T3 || শ্যামা আমার || দীপাঞ্জলী সংখ্যায় বিজয়া দেব

তরুলতা

তরুলতার রঙ কালো। আবার তার বাড়ির সবার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল ফর্সা। তরুলতার জন্মের পর তার মাকে বাবা কথা শোনাত। বলত, এ আমার মেয়ে নয়, এ হতে পারে না। তা নিয়ে বড়ো কষ্টে কাটছে কাল তরুলতার মায়ের। মা খুব ভালো গান গাইত। বিশেষ করে মাতৃসঙ্গীত। একটু বড়ো হওয়ার পর সে দেখল বাড়ির সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। সে কিছু বললে তার উত্তর কেউ দেয় না। মা কাঁদতো লুকিয়ে।  তার সামনে কখনও চোখের জল ফেলেনি।  একদিন আড়াল থেকে শুনে ফেলল- বাবা বলছে, তুমি তো চরিত্র হারিয়েছ সেই কবে, তোমাকে যে এই বাড়িতে রেখেছি সে আমার উদারতা,  মহত্ত্ব।  নাহলে এমন কালো মেয়ে আমাদের বংশে নেই। চেহারাও বাড়ির কারো সাথে মেলে না।
মা গেয়ে উঠল – ” কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন ” / রূপ দেখে তার বুক পেতে শিব যার হাতে  মরণ বাঁচন”

