গল্পবাজে বিপ্লব গোস্বামী

প্রতারণা

নীলা তার মা বাবার খুব আদরের মেয়ে।বয়স চার হতে না হতেই বাবা তাকে নামী ইংরেজি মাধ‍্যম স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।মা বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তাদের মেয়ে পড়াশোনা করে বড় মানুষ হবে।গান শিখে খুব নামী গায়িকা হবে।তাই অল্প বয়সেই নীলার জন‍্য তার বাবা হারমোনিয়াম কিনে আনলেন।সিদ্ধান্ত নিলেন সঙ্গিত বিদ‍্যালয়ে ভর্তি করার। নীলার মায়ের সঙ্গে তিনি গল্প করতেন , দেখবে মিনা আমাদের মেয়ে এক দিন খুব নামী গায়িকা হবে।আর যেদিন আমাদের নীলা টিভিতে গান করবে সেদিন সবাইকে আমি ডেকে বলব,দেখো আমার নীলার গান টিভিতে দেখাচ্ছে।মিনাও বলতেন সত‍্যি গো আমাদের মেয়ে একদিন খুব বড় গায়িকা হবে।
গোপাল বাবুর আর সেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি।মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কর্কট রোগে গোপাল বাবুর মৃত‍্যু হয়।নীলা সেদিন স্কুলে ছিল।স্কুল তখনও ছুটি হয়নি।তখন একজন লোক গিয়ে নীলাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলেন।নীলা সেদিন কিছুই বুঝতে পারেনা।বাড়িতে এসে দেখল বাড়িতে অনেক লোকের ভিড়।বাবাকে উঠানে শুইয়ে রাখা হয়েছে।বাড়িসুদ্ধ সবাই মাকে বুঝাচ্ছেন।সে কিছুই বুঝতে পারে না ।সে মায়ের কাছে যেতেই মা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।মা বলতে লাগলেন নীলা তোর বাবা আর নেইরে,ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। নীলা মাকে বলল,”বাবা কোথায় গিয়েছে ? বাবা কি আর কোন দিন আসবে না ?” মা বললেন না সোনা ও আর কোন দিনও আসবেনা।এ কথা বলে মিনা নীলাকে বুকে ধরে আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।নীলি সেদিন কিছুই বুঝতেই পারেনা।
সেদিন বাবার জন‍্য নীলা কাঁদেনি কিন্তু আজ কাঁদছে।আজ সে বড় হয়েছে,বুঝতে শিখেছে।বুঝতে পারছে বাবার অভাব।বাবার মৃত‍্যুর পর মিনা অনেক কষ্ট করে নীলা ও ছোট মেয়ে চাঁদনীকে বড় করেছেন।নীলা ও চাঁদনীকে কোন দিন বাবার অভাব বুঝতে দেননি।মিনা গোপাল বাবুর ইচ্ছে পূরণ করতে ছোটবেলাতেই নীলাকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।নীলা যখন বুঝতে শিখল তখন মিনা গোপাল বাবুর ইচ্ছের কথা নীলাকে বললেন।নীলা বাবার ইচ্ছেটা স্বপ্ন করে বুকের ভিতর পুষতে লাগল।গানের স্কুলের সব শিক্ষকই তাকে খুব আদর করতেন।দত্ত স‍্যার বলতেন “নীলা তোমার কণ্ঠ খুবই মিষ্টি,তুমি একদিন খুব ভালো গায়িকা হবে।”
একদিকে পরিবারের ভরণভোষণ অন‍্য দিকে দুই মেয়ের পড়াশুনা অর্থ যোগাতে মিনার অনেক অসুবিধা হতে লাগল।অর্থের অভাবে গানের ডিগ্ৰি সম্পূর্ণ না করেই পড়াশুনা বন্ধ করতে হল নীলাকে।দু পয়সা রোজগারের জন‍্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শিখাতে লাগল নীলা। যাতে মাকে একটু হলেও সাহায‍্য করতে পারে তাই।
