কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রশীদ সাগর

গল্প নয় সত্যঃ

মাঠঘাট ও একহাটু ফসল পেরিয়ে যখন দশম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে হুমড়ি খেয়ে প্রবেশ করি। ঠিক তখনই শিক্ষক মহোদয় বাঘ্র চিহারায় এসে হুঙ্কার দিয়ে বলে,কান ধরো।
কান ধরি না। তারপর বলে হাত পাতো, হাতও পাতি না।পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষমেষ শিক্ষক মহোদয় পিঠে ছড়ি দিয়ে দু’বার আঘাত করে বলে,আর দেরি করে আসবি না।
আমি হাবার মত দাঁড়িয়েই থাকি,তালগাছ হয়ে।
কেন যে দেরি করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করি, সে কথা কাউকে বলতে পারি না। নীরবেই থাকি। আঁধারে চলি,কল্পনায় ভাসি। চোখের সামনে ও কানের পর্দায় ভেসে আসে,ঢংঢং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘণ্টাধ্বনি। আমি প্রতিদিন ওই ঢংঢং ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় থাকি। আমাদের বিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটির ঘণ্টা বাজে। ওদের শুরু হয় ভোরে।আমাদের শুরু হয় সকাল দশটায়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির ঘণ্টার পরপরই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এ্যাসেম্বলী শুরুর ঘণ্টা বেজে ওঠে। আমি তো এ্যাসেম্বলী কোনোদিনও করি না,পালিয়ে-পালিয়ে থাকি। পাঠদানের ঘণ্টা শুরু হলে,বৃষ্টি পড়লে ভাদ্রমাসে মাঠ থেকে যেভাবে ছাগল দৌড়ায় ওইভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য দৌড়ায়।
যখন দৌড় দিই মেঠো পথ ধরে,তখন তাকিয়ে থাকে কামিনী। বুঝতে পারি। আমি শিক্ষকের মারের ভয়তে আর পিছন ফিরে তাকাতে পারি না। মাঠের ভোগ দিয়ে ফসল পাড়িয়ে দৌড়াতে থাকি।
ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমিও পড়তাম। পাঁচ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে এসেছি। কোনোদিন পিছনে ফিরে দেখিনি বা মনেও রাখিনি বিদ্যালয়টির কথা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে মধ্যম গোছের ছাত্র ছিলাম। তাই কারো চোখে ভালো আবার কারো চোখে খারাপ ছিলাম। যখন নবম শ্রেণিতে উঠলাম তখন মনে হলো বিজ্ঞান বিভাগে পড়বো।যথারীতি শ্রেণি শিক্ষকের কাছে প্রস্তাব দিলাম,স্যার আমি সাইন্সে পড়বো।
স্যার বললো,তুই বিএসসি স্যারের কাছে যা।
তাই গেলাম এবং বললাম, স্যার সাইন্সে পড়বো।
বিএসসি স্যার বললো,অংকে কত পেয়েছিস?
