ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৪৯)

কু ঝিক ঝিক দিন

বাবা প্রায় সময়ই নিজের মনে কিছু লাইন বলত।যেগুলোর মানে বুঝতাম না একেবারেই।যেমন বলত-
ঘরে কুরুক্ষেত্র
বাইরে কুরুক্ষেত্র
কুরুক্ষেত্র মনে
অর্জুন কিছু বলছে
কৃষ্ণ কি তা শোনে!
মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা জানি।সে যুদ্ধে পান্ডব জয়ী,কৌরব পরাজয়ী।কৃষ্ণ অর্জুনের সারথী।যুদ্ধ করবে না বলে অর্জুন চলেও যেতে চেয়েছিল। তারপর কৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন এই প্রেক্ষিতে তা গীতায় আছে।
এসব জানা।কিন্তু মনের মধ্যে আবার কি করে কুরুক্ষেত্র হয়!ঘরেও তো যুদ্ধ হয়নি।
তাহলে?
বাবাকে জিজ্ঞেস করলে বিষয়টা আরও জটিল হয়ে যাবে।কুরুক্ষেত্র বোঝাতে গিয়ে বাবা হয়তো বেদাভ্যাস থেকে শুরু করে গনেশকেও নিয়ে বলতে শুরু করবে।
তাই আপাতত শোনাটাই একমাত্র কাজ।আমিও তাই করছিলাম।আর মাঝে মাঝে বাবার মতো করেই বিড়বিড় করছি।ঠিক যেমন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের পেন্সিলটাকে সিগারেটের মতো ধরে ঠোঁট চিপে সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গি করতাম।বাবা সিগারেট পানের সময়, কিংবা হাতের দু আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখার সময় ডানদিকের চোখটা একটা অদ্ভুত স্টাইলে করে থাকত।মাথাটাও ডান দিকে ঘোরানো।দেখে মনে হত বাবা এখানে বসে আছে ঠিকই,কিন্তু দৃষ্টি বহুদূরে। সেখানে অন্য কোনও দৃশ্য। কিংবা সে দৃষ্টিতে কেমন ঘর ছাড়ার উদাসী ভাব।বাউলদের চোখে ও দৃষ্টি আমি দেখি রামপুরহাট যাবার সময়।
কিন্তু দৃষ্টি যাই হোক, বাবা আদতে আমাদের বাবাই।হতে পারে কারোর গুরু,কেউ ভাবে ঈশ্বর, আবার কারোর বড়দা।
এই বড়দা ডাকটা সকলের জন্য। বাবার থেকে ছোট বড় যাই হোক বড়দা বলেই ডাকত বাবাকে।আর ডাকে কাকু বা জ্যেঠু বলে।
কেন জ্যেঠু বলে বুঝতে পারতাম না।যারা বলত,তাদের বয়স প্রায় তিরিশ। বাবা তাদের থেকে হয়তো সামান্যই বড়। একবার মজার ঘটনা ঘটল।বাবাকে জ্যেঠু বলে এমন একজন,আমরা তাকে তারপর থেকে ঘোতনদা বলে চিনলাম,সেই প্রথম আমাদের বাড়ি এল।তার পিসি বাবাকে কিছু দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।
বাবা যথারীতি বাড়ি নেই। মা দরজা খুলে দিল।প্রায় মায়ের বয়সী ঘোতনদা,মাকে বলল,তুমি নিশ্চয়ই জ্যেঠিমা।বলেই সটান করে প্রণাম। মা এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। নির্বিকার মুখে বলল,হ্যাঁ বাবা।ভালো থেকো।
আমাদের খুব রাগ হল।আমার মা বুড়ি নয় যে জ্যেঠিমা বলতে হবে।মায়ের বয়সও তখন তিরিশের কোঠাতেই।
পরে অবশ্য এগুলো আমরাও মেনে নিয়েছিলাম।
আর একটা ঘটনা ঘটল।এক আই পি এস অফিসারের ছেলে একদিন বাড়িতে এলেন।খুব সুন্দর দেখতে।লম্বা,চোখে চশমা।তীক্ষ্ণ নাক। তিনিও বাবার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছেন।যথারীতি মা দরজা খুলল।তিনি বললেন কাকিমাকে একটু ডেকে দেবেন দিদি?
মা বলল- হ্যাঁ বলুন,কি দরকার?
আপনাকে তো বলা যাবে না।কাকিমাকেই দরকার।
মা এবার বলল,আমিই কাকিমা।
সেতো শুনে অবাক।ওই বৃদ্ধ কাকুর এত অল্প বয়সী স্ত্রী!
যাহোক সেই দাদা,নাম জানলাম তমাল দা,তিনি তখন সদ্য আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে ছবি আঁকছেন।তার দাদা বিখ্যাত তবলা বাদক আর দিদি রেডিও দূরদর্শনের নিয়মিত গায়িকা।
তার ওপর ভার পড়ল,আমাদের আঁকা শেখানোর।সপ্তাহে দুদিন তিন দিন সে যেমন সময় পেত আসত।ততদিনে সে আমাদের প্রিয় দাদা হয়ে গেছে।
রাস্তা থেকেই সে চেঁচিয়ে বলত,কাকিমা আজ খুব পরিশ্রম গেছে। লুচি খাব।
মা’ লোকজন খাওয়াতে খুবই ভালোবাসত।আর এসব তার নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। রোজই লোকজনের ভিড় থাকত।
একদিন লুচি আলুরদম খেতে খেতে তমাল দা বলল,কাকিমা একটা সত্যি কথা বলবে?
মা লুচি বেলতে বেলতে বলল- বলে ফ্যাল।
তুমি কি কাকুর দ্বিতীয় পক্ষ?
এই দ্বিতীয় পক্ষটা কি বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম একে পক্ষ দুই চন্দ্র। দ্বিতীয় পক্ষ তো নেই। তবে একটা গান শুনেছি। কৃষ্ণ পক্ষ শুক্ল পক্ষ আমার এটি দ্বিতীয় পক্ষ খুশির সীমা নাই.. এরকম কিছু। এখানেও কি তাহলে সেই কৃষ্ণের কারসাজি!
মা হেসে উঠল তার কথা শুনে।দিয়ে বলল,তোর কেন এমন মনে হল?
সে বলল,কাকুকে দেখেই বোঝা যায় আমার বাবার বয়সী।
তোমার বাবার বয়স কত গো? জানতে চাইলাম।
বলল,এই তো আর দু বছর চাকরি। মানে ওই ৫৭/৫৮ হবে।
এ বলে কি? আমার বাবা এত বুড়ো! দেখে তো বোঝা যায় না।
মা বলল,না না আমারও তোর কাকুর কাছাকাছি বয়স।কিন্তু দেখে অতটা বোঝা যায় না।বেঁটে, রোগা তো!
কি বুঝল কে জানে!আর কিছু বলল না দাদা।
আমার মাকে কেউ বুড়ি,রোগা, বেঁটে বললে বোনেদের খুব রাগ হয়।ওরে বলল,আমার মা মোটেই বুড়ি নয়।
দাদা বলল,সেই জন্য তো বললাম,কাকিমা এত ইয়াং আর কাকু!
এসব ঘটনা ঘটতেই থাকে আমাদের বাড়িতে।ক্রমশ আমরাও অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
একদিন এরই মধ্যে বাবা সিগারেট পান করতে করতে যখন বলল-… কুরুক্ষেত্র মনে…
তখন আমি জিজ্ঞেস করে ফেললাম,মনে কি করে কুরুক্ষেত্র হয়? যুদ্ধ তো খোলা জায়গায় হয়।আর মন তো দেখাই যায় না।
বাবা যথারীতি সেই উদাসী দৃষ্টিতে বাইরে জানলার দিকে তাকিয়ে, অথচ যেন সেখানে নেই, এমন স্বরে বলল,সবচেয়ে বড় যুদ্ধ মানুষের মনের মধ্যেই চলে।সেই যুদ্ধে সে একাই যোদ্ধা, একাই প্রতিপক্ষ।এ যুদ্ধে এক আমিকে রক্তাক্ত করে অন্য আমির টিকে থাকা।এর ফলাফল বাইরের লোক জানতে পারে না।দর্শক সে নিজেই।
কিন্তু অর্জুনের কথা তো কৃষ্ণ শুনেছিল।তাই তো তাকে ধরে এনে রথে বসিয়ে বিশ্ব দর্শন করিয়েছিল।আমি বললাম।
কৃষ্ণ অর্জুনের কথা শোনেনি।সে নিজে যেটা ঠিক মনে করেছিল সেটাই অর্জুনকে বুঝিয়েছিল,কিংবা শুনতে বাধ্য করেছিল।
আসলে যুদ্ধটা কৃষ্ণের মনেও চলছিল।অর্জুনের মনেও।বাবা সেই রকম দৃষ্টিতেই বহুদূর থেকে যেন উত্তর দিল।
এই ফিলোসোফি বোঝার মতো বয়স সেই দশ বছরের আমির ছিল না।কিন্তু লাইনগুলো মাথায় গেঁথে নিলাম।কি জানি কখন কাজে লাগে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।