরন্ত স্রোতে সাঁতার সাঁতার খেলা বড় অদ্ভুত লাগে।উপরে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। সেই আভায় নদীও কেমন চঞ্চল শিশু। খেলার সাথী মনে করে আমাদের হাতসান দিয়ে ডাকছে। শুনতে পাচ্ছিল তার উতলা গলা ?
শুনতে পেতাম। নদীর জল যেন আমাদের ডাকনাম ধরে আদর করে ডাকছে । যেন সে অপেক্ষা করে আছে কতকাল। আমি নিজের বোতামবিহীন গিঁটমারা প্যান্ট একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম শৈশবের অমলিন হাসিতে। বলতাম -‘ হাত ধর। আজ আমরা সাতরে চলে যাব ওপারে। ভয় পাবি না একদম।’ দুজনের সাঁতারে তোলপাড় হয়ে উঠত জল। সেও ছিল স্বচ্ছ । কোন ময়লা ছিল না আবর্জনা ছিল না। সবকিছু দেখা যেত সুন্দরভাবে। নুংশিতোম্বীর ফুল ফুল শরীরে ঢেউ তুলত জলের জ্যোৎস্না। তার মনের প্রতিটি কুঁড়ি ছিল উজ্জ্বল। আমি তার হাত ধরে থাকতাম অনেকক্ষণ। কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করত না। কিন্তু এই ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হত না। অল্পসময়েই তা রূপান্তরিত হয়ে যেত আড়িতে। সামান্য কিছু নিয়ে আমাদের ঝগড়া হত তুলকালাম। পরে বুঝতাম ভুল হয়ে গেছে। ওকে ছাড়া তো সবকিছুই শূন্য। আড়ি দিলেই মন গুমোট হয়ে উঠত আমার। তখন ওর চুল টেনে ধরতাম। ও কামড়ে দিত আমার হাতে। কিন্তু কেউ হারতাম না কোনদিন। রাগ করে আমাকে একলা ফেলে নুংশিতোম্বী এগিয়ে যেত অনেকদূর পথ। আমি দৌড়ে এসে ছুঁয়ে ফেলতাম ওর হাত।
যখন ফল পাড়তে যেতাম অন্যের বাগানে তার রোমাঞ্চ ছিল আলাদা। ফল খুব ভালোবাসত নুংশিতোম্বী। আমি ওর ভালোবাসার জন্যই তর তর করে উঠে যেতাম গাছ বেয়ে। একবার মালি আমাদের তাড়া করেছিল। আমরা দৌড়াছিলাম ঢালুপথ দিয়ে। আমরা দৌড়াচ্ছিলাম বনবাদাড়ের রাস্তা চিরে। নুংশিতোম্বী ভালোভাবে ছুটতে পারছিল না। ফনেক পরে থাকার জন্য ওর পায়ে পায়ে লাগছিল। ওর কষ্ট হচ্ছিল আমার সাথে তাল মেলাতে।
আমি বললাম ফনেকটা খুলে ফেল তাহলে তোর দৌড়তে সুবিধা হবে। মালি আমাদের ধরতে পারবে না।
সে আমার কথা শুনল। ফনেকটা খুলে ফেলল নিমেষে। তারপর আমরা বাতাসের চেয়েও দ্রুত গতিতে পেরিয়ে এলাম বহুদূর পথ। সে ফনেক পরে নিল।
আমি বকলাম তোর কোন বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। ফল পাড়তে কেন আসিস এরকম পোশাক পরে।
মা বকে যে।
কেন , বকে কেন ?
মেয়েদের ফনেকই পরতে হয়।
এরপর আর আমি ওকে ফল পাড়তে নিয়ে আসতাম না। একা একা আসতাম। অনেকদূরে দাঁড়িয়ে নুংশিতোম্বী অপেক্ষা করত আমার জন্য। আমার ভালো লাগত না। সব খেলা আমরা একসাথেই খেলতে চেয়েছি প্রতি মুহূর্তে। অথচ ধীরে ধীরে সে আমার খেলার সঙ্গী নয় যেন দর্শক হয়ে গেল। সে আমার উপর নির্ভর করতে শুরু করল আমি কখন ফল পেড়ে তার কাছে ফিরে আসব। আমার ভালো লাগত না। আমাদের পরাজয়হীন খেলায় সে কেন বারবার ওয়াকওভার দেবে। আমি রাগে একদিন তার চুল টেনে ধরলাম। সে আমার হাত কামড়াল না। বুঝলাম ফনেক ওর গায়ে চেপে বসেছে। মায়ের শাসন আর চারপাশের চোখগুলি অতিক্রম করে সে এখন আর আগের মতো বাঁধনহারা নয়। একটা গন্ডী তাকে ঘিরে আছে। একটা আড়াল তুলে দিয়েছে।
নদীর বালুচরে আমাদের খেলনাপাতির ঘরবাড়ি যা আমরা রোজ গড়ে তুলতাম আর রোজ ভেঙে দিতাম । এই ভাঙাগড়া নিয়েই আমাদের ছোটবেলা ।জয় আর পরাজয়ের মধ্যে যেমন কোন প্রাচীর ছিল না। ভাঙা গড়ার ভেতর কোন দেওয়াল ছিল না আমাদের। খেলার আনন্দটুকুই আমাদের জীবন। একদিন ধুলোর বাড়ি তৈরি করে ঘরে ফেরার সময় যখন তা ভাঙতে যাচ্ছি নুংশিতোম্বী আমাকে আটকালো বাড়ি ভাঙতে নেই। অনেক কষ্টে আমরা গড়েছি।
আমি বললাম তাহলে কী করব ?
