।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অপূর্ব শঙ্কর চন্দ

নুনের ঋণ

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনি ঢাকা থেকে পিনুকাকা এসেছেন। ব্যবসার কাজে মাঝেমধ্যেই কলকাতা আসতে হয় তাকে। যখনই আসেন সাথে করে নিয়ে আসেন বাংলাদেশের রকমারি সব বাহারী জিনিস।
তবে আমাদের কাছে পিনুকাকার আকর্ষণ তার আনা উপহারের জন্য নয়। আসলে পিনুকাকা সম্ভব অসম্ভব নানারকম গল্প বলে আসর জমাতে ওস্তাদ। আর এবাড়ির ছেলেমেয়েরাও তাই সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ঘোরে।
পিনুকাকার আসবার খবর কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের মত সবার ঘরে ঘরে ছুটলো। বেচারা জামাকাপড় ছেড়ে থিতু হবার আগেই রনি, পুটু, বুবু যে যেখানে ছিল সবাই এসে ঘিরে ধরলো তাকে।
কাকু বললেন,” গল্প এখন নয়। রাতে সব জমিয়ে হবে। “
রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে কেউ? সন্ধ্যে হতে না হতেই একেবারে ঘেরাও হয়ে গেলেন কাকু। পড়াশুনো শিকেয় তুলে বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো সব এক ঘরে এসে জুটেছে। মুখে এক খিলি পান আর জর্দা নিয়ে মজলিসী ঢংয়ে শুরু করলেন পিনুকাকা, ” কিসের গল্প আজ শুনতে চাস তোরা? “
” তোমার যা খুশি বল”, ওপেন চেক দিয়ে দিল রনি।
পিনুকাকা একটু চূপ করে রইলেন, খানিক ভেবে, দম নিয়ে ধীরে সুস্থে শুরু করলেন, ” আজ তোদের যে গল্পটা বলবো তাকে গল্প না বলাই ভাল। এটা কোনো বানানো কাহিনীও নয়। অন্য কারো মুখে শুনলে হয়তো আমিও বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু নিজের জীবনের ঘটনাকে গল্পই বা বলি কি করে আর এমন আপাত অসম্ভব ঘটনাকে তোদের বিশ্বাসই বা করতে বলি কোন মুখে? খুকি পিসিমা আজ বেঁচে থাকলে অত ধানাই পানাই করে আমায় সাফাই গাইতে হত না রে। “
একটু থেমে আমাদের সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে গল্পের মুখরাটা কেমন হয়েছে বুঝে নিয়ে পিনুকাকা আবার শুরু করলেন, “আমি তখন ময়মনসিংহ নাসিরাবাদ কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের পড়া শেষ।
একদিন হঠাৎ গোলপুকুর পারের বাড়ি থেকে জ্যেঠামশাইয়ের জরুরী তলব। গেলাম ছুটে পরদিন। এক থালা গরম লুচি আর আলুর দম খেতে দিয়ে জ্যেঠিমা বললেন,” বাবা পিনু, জানিস তো খুশির বিয়ে পরশু, বানিয়াকাজি গ্রামের বাড়িতে। আমরা সবাই কালই চলে যাচ্ছি সেখানে।”
আমি বললাম, “যাও না। অসুবিধা কোথায়? আমি নাহয় এখানে থেকে বাড়ি পাহারা দেব।”
“বোকা ছেলের কথা শোনো । তূই যাবি না বিয়েতে? তোকে ছাড়া চলবে আমাদের? তাছাড়া এ বাড়ি পাহারায় তো চানমোহনই থাকছে।”
“তাহলে আর আমায় ডেকেছ কেন?”
” আসলে কি হয়েছে জানিস? তোর জ্যাঠাকে পই পই করে বলেছিলাম হেলা স্যাকরাকে গয়নার বরাত দিও না – দিও না। তা শোনে আমার কথা?”
” তো কি করেছে হেলাকাকা? “
” গতকাল এসেছিল হেলা। বিয়ের সব গয়নাই দিয়ে গেছে। কেবল বরের আশীর্বাদি চেনটা নাকি এখনো তৈরীই হয়নি। আগামিকাল দুপুরবেলা ডেলিভারি দেবে বলে গেল।”
” বেশ কথা। কাল পেলেও তো চলবে। বিয়ে পরশু না? “
” তা তো ঠিকই আছে। কিন্তু দোকান থেকে জিনিসটা ডেলিভারি নেয় কে? আমরা সবাই কাল ভোর ভোরই গ্রামের বাড়ি রওনা হয়ে যাচ্ছি না?”