আমি বললাম,আটান্ন স্যার।
বিএসসি স্যার বললো,তোর ভাগ্য খারাপ; আর দুই পেলেই সাইন্স পড়তে পারতিস।
অনেক চড়াই-উৎরাই করে, এ স্যার-ও স্যারকে ধরে যখন হচ্ছিল না, তখন হেড স্যারের কাছে গিয়ে বিনয়ের সুরে বললাম, স্যার সাইন্সে পড়বো।কিন্তু সাইন্সের স্যাররা বলছে সাইন্সে পড়তে হলে অংকে ষাট পেতে হবে।
হেড স্যার মৃদু হেসে আমাকে কয়েকটি বীজগণিতের সুত্র ধরলো।
যাহোক উত্তরগুলো সঠিক দিয়েছিলাম। সাইন্স পড়ার অনুমতি পেয়ে যায়। আনন্দে মুক্ত মাঠের বাছুর গরুর মত নাচতে শুরু করলাম।
বছর ঘুরতে ঘুরতে দশম শ্রেণির ছাত্র হয়ে গেলাম।
প্রাইভেট পড়তাম, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেড স্যারের ছেলে পরিমল দাদার কাছে। পরিমলদার বাড়ি বিকেলে পড়তে যেতাম। গল্প গল্পে শুনেছি,পরিমলদা প্রেম করে বিয়ে করেছে।
বৌদি খুব সুন্দরী। গোপন চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকি। দেখতে দেখতে একদিন দেখা হয়ে যায় কামিনীর সাথে।
বৌদিরই ছোট বোন কামিনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। কামিনী দেখতে পরীর মত। পুজার সময় স্বরস্বতীর মত সেজে থাকে। আমি তাকে দেখার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করি। প্রতিদিন দৌড়াতে থাকি একই সময়,একই জায়গায়।
প্রাইভেট পড়া শুরু করলে পরিমলদা আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতে শুরু করে। তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আরো কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে পড়তে যাই। যেতে যেতে একদিন দেখতে পাই বৌদির সাথে , প্রাইভেট পড়ার রুমে কামিনী এসে হাজির। ফটফট কথা বলতে থাকে,দাদার কত ছাত্র,সবগুলা পড়ে তো নাকি দু’একটা হ্যাবলাও আছে?
কামিনীর ফটাস-ফটাস কথা শুনে আমরা হিহিহি করে হেসে ফেলি। তখন পরিমলদা ধমক দেয়,এই যা মাস্টার হয়িগিছ,তুই তোর পড়া পড়গা।
আমি বৌদির দিকে তাকাতেই চোখ পড়ে কামিনীর চোখে,আহ্ কী এক আকর্ষণ আমাকে স্বর্গে টেনে নিয়ে যাই । সেই থেকে ওকে দেখার জন্য,চোখে চোখ রাখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ি। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পথে অথবা বৌদির ঘরের দিকে প্রতিদিন এলোমেলো তাকাতে থাকি।
একদিন আমার ভাগ্য খুলে যাই। প্রাইভেট পড়তে গেছি সবার আগে। গিয়ে দেখি প্রাইভেট রুমের দরজা বন্ধ। ঠক-ঠক করে নক করি। দরজা খোলার পর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। ছোট লাল ওড়না গলায় জড়ানো ফুলগাছের মত মেয়েটি আমার সামনে দাঁড়ানো।
ঠিক যেন পূর্ণিমার চাঁদ কাছে পাই আমি। তখনই পকেট থেকে প্রাইভেটের মাসিক বেতনটা বের করে ওর হাতে দিই।
তখন মেয়েটি বলে,টাকা ক্যান?
আমি বলি,বেতন।
অমনি সজনে ডাটার মত হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নেয়।
আমি বলি,নাম কী তোমার?
ও বলে,কামিনী।
-কোন্ ক্লাসে পড়ো?
