ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৪৩)

কু ঝিক ঝিক দিন

একটা জীবন মানে অনেক গুলো ইট পাথর দিয়ে গাথা সময়।যে মুহূর্তে বাড়িটা ভেঙে পড়বে তুই ফক্কা। কথাগুলো বলার পর বোম ভোলে বলে চিৎকার করে উঠলেন সাধুবাবা।বিশাল তার জটা।দাড়ি নেমে এসেছে প্রায় বুক অবধি।সারা শরীরে ছাইভস্ম মাখানো। সবাই তাকে বলত গাজন বাবা।
সামনে বসে থাকা বছর দশেকের আমি খুব অবাক হয়ে বললাম,আমি তো বাড়ি বানাইনি।আর যদি আমাদের বাড়ি হয় তবে ভেঙে পড়বে কেন?মাটির বাড়ি ভেঙে যায়, পাকা বাড়ি ভাঙে না।
তিনি আবার হুংকার ছাড়লেন।বোম্ ভোলে।
এ বাড়ি সে বাড়ি নয় মূর্খ।এ হল আমাদের এই যে ২০৬ টা হার দিয়ে তৈরি শরীর বাড়ি।এ বাড়ি মাংস,মজ্জা,চর্বি, হার দিয়ে বানানো।যেমন বাড়ি বানাতে ইট সিমেন্ট বালি লাগে। বাড়িকে যেমন নিয়মিত যত্ন করতে হয় তেমনি শরীর বাড়িকেও যত্ন নিতে হয়।
আমি গাজন বাবার কথা কিছু বুঝলাম,কিছু বুঝলাম না।চুপ করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
বিকেলের পড়ন্ত রোদ নদীর বুকে।আকাশ আর নদীতে লালাভ আভা মাখামাখি। এই সময়টা আমি রোজ নদী পাড়ে এসে বসি।কলকাতার বাড়ি থেকে গঙ্গা খানিক দূরে।আর এখানে একেবারে বাড়ির থেকে দু পা এগোলেই।
গাজন বাবা বললেন,তুই নিয়মিত ধ্যান করিস?
হ্যাঁ। বাবা বলে ধ্যান করলে মনের শক্তি বাড়ে।
ঠিক। একেবারে ঠিক। তোর জন্য ধ্যান আর ঈশ্বর সাধনা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই।
সেদিন সন্ধ্যা কাটল তাঁর সঙ্গে।
তোমার বাড়ি কোথায়?জানতে চাইলাম।
আমার কোনও নির্দিষ্ট বাড়ি নেই। ঈশ্বর সারা বিশ্ব জুড়ে আমার জন্য ঘর বানিয়েছেন। যেকোনও একটা জায়গায় থেকে গেলেই হল।
কথাটা ব’লে তিনি একবার তাঁর দীর্ঘ সাদা দাড়িতে হাত বোলালেন।
আমার খুব ইচ্ছে করছিল নিজের হাতটাও ওই দাড়িতে রাখতে।কিন্তু সেটা ভালো দেখায় না বলে পরবর্তী শব্দে চলে গেলাম।
তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
পূর্বজন্মে অনেকেই ছিল,এ জন্মেও সবাই আছে।
পূর্বজন্ম কথাটা শুনে দারুণ রোমাঞ্চ খুঁজে পেলাম।এই সেই পূর্বজীবনের কথা যা সোনার কেল্লার মুকুল বলেছিল,যার জন্য ফেলুদা আসরে নেমেছিল।সেই সময় স্কুলে এই ছবিটা দেখানো হয়েছিল।
সাদা পর্দায় এক পাল উট চলেছে।তার ওপরে ফেলুদা,তপসে,জটায়ু।তারা চলছে মুকুলকে দুষ্টু লোকেদের হাত থেকে উদ্ধার করতে।
কতদিন মনে মনে ভেবেছি, আমাকেও যদি কোনও খারাপ লোক চুরি করে নিয়ে যায়,(মা কাকিমারা অহরহ এ কথাই বলতেন- একা একা এত রাস্তায় বেরলে ঠিক ছেলেধরা ঝুলিতে ভরে নিয়ে চলে যাবে,হাত পা ভেঙে দিয়ে ভিক্ষা করাবে)
তবে ফেলুদাকে ডাকবে বাবা। কিন্তু কোথা থেকে উদ্ধার করবে আমাকে?
হাত পা ভেঙে দিলে তো হাঁটতে, লিখতে, খেতে পারব না।অবশ্য পুরো আস্থা ছিল ফেলুদর ওপর।ঠিক ভাঙার আগের মুহূর্তে দুষ্টু লোকেদের কবল থেকে আমাকে ছোঁ মেরে তুলে আনবে। কিন্তু আমার পূর্বজন্ম বলতে তেমন কোনও ঘটনা তো নেই। সেই ছোট বেলায় বেলে ঘাটার কোন একটা বড় বাড়িতে বাসন মাজা,ঘর মোছার কথা বলেছিলাম।বাবা এ কথা শোনার পর আর আমাকে জাতিস্মর ভাবার ভুল করেনি।
কিন্তু এই গাজন বাবা সাধু মানুষ। ইনি যে পূর্বজন্মের কথা ভুল বলবেন না সে বিষয়ে একেবারেই নিশ্চিত ছিলাম।
আরো জানার জন্য আবার জানতে চাইলাম – পূর্বজন্মে কে কে ছিল বলো!
তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বোম বোম ভোলে বলে বললেন- মা বাবা বোন সবাই ছিল।
আর এ জন্মে? আমার অতি কৌতুহলী প্রশ্ন শুনে তিনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
এ জন্মে ঈশ্বর আছেন।
আমি একটুও খুশি হলাম না তার উত্তরে।
আমারও মা বাবা দুই বোন আছে।আমারও রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সারদা আছে।সকলে তাদের ঈশ্বরই বলেন।তাহলে আর তার সঙ্গে আমার কি পার্থক্য! আমিও তাহলে তার মতো যে কোনো সময়ই সাধু হতে পারি।কিন্তু এই বয়সে সাধু হলে আমার কতদিন লাগবে অত বড় জটা আর দাড়ি হতে এই প্রশ্নটা মাথাতে ঘুরতে লাগল।
সূর্য ডুবে গেলে ঘরে ফেরার জন্য উঠে পড়লাম।
গাজন বাবা বললেন, এই গঙ্গা যেখান থেকে নেমেছে সেখানে আমার পূর্বজন্ম, আর যেখানে সমুদ্রে মিশেছে সেখানে এ জন্ম।
এ কথার মানেটা আমি বুঝতে পারলাম না।মনে মনে ঠিক করলাম,যেদিন আমাকে উদ্ধার করতে ফেলুদা আসবে সেদিন তার থেকেই জেনে নেব।বাবাকে এ নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না।তাহলে আর আর আমার ঘর ছেড়ে পথে নামা হবে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।