“তাহলে? “
জ্যেঠামশাই এতক্ষন “দৈনিক ইত্তেফাক” পত্রিকায় চোখ বুলোচ্ছিলেন। এবার পত্রিকাটা ভাঁজ করে, চশমা খুলে বললেন, ” তাই তো তোকে ডাকা। শোন পিনু, তুই দুপুরবেলা হেলার দোকান থেকে চেনটা আর তার রসিদ নিয়ে সোজা বানিয়াকাজি চলে যাবি আর বিয়ে মিটলে আমাদের সবার সাথে শহরে ফিরে আসবি।”
জ্যেঠার মুখের ওপর কথা কইবার সাধ্যি আছে? তবু একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ” আগামী কাল তো কলেজের স্পোর্টস । কয়েকটা ইভেন্টে নামও দিয়েছি। তবু মাঠ থেকে ঠিক সময়ে ফিরে হেলা কাকার দোকান হয়ে ঠিক পৌছে যাব বিয়েবাড়ি। চিন্তা কোরো না। “
জ্যেঠিমা বললেন, “বাঁচালি বাবা। যা ভাবনায় পড়েছিলাম! যা,এখন স্নান সেড়ে নে। দুপুরে আর রাতে খেয়ে দেয়ে একেবারে হোস্টেলে যাবি। “
তোরা তো জানিস, ভালোমন্দ খাবারের ডাক এই পিনুশর্মা কোনদিন ফেরায় না। তাই, থেকে গেলাম সেই দিনটা।
পরদিন স্পোর্টস এ নেমে একশ মিটার দৌড়ে কিভাবে যেন থার্ড হয়ে গেলাম। আসলে ভাবি নি তো কোন প্রাইজ পাবো। তাই জ্যেঠাকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি কলেজ থেকে ফিরবো।
এবার পড়লাম ভারি বিপাকে। প্রাইজ না নিয়ে মাঠ ছাড়ি কি ভাবে? আবার প্রাইজ নিতে গেলেও দেরি হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পর পর আকাশের দিকে তাকাই আর সূর্য দেখে ঠাহর করবার চেষ্টা করি কত বেলা হোলো।
শুনলাম প্রাইজ দেবেন ডিষ্ট্রিক্ট কালেক্টার। তার জন্যে অপেক্ষা করে করে বিকেল পাঁচটা বাজলো।
প্রাইজটা কোন রকমে নিয়ে এক ছুটে গেলাম জুবিলি পার্ক – হেলাকাকার দোকানে। সেখান থেকে সোনার চেনটা আর তার রশিদ নিয়ে অবশেষে যখন বেবি ট্যাক্সি (অটো রিক্সা) স্ট্যান্ডে এলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়।
স্ট্যান্ডে এসে তো মাথায় হাত! শুনলাম সকালবেলা ওদিকে ভারী ঝড়-বাদল হয়েছে। বড় বড় গাছ পড়ে জায়গায় জায়গায় পথ বন্ধ । সারাদিন কোন যানই নাকি চলছে না এই পথে। এখন উপায়?
আবার ছুটলাম গোলপুকুর পারের বাড়িতে। চানমোহনের সাইকেলটা নিয়ে যখন শহর ছাড়িয়ে কাঁচা রাস্তায় পড়েছি তখন চারিদিক অন্ধকার হয় হয়। পূবদিকের আকাশে ফ্যাকাশে গোল চাঁদটা কেবল একটু একটু করে জ্যোৎস্না ছড়াতে শুরু করেছে।
প্রথম প্রথম বেশ জোরেই চালাচ্ছিলাম সাইকেল। দাপুনিয়া বাজার ভালভাবেই পার হয়ে এলাম। চায়ের দোকানে জটলা দেখে চা খেতে ভারী ইচ্ছে হচ্ছিল। কোনরকমে লোভ সামলে এগিয়ে চললাম। ভাবলাম খেরুয়াজানি পৌছে বেদম হয়ে পড়লে একবার থামবো। গরম গরম চা খেয়ে আবার সাইকেল ছোটানো যাবে।
কিন্তু খেরুয়াজানি পৌঁছে দেখা গেল লোকজন একদম নেই। সকালের দিকে এদিকেও ঝড় জল হয়েছে। পথের দুধারে অনেক বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে রয়েছে দেখলাম। তিন চার জায়গায় রাস্তার ওপর আড়াআড়ি গাছ পড়ে থাকায় কখনো কখনো সাইকেল কাঁধে নিয়েও রাস্তা পার হতে হল।