রেখে দিই। আবার কাল এসে খেলব।
কাল আবার করলে ক্ষতি কী ?
এই ঘরের নাম আগামীর স্বপ্ন। থাক না বালির উপর একটা স্বপ্নবাড়ি।
অনিচ্ছা সত্বেও বললাম থাক তবে। এরকম কত ঘর আমরা গড়েছি ভেঙেছি। ছবির মতো শিল্পের মতো সেসব বাড়ি কোথায় মিলিয়ে গেছে আমরা জানি না। কিন্তু কোথাও তা আছে ঠিক আছে আগামী দিনের কেউ তা খুঁজে পাবে। সদ্য খেলা থেকে উঠে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম বাড়িটার দিকে। এই প্রথম আমার মনে হল সংশোধন করে নতুন কিছু করবার ইচ্ছেটা কি চলে গেল ? না কি আমিও তার মতো অলসতাকেই মেনে নিলাম ?
একদিন গোলাকার চাঁদ উঠেছিল আকাশে। আলোয় আলোয় ভরে যাচ্ছিল পথ ও প্রান্তর। নুংশিতোম্বী রাধা সেজেছিল। পোৎলোয় পরে তাকে অপূর্ব লাগছিল। সে যখন সবার সামনে নাচছিল মনে হচ্ছিল তার প্রতিটি মুদ্রায় ঝরে পড়ছে বাঁধ ভাঙা জ্যোৎস্না। মাথায় লৈতেং এর ভার নিয়ে সে নেচে চলেছে । আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল তাকে দেখে। গলা এবং হাত জুড়ে আঁটোসাঁটো করে বাঁধা আছে পোৎলোয়। ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি।
মাকে বললাম -মা, নুংশিতোম্বীর খুব কষ্ট হচ্ছে বলো?
মা বলল, তা কেন হবে ? নাচতে কি কারও কষ্ট হয়? আজ তো ওর আনন্দের দিন।
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না মায়ের কথাগুলো। মনে হচ্ছিল পায়ে হুল ফোটার কষ্ট নিয়েও সে যেন হাসছে। কোন কিছু গোপন করার এক নিরুচ্চার যন্ত্রণা হজম করে নুংশিতোম্বী নেচে চলেছে। তার পা যেন ক্লান্ত বিষন্ন। আমি বললাম মা ওকে বলো পোৎলোয় খুলে ফেলতে। ওর হাঁফধরা ছন্দে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।
মা বলল – বালাই ষাট। কী অলুক্ষুণে কথা । এই নাচ জন্ম জন্মান্তরের আনন্দ। এতে কি কষ্ট হয়? তাছাড়া পোৎলোয় কী সুন্দর মানিয়েছে ওকে।
তা মানাক। আমি চাই ও যেন আর কোনদিন যেন এ পোশাক না পরে।
আর একদিন ও পরবে। ওর বিয়ের দিন। তারপর আর কখনো ও পরবে না পোৎলোয়।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নাচ শেষ হলে নুংশিতোম্বীর কাছে গেলাম – তোর খুব কষ্ট হয়েছে নাচতে? পোৎলোয় পরে তুই সেই স্বচ্ছন্দে চলতে পারিস না আমি জানি। তোর সেই বাতাসের মতো দৌড় তোর সেই জোরে হেসে ওঠা তোর সেই মারকুটুনি স্বভাব সব মিলেমিশে আমাদের খেলনাপাতির দিনগুলো কত দুরন্ত হয়ে উঠত বল। সেই স্বপ্নবাড়ির চঞ্চল ভাঙাগড়ার মুহূর্তগুলি।
নুংশিতোম্বী কোন উত্তর দিল না।
আমি বললাম আমার সাথে বাজি রেখে দৌড়বি ? গাছের ফল পাড়তে যাবি দেখি কে বেশি ফল পাড়তে পারে। নদী সাঁতরে কে কতদূর যেতে পারে। আমি তোকেই জেতাতে চাই নুংশিতোম্বী।
সে রাজী হল না। মাথা নিচু করে ধীর পায়ে চলে গেল ঘরের দিকে। রাগে আমি বালির ঘরগুলো ভেঙে ফেললাম।
মা বলল, ও আর কোনদিন তোর সাথে খেলবে না। ছেলেদের সাথে কি মেয়েরা খেলে ?
একটা আড়াল আর দুটো শিবিরে ভাগ হয়ে গেল খেলাটা।
লেখক পরিচিতি
সুধীর নাওরোইবমের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মণিপুরের নামবোলে। মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মণিপুরি সাহিত্যে এম এ। পেশায় সাংবাদিক । ছবি এবং চলচিত্রের প্রতি তাঁর ঝোঁক তাঁর শিল্পভাবনাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ : য়োকচবি বাংলাদেশ ( ১৯৯০) মৈ চঙলবা চেক (১৯৯২ ) লৈই খরা পুন্সি খরা ( ১৯৯৮)।
লৈই খরা পুন্সি খরা গল্পগ্রন্থের জন্য ২০০৩ সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার পান। দুই শিবির গল্পটি এই গল্পগ্রন্থের নুংশিতোম্বী অমসুং গল্পের ছায়ায় অনূদিত।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।