বাবা ইচ্ছে পূরণের স্বপ্নটা নীলাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল।প্রথমে পাড়ায় অনুষ্ঠান হলে গান করত।তাতে খুব প্রশংসাও পেত।তার পর আস্তে আস্তে লোকের ডাক পড়তে লাগল।ছোটখাট অনুষ্ঠানে খুব নাম হতে লাগল।সংস্থা-সংঘ থেকে অনেক পুরস্কারও পেয়ে গেল।একদিন শহর থেকে আসা এক বড় নামী শিল্পীর অনুষ্ঠানে ভাগ‍্যক্রমে গান করার সুজুগ হয়ে গেল নীলার।গান শেষে এক ভদ্রলোক নীলাকে ডাকে বললেন “কি নাম তোমার ? ভালো কণ্ঠ তোমার।বেশ ভালো গেয়েছো।”এই বলে উনি উনার পকেট থেকে একটা কার্ড নীলাকে দিয়ে বললেন এতে আমার মোবাই নাম্বার আছে যোগাযোগ করবে।আমি তোমার গান রেকর্ড করবো।নীলা আনন্দে আত্ম হারা হয়ে যায়।ভাবতে লাগল এবার হয়তো বাবার স্বপ্নটা পূরণ হবে।
বুক ভরা আশা নিয়ে নীলা উনার সঙ্গে যোগাযোগ করল ।উনার বলা ঠিকানায় গিয়ে উনার সাথে দেখা করল।উনি নীলাকে গান রেকর্ড করার জন‍্য গান শিখাতে লাগলেন।নীলাকে প্রতিদিন যেতে হত উনার কাছে।কিছু দিন পর উনি নিজে আসতে লাগলে নীলার বাড়ীতে।এভাবে বছর দিন কেটে গেলে।এক দিন উনি নীলাকে প্রেমের প্রস্তাব দিলেন।নীল বিশ্বাসই করতে পারছিল না এত বড় এক জন মানুষ তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছেন।এ তো স্বপ্ন নয়।প্রথমে নীলা প্রস্তাবে রাজি না হলেও ধীরে ধীরে উনার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল।
বিজয় ব‍্যানার্জী সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তন।বছর ত্রিশের তরতাজা যুবক।সুন্দর চেহারা।একটু হালকা গঠন।সব চেয়ে আকর্ষনিয় হচ্ছে তার হাসি।তার আকর্ষণীয় পুরুষোচিত চেহারা এবং সুন্দর হাসি নীলাকে এতটা বিমোহিত করেছিল যে নীলা বিজয়কে মনে মনে স্বামীর আসনে বসিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতে লাগল।
নীলা বিজয়কে সত‍্যি ভালোবেসে ছিল।ফলে তার সব কিছু বিজয়কে সঁপে দিয়েছিল।দিন দিন বিজয়ে অধিকার বোধ বাড়তে লাগল।এক সময় নীলা গর্ভবতী হয়ে যায়।ফলে নীলা বিজয়কে বিয়ের জন‍্য চাপ দিতে থাকে।বিজয় নীলার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। নীলার মোবাই নং ব্লক করে দেয়।অনেক কষ্টে নীলা দেখা করলে বিজয় বলে আমার দ্বারা তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।এক কাজ করতে পারি, আমি তোমাকে লাখ খানেক টাকা দিচ্ছি তুমি ভালো এক নাসিংহোমে গিয়ে এবরশন করে নাও।এতে তোমারই ভালো।আর যা হয়েছিল তা ভুলে যাও।এ কথা বলে বিজয় চলে যায়।নীলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।গা কাঁপতে লাগল।দম বন্ধ হয়ে আসে।দু চোখ দিয়ে জল আপনা হতেই ঝরতে লাগে।যাকে এত দিন নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করত।যাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। সে আজ বলছে ভুলে যেতে ,এবরশন করে নিতে।বিজয়ে মুখ থেকে এমন কথা শুনবে তা কোন দিন কল্পনাও করেনি নীলা।নীলার পবিত্র ভালোবাসা ,বিশ্বাস আর সতীত্বের বিনিমনে টাকা দিতে চাইছে বিজয়।নীলা কিছুতেই এ কথা মেনে নিতে পারে না।বিজয়ের মতো এট সম্ভ্রান্ত ঘরে ছেলে,এত বড় মাপের মানুষ এমনটা করতে পারে তা বিশ্বাস করতে পারছিল না নীলা।অবশেষে অপমানে -দুঃখে নীলা আত্মহত‍্যার পথ বেচে নিল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।