এসব বাঁধা ঠেলে যখন পীরগাজিপুরের মসজিদটা পার হচ্ছি, তখন রাত আন্দাজ দশটা। ভয়ে বুক দুরদুর করছে। চাঁদের আলোয় সব কিছু মোটামুটি দেখা গেলেও তেনাদের ভয় তো আর কিছুতেই দূর হয় না।”
এতক্ষন একটানা কথা বলে পিনুকাকা দম নেবার জন্য একটু থামলেন। ড্রয়িংরুমের পরদা সড়িয়ে মা ততক্ষনে তার জন্যে এক কাপ গরম চা আর আমাদের জন্যে এক ট্রে পাপড় ভাজা রেখে গেছেন।
গল্পের মোক্ষম জায়গায় আমাদের রেখে উনি ধীরে ধীরে আয়েশ করে চা পান সারলেন। সেদিনের স্মৃতি গরম চায়ে ভিজিয়ে একটু সতেজ করে নিয়ে আবার শুরু করলেন,”এই দুর্যোগ ভরা রাতেই তো তেনাদের মুখোমুখি হবার বিপদ ষোলআনা।”
ভুতের গন্ধ পেয়ে আমাদের গায়ের লোমও ততক্ষণে কাঁটা দিতে শুরু করেছে।
পিনুকাকা ব্যাপারটা আন্দাজ করে নিয়ে বললেন, “না রে। আজকে ভুতের গল্প নয়। এটা মহতাবের গল্প। মহতাব ছিল আমাদের বাড়ির কামলা। কামলা মানে তোরা জানিস? কামলারা বছর চুক্তিতে মালিকের বাড়িতে থাকে, খায়, জমিতে কাজ করে আর বছর শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী মজুরি নেয়।
বলে চললেন কাকা,” সেদিন আর তেনাদের দেখা পেলাম না। দেখা হল মুখ বাঁধা দুই ভয়ানক ডাকাতের সাথে। “
একটু থেমে আবার শুরু করলেন,”সবেমাত্র নন্দী বাড়ীর তেঁতুলগাছটা পার হয়ে টলুদের পুকুরের কাছ বরাবর এসেছি। হঠাৎ দেখি কোথা থেকে দুই মুশকো জোয়ান মালকোঁচা মেরে মুখে গামছা বেঁধে আমার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। একজনের হাতে তেল চুকচুকে গিঁটপাকানো একটা লাঠি। অন্যজনের হাতে বেশ বড়সড় একখানা ছোরা।
এদের দেখে তো আমার প্রাণপাখি ততক্ষণে উড়ে পালিয়েছে। তারপর যখন ওদের একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠলো,”থাম, নালে এক প্যাঁচ মারি গলার নলি কাটি ফেলাম”, তখন বুঝলাম এ যাত্রা আর রক্ষে নেই।
সাইকেল থেকে নেমে দর দর করে ঘামছি। মুখ থেকে কথা বেরুচ্ছে না। ছোরাহাতে ডাকাতটা আমার সাইকেলের হাতলে হাত রেখে বলল,”সাথে কি আছে? “
মিন মিন করে বললাম, “কিছু নেই।”
“কিছু নাই মানে? আমাগো কাছে পাক্কা খবর আছে। বাঁঁচবার চাইস তো সোনার গয়নাখান বাইর কর – নালে আইজ ই তোর ইন্তেকাল। “
বুঝলাম আর রেহাই নেই। গয়না বাঁচাতে গেলে প্রাণ যায়। আর প্রাণ বাঁচাতে গয়নাই বা হাতছাড়া করি কি করে? তাহলে বিয়ের কি হবে?
এতসব কথা ভাবতে হয়তো এক পলকও লাগে নি। হঠাৎ
দেখি মহতাব কামলা কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এসে আমাকে আড়াল করে ডাকাত দুটোর সামনে রুখে দাঁড়িয়েছে। হাতে কাঁচা বাঁশের একটা বড় লাঠি।
“সুমুন্ধির পো, আয় তো দেইখ্যা লই তোগো কইলজায় কত দম! ” বলতে বলতে তেড়ে গেল মহতাব। চোখের নিমেষে বাঁশ ঘুড়িয়ে ঘা কতক লাগাল ডাকাত দুটোকে।
মহতাবের কি ভয়ানক রূপ তখন! দেখে তো আমারই ভয় লেগে গেছে। কি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় এই মাঝবয়েসী মানুষটা অতবড়, অতমোটা বাঁশের লাঠিটায় পাক মেরে মেরে দুটো দুর্দান্ত ডাকাতকে ঘায়েল করতে পারে, সে কথা নিজের চোখে না দেখলে আমিই কি বিশ্বাস করতাম?