– ফাইভে।
তারপর কামিনী আর আমার সামনে দাঁড়ায় না। ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে ভিতরে চলে যায়।
আমরা বন্ধুরা সবাই পড়ার টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছি।
আজ একটু দেরি করে এলো পরিমলদা।
যখন এসে আমাদের সামনে বসল তখন তার পিছনের চুল থেকে চুয়িয়ে চুয়িয়ে এক’দু’ফোটা পানি পড়ছিল এবং এখনই দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছে,মুখ থেকে সে গন্ধও আসতে থাকে। আমরা মাথা নিচু করে খাতার উপর মনোযোগ সহকারে কলম চালাতে থাকি। বীজগণিতের সমাধান করতে থাকি।
বর্ষাকাল টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির মধ্যে আমি ভরদুপুরে পড়তে গেছি। বৃহস্পতিবার হওয়ায় স্কুল দুইটায় ছুটি হয়ে গেছে। আমি বাড়ি গিয়ে খেয়েই চলে এসেছি। বৃষ্টি হলে সাধারণত কেউ পড়তে আসে না। কিন্তু আমি প্রাইভেট পড়ার চেয়ে, অন্য একটানে পরিমলদার বাড়ি চলে যাই।
নিয়মিত যাওয়ার কারণে হয়তো পরিমলদা আমাকে একটু বেশি ভালোবাসে। আর একটি কারণে ভালোবাসতে পারে,সেটি হচ্ছে মাস শেষে আমি প্রথমেই বেতনের টাকাটা হাতে ধরিয়ে দিই এবং অন্যদের টাকা দেওয়ার জন্যও চাপাচাপি করি। অর্থাৎ বন্ধুদের মাসিক বেতনটা চাওয়ার জন্য আমিই থাকি। বৌদিও বিষয়টা জেনে, আমার প্রতি হয়তো আলাদা একটা টান থাকে। আমার মনে হয়,আমাকে একটু বেশীই ভালোবাসে বৌদি। আমারও ভালো লাগে,যখন তার ব্যক্তিগত দু’একটা বাইরের কাজও আমাকেই করতে দেয়।
যেমন, নজির এক দৌড়িয়ে এক প্যাকেট লবণ এনে দেও তো ভাই।
আমি ঠিকই পড়ার টেবিল থেকে উঠে একদৌড়ে পাশের দোকান থেকে লবণের প্যাকেটটা এনে দিই। এভাবেই বৌদির কাছেও প্রিয় পাত্র হতে থাকি।
আজও বৃষ্টিমাথায় পড়তে গেলে, দরজাটা খুলে দেই কামিনী। দরজা খুলে একটু ঠেকারি খুকি-খুকি সুরে বলে, দাদার এখনো খাওয়ায় হয়নি।
আমি বলি,তুমি খাইছো।
বিড়ালের মত হয়ে, আমার চোখে চোখ রেখে বলে খাবো এখন। এখন আর কামিনীর চঞ্চলা চটপটে ভাব চোখে পড়ছে না। মনে মনে পুলকিত হয়ে বলি,যাও।
কেন যেন টেনে টেনে কামিনী বলে,যা-য়।
আমি তো সুযোগ পেয়ে যাই। বলি,এখানে থাকো কেন?
-এখানে সবাই ভালো,ওইখানে দুষ্ট ছেলেরা আমাকে স্কুলে যেতে দেই না।
-ও তাই।
-হ্যাঁ সেই জন্য দিদি আমাকে নিয়ে এসেছে।
-এখানে ভর্তি হয়েছো?
– হ্যাঁ,(হাত উঁচু করে দেখিয়ে বলে) ওই স্কুলে।
-ওই স্কুল ভালোলাগে।
-খুব ভালো লাগে। সবাই খুব ভালো।
-আমিও ওই স্কুলে পড়তাম।
-আপনিও ভালো।
আমার কৌতুহল বেড়ে যায়।
কামিনীও যেন প্রজাপতির মত চোখের পাতা ঘনঘন ফেলে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই পরিমলদা চলে আসে।
দাদা এসেই বলে, কি ব্যাপার তুমি একা আইসছো?
আমি বললাম,জি।
দাদা আবার ভিতরে যেতে যেতে বলল, সবাই আসুক- একটু বসো।
এবার আমি একা হয়ে যাই। কামিনীও চলে গেছে।
হারাতে থাকি কল্পনার জগতে। স্বপ্ন দেখি আকাশে উড়ার। দূর আকাশে…
আমাদের বাংলার শিক্ষক একদিন জীবনন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করেছিল,
আমি যদি হতাম বনহংস
বনহংসী হতে যদি তুমি….।
শ্রেণিকক্ষে একদিন বিএসসি স্যার প্রশ্ন করলেন, ত্রিভূজের দুই বাহুর সমষ্টি অপর বাহু অপেক্ষা বৃহত্তর কে কে প্রমাণ করতে পারবা?