বাবার তাতে কোনও ভাবান্তর হয় না। বলে- হুঁ! আধ্যাত্মিক গান গেয়ে পাপের হাত থেকে বাঁচতে চাওয়ার যত্তসব চালাকি!
তরুলতা বুঝল এ বাড়ি তার নয়। সে জানে না তার জন্মবৃত্তান্ত।  জানতে চায়ও না। সেদিন ঘরে ঢুকে বলে – মা, আমি গান শিখতে চাই। ইশকুলে গানের ক্লাশে নাম লিখিয়েছি।
মা চিন্তিত মুখে বলে – এক্সট্রা ফী লাগবে না কি রে?
– কিছু তো বলেনি। বললে তোমাকে জানাব।
তরুলতা দু:খ পেতে পেতে দু:খকে আজকাল আর গায়ে মাখে না। তাকে সরকারি ইশকুলে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি সবাই বেসরকারি নামী দামী ইশকুলে যায়। ওদের গাড়ি আসে ইশকুলের। তরুলতার ইশকুল বাড়ি থেকে তেমন দূর নয়। সুতরাং সে হেঁটেই যায়। মিউজিক ক্লাসে শিখা ম্যাডাম গান শেখায়। তবে মিউজিক ক্লাশ সপ্তাহে দু’দিন মাত্র। বাড়িতে প্র‍্যাকটিস করার প্রশ্নই উঠে না। কত কথা যে শুনতে হবে তার। একমাত্র মা তার পাশে আছে। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় বাবার অভিযোগ শুনতে শুনতে মা-ও তার ওপর বিরক্ত হয়ে ওঠে।
৷  একটু হলেও ভালো, শিখাদি তার গানের গলার প্রশংসা করল। বলল, একটু যত্ন করলেই খুব ভালো গাইতে পারবি তরু। তোদের তো টাকাপয়সার অভাব নেই, তাহলে বাইরে শিখছিস  না কেন?
তরু কিছু বলে না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার নীরবতা যেন অনেক কথা বলে।
 শিখা তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে। এই বয়েসে মেয়েরা চঞ্চল হয়। বন্ধু হয় কত, কিন্তু তরু কেমন যেন একা, নিজেকে লুকিয়ে রাখে। এতো সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে, অথচ পড়ছে সরকারি ইশকুলে। এটা সিদ্ধান্ত পরিবারের তবু এই সময়সাপেক্ষে ঠিক স্বাভাবিক নয়।
 সামনেই কালীপুজো। শিখাদের বাড়িতে পুজো হয় বেশ বড়ো করেই।
সে বলে, তরু, কালীপুজো হয় প্রতিবছর আমাদের বাড়িতে। গান হয়, তুমি গাইবে?
মনে হলো তরু খুব খুশি হলো। সে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়।
হঠাৎ জিজ্ঞেস করে – ম্যাডাম,  কালী মায়ের রঙ কালো কেন?
 শিখা অবাক হয়ে তরুকে দেখে। এরকম একটি প্রশ্ন সে কেন করল? এটাও ভাবার ব্যাপার বটে।
উত্তরে বলল – আমাদের শাস্ত্রে তার নানারকম ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু আমি যা ভাবি তা সিম্বলিক। মানে প্রতীকী।  আকাশের রঙ কি বলতো? না,  আকাশ নয়, মহাকাশ, গ্যালাক্সির কি রঙ?
তরু বলে – কালো। অন্ধকার।
– হ্যাঁ সেই ঘোর অন্ধকারে গ্রহ নক্ষত্র, ছায়াপথ অর্থাৎ গ্রহাণুর অবস্থান।  সেই মহাশূন্যে আমরাও আছি। সেই হচ্ছে মহাকাল, সময় বলে কিছু নেই। আমরা আমাদের জন্মমৃত্যু দিয়ে সময় তৈরি করেছি। আমাদের জীবৎকাল দিয়ে তৈরি করেছি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত। সেই অন্ধকার এবং মহাকাল অর্থবহ, মহাশক্তিধর, সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রতীক। আমার মনে হয় তারই  নির্যাস নিয়ে কালীর কালোরঙ এবং তিনি মা,  মানে সৃষ্টির প্রতীক।  কেন একথা জানতে চাইছ তরু?
তরু মাথা নীচু করে বলে- না, এমনই।  জানতে চাই।
শিখা বলে – খুব ভালো প্রশ্ন করেছ। তোমার বয়েসি মেয়েরা এতসব নিয়ে ভাবে না। তুমি ভেবেছ খুব ভালো লাগলো।
আজ কালীপুজো। শিখাদের বাড়িতে মাতৃসঙ্গীতের আসর বসেছে। শিখা তরুলতাকে গাইতে বলল। তরু শিখার বাড়িতে গান গাইছে।  মায়ের গাওয়া গানটাই শুরু করল –
“কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন।
ও তার রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ- বাঁচন।
 কালো মায়ের আঁধার কোলে
শিশু রবি শশী দোলে
একটুখানি রূপের ঝলক স্নিগ্ধ বিরাট নীল – গগন।
পাগলী মেয়ে এলোকেশী নিশীথিনীর দুলিয়ে কেশ
নেচে বেড়ায় দিনের চিতায় লীলার রে তার নাই কো শেষ।
সিন্ধুতে মা’র বিন্দুখানিক
ঠিকরে পড়ে রূপের মাণিক
বিশ্বে মায়ের রূপ ধরে না মা আমার তাই দিগ- বসন।”
সবাই আত্মহারার মতো শুনছে। আরও লোকজন এসে জমছে। সবাই বলছে – কে মেয়েটা? এমন চমৎকার কন্ঠ!
তরুলতার দু’চোখে জলের ধারা।
শিখার বাবা বলে উঠলেন – আজ আমাদের মাতৃ আরাধনা সার্থক হলো। তুমি কে গো মা?  পরিচয় পাই নি। তুমি যে মা আমার শ্যামা মা- কে জাগিয়ে দিলে।
তরুলতা চওড়া লালপেড়ে শাড়ি পরে এসেছে।
শিখা হেসে বলে – আমার ছাত্রী বাবা। ইশকুলেও খুব ভালো গায়, কিন্তু আজ যা গাইল তার কোনও তুলনা হয় না। একেবারে মনপ্রাণ ঢেলে গেয়েছে।
সবাই স্বীকার করছে – একেবারে সুরেকথায় ভরিয়ে দিয়েছে চারপাশ মেয়েটা। মা-কে যেন জাগিয়ে দিল।
শিখার মা বললেন – তুই বাড়িতে ওকে গান শিখিয়ে দিবি। ওর কাছ থেকে কোনও ফী নিবি না। মনে রাখবি এটা মায়ের আদেশ।
বলে শ্যামা মা- র সামনে করজোড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।