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাকাত দুটো কোঁকাতে কোঁকাতে আর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে পুকুর পারের বাঁশবাগানের দিকে গা ঢাকা দিল।
মহতাব এবার হাতের বাঁশখানায় ভর দিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। চোখদুটো যেন জ্বলছে।
” এত আইত (রাত) হোইলো কেম্বা করি, পিনু আব্বা? আইজ তো জানটাই বেঘোরে যাবা নাইগছিলো। সময়মত আমি না আলি পরে তো এতক্ষণ সব সাফা হয়্যা যেত নে। “
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতে তুমিই বা এখানে কি করছিলে চাচা? “
” আর কও ক্যান কত্তা। বিলের মাঝ বরাবর ফাঁস জাল কয়খান বিছাতি বিছাতি কেম্বা কইর‍্যা যান দেরি হয়্যা গেল। “
মহতাব বলতে লাগলো, ” জাল গুলান পাতি সবে ডাঙ্গায় উঠিছি, অমনি শুনি কারা য্যান কথা কয়। ভাইবল্যাম মেহেরাব আর জিয়াউরের মধ্যে বুঝি আবার নাগিছে। সকালবেলা দুইজনা খুব এক চোট মারপিট করিছে কিনা। কাছে আসি দেখি, হায় আল্লা! কুতুবপুরের দুই মুরুব্বি আমার পিনু আব্বারে শাসায়! মেজাজখান আর ঠিক রাইখবা পাইরল্যাম না। বাঁশের মোথাখান ধরি ছুটি আলাম। “
” তুমি না থাকলে আজ কি যে হত ভাবতেও ভয় করছে। “
” আরে আমি কেডা? খোদা রক্ষা করিছেন। আর তাছাড়া তোমাগো বাড়ির নুন প্যাটে পড়িছে যে। তার দাম চুকাতি হবে নে? “
মহতাব বললো, ” দ্যাও কত্তা, সাইকেলখান মোরে দ্যাও। বাড়ি আর বেশি দুর নাই। গপ্পো করতি করতি আর হাঁটি হাঁটি একসাথ বাড়ি যাই চল। “
মহতাবের সাথে কথা বলতে বলতে ঘরের পানে পা বাড়ালাম।
সাইকেলটা ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে মহতাব বললো, ” বুইঝল্যা কত্তা, এই চ্যাংরাগুলান কুতুবপুরের ইটভাঁটায় এক জব্বর রাহাজানি দল খুলিছে। হাটের পথে সুবিধামত যারে পায়, তার কাছ থাকি সব কিছু কাড়ি ল্যায়। যে চাইরখান বারি আইজ পড়িছে গায়ে, সাত দিন আর খাড়া হবা লাগবোনে। “
টুকিটাকি নানারকম গল্প করতে করতে একসময় আমরা বাড়ি এসে পৌঁছলাম। মহতাব আমার হাতে সাইকেলটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “যাও কত্তা। আইত (রাত) অনেক হইছে। এইবার হাত পা ধুইয়্যা খাওয়া দাওয়া সারি ল্যাও। কাইল আবার বিয়ার ঝামেলা আছে না। আমি আমার ঘর থাকি নুঙ্গি (লুঙ্গি) খান ছাড়ি আসি। “
মহতাব চলে গেল কামলাদের থাকবার ঘরের দিকে। আমিও উঠোন থেকে সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে জানান দিলাম যে আমি এসে গেছি।
লম্ফ হাতে বেড়িয়ে এলেন খুকি পিসিমা, “এত রাত করলি কেন রে পিনু? আমরা তো ভেবে ভেবে অস্থির। যা দিনকাল এদিককার – পথে কোন বিপদ আপদ হল কিনা কে জানে? “
সাইকেলটা দাওয়ায় হেলান দিয়ে রাখতে রাখতে বললাম,”বিপদ তো হয়েইছিল আজ। দুই ডাকাতের হাতে পড়েছিলাম পথে। “
আমার কথা শুনে ততক্ষণে একে একে জ্যাঠিমা, খুশি, জ্যাঠামশাই সকলে বেড়িয়ে এসেছে ঘর থেকে।
আমি বললাম,” মহতাব না থাকলে আজ ডাকাতের হাতেই প্রাণটা যেত। “
পিসিমা জিজ্ঞেস করলেন,” মহতাব? কোন মহতাব? “
“কেন? তোমাদের কামলা মহতাব। ওই তো আমায় ডাকাত দুটোর হাত থেকে বাঁচালো। তারপর টলুদের পুকুরপার থেকে আমরা দুজন একসাথে হেঁটে এলাম এখানে।”
পিসিমার চোখদুটো যেন ঠিকরে বেড়িয়ে আসবার যোগাড়,”তুই মহতাবের সাথে ছিলি এতক্ষণ? আমাদের মহতাবের সাথে?”কোঁকিয়ে উঠলেন পিসিমা।
“হ্যাঁ। ওই তো সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে এলো এখানে। “
“ওরে খুশির মা, রান্নাঘর থেকে শিলনোড়াটা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি! ওখানেই দেখ শুকনো নিমপাতা আছে। নয়ন, যা ছুটে, পাটকাঠি নিয়ে আয় – আগুন জ্বাল! রাম! রাম!রাম!”
এদের ভাবগতিক দেখে তো আমি একদম থ মেরে গেছি। কোন কিছুই বুঝতে পারছি না তো কথা বলব কি?
কে যেন আমার মাথায় আর সাইকেলটার ওপর এক এক বালতি জল ঢেলে দিল। পাটকাঠি এল, আগুন জ্বললো – তারপর শিলনোড়া আগুনে পুড়িয়ে আমার মাথায়, পিঠে, বুকে ছুইয়ে পিসিমা নিমপাতা চিবোতে দিলেন। তারপর জ্যেঠিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খুশির মা, ওকে আজ মাছ খেতে দিস না। ঘি দিয়ে শুধু সেদ্ধ ভাত। রাম! রাম! রাম!”
ঘরে বসে খুশির মুখে সব কথা শুনলাম আর শিউড়ে শিউড়ে উঠতে লাগলাম।
আজ সকালে ফজরের আজানের আগে নাকি আকাশ কালো করে, বাজ পড়ে ভয়ানক ঝড়-বাদল হয়েছে এখানে। প্রতিদিনের মত অন্ধকার থাকতেই মহতাব বিলে গেছিল আগের দিনে পেতে আসা ফাঁসজাল গুটিয়ে মাছ তুলে আনতে।
ঝড় বৃষ্টির সময় হয়তো জল থেকে মাথা বাঁচাতে বেচারা বিলের পাশের শিমুলগাছটার তলায় আশ্রয় নিয়েছিলো। তখনি ভয়ানক শব্দ করে গাছটার মাথায় বাজ পড়ে।
দুর্যোগ থেমে যাবার পর সবাই গিয়ে দেখে মহতাবের শরীর নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে পোড়া শিমুল গাছটার নিচে।
“আজই বেলার দিকে গোর দেওয়া হয়েছে ওকে পীরগাজিপুরের কবরখানায়।” খুশির কথা শেষ হল।
আমার হাত পা তখন পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাবার যোগাড়। একি দেখলাম আমি! মহতাব আমায় ডাকাতদের কবল থেকে রক্ষা করে, এতটা পথ পাহারা দিয়ে রাতের অন্ধকারে এভাবে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল! এই হিন্দু বাড়ির নুনের ঋণ এভাবেই শোধ করে দিয়ে গেল মহতাব!”
থামলেন পিনুকাকা। আমাদের সবার মুখের ভাব দেখে নিয়ে আবার শুরু করলেন,”বলেছিলাম না, এটা ভূতের গল্প নয়। মহতাব যদি ভূতই হত তাহলে কি আমায় ঘাড় মটকে না খেয়ে অমনি অমনি ডাকাতদের সাথে মহড়া নিত?”
গল্প শেষ করবার আগে পিনুকাকা বললেন,”আসলে কি জানিস? মহতাব তো মাত্র সেদিন সকালবেলাতেই মরেছে। তাই হয়তো বেচারা তখনও বুঝতেই পারে নি যে ও ভূত হয়ে গেছে। তাছাড়া ভূতেদের মধ্যে সবাই কি আর মন্দ ভূত? ভালো ভূত কি নেই ওদের মধ্যে?
আসলে খারাপ ভূতগুলোই কেবল দাঁত খিঁচোয়, ভয় দেখায় আর ঘাড় মটকায় বলে আমরা তাদের ভয় পাই।
আমাদের মানুষের সমাজেও দেখ যত খারাপ, যত দুষ্টু লোক আছে তারাই তো সবাইকে ভয় দেখিয়ে, চমকে সব কিছু কেড়ে নেয় বলে আমরা তাদের ভয় পাই। ভালো মানুষের কথা কেউ মনেও রাখে না – ভয় তো পায়ই না। “
পিনুকাকার গল্প শেষ হল। সে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আচ্ছা, পিনুকাকার এই গল্পগুলো কি সব সত্যি? নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলেন?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।