কয়েক জন হাত তুললো। সেই সাথে আমিও হাত তুললাম,পিছনের বেঞ্চ থেকে সাদা বকের মত নলি উঁচুকরা হাত।
বিএসসি স্যার আমাদের আলাদা করে ইউ প্যাটার্ণে বসালেন। এবং আমরা নিজ নিজ খাতায় ছবি এঁকে প্রমাণ করতে থাকলাম।
অপরদিকে অন্য ছাত্রদের স্যার জ্যামিতির ওই বিষয়টা বোর্ডে চিত্র এঁকে বোঝাতে থাকলেন। চলছে হাত এবং মেধা ও মনন এক্সপ্রেস গতিতে।
এক সময় আমাদের খাতাগুলো জমা নিলেন টেবিলে।
তারপর খাতাগুলো দেখতে দেখতে আমার দিকে তাকিয়ে, কাছে ডাকলেন। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে কাছে গেলাম,বানর যেমন যায় তার লাঠিওয়ালা মালিকের কাছে, সেভাবে পৌঁছালাম।
স্যার উঁনার পাশে আমাকে দাঁড় করায়ে, ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আমার খাতা উঁচু করে দেখিয়ে বললেন,চেষ্টা করলে সবই করা যায়,দেখো নজিরের খাতাটা দেখো!- সুন্দর করে চিত্র এঁকে প্রমাণও করেছে ভিন্নভাবে। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে আবার বললেন, নজিরকে আমিই বিজ্ঞান বিভাগে আসতে দিচ্ছিলাম না। অথচ ওর মনোবল ওকে শীর্ষে তুলে দিয়েছে। সবাই চেষ্টা করতে থাকো- বার বার অনুশীলন করো। দেখবে তোমরাও শ্রেষ্ঠ হচ্ছো বার-বার।
ধন্যবাদ দিয়ে স্যার চক-ডাস্টার টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেলেন। আমরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালাম। হঠাৎ যেন আমার গুরুত্ব আকাশ সমান বেড়ে যায় সহপাঠিদের কাছে। ফুরফুরে মেজাজে, ঝিরিঝিরি মনে, বাতাসের মত উড়তে থাকি নীল আকাশের কোলে।
সেদিন থেকে আমার মনোবল একশো ভাগ বেড়ে যাই। যেভাবে মাঠে পানি বাড়ার সাথে সাথে ধান বাড়তে থাকে,নিজেকে ডুবতে দেয় না; আমিও সেভাবে ধা-ধা করে বেড়ে উঠতে থাকি-প্রতিযোগিতায় সবার আগে থাকতে চাই।
মনে মনে বৌদি ও পরিমলদাকে ধন্যবাদ জানালাম-সালাম জানালাম।
বৌদি বটিতে মাছ কুটতে কুটতে, কাছে ডেকে বলে, অনেক ভালো করে পড়বা-অনেক বড় হবা। ততদিনে আমি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়ে গেছি। বৌদির মুখে চন্দ্রহাসি লেগে আছে,আমার খবর শোনার পর থেকেই। বলে, দ্যাখো তোমার দাদা কত ভালো মাস্টার। অর্থাৎ বৌদি বোঝাতে চায়,আরো ছাত্র নিয়ে আসবা।
আমি আরো বেগবান হই।
আবার কখনো কখনো ভাবি,বৌদি হয়তো কামিনীর বিষয়ে আমাকে নিয়ে ভাবে।-এই ভাবনাটায় আমাকে যেমন মনোযোগী করে তোলে,তেমন কামিনীর প্রতি দূর্বলতাও বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। বাড়তে বাড়তে আমি পাহাড় হয়ে যাই। আর সে পাহাড়ের পাঁজর কাটে নীরবে এক কিশোরী কামিনী রায়।
যে মেয়েটি বালিকা এবং আমি উঠতি বয়সী বালক মাত্র ।
যখন খেলবো বন্ধুদের সাথে,দৌড়াবো মাঠে-ঘাটে,আড্ডা দিবো দোকান-পাটে।
ঠিক সেই সময় আমি নীরব-নিরস পুতুল হতে থাকি। চিন্তায় মগ্ন থাকি বুদ্ধিজীবীর মত। খাতায়-খাতায় আঁকি-উঁকি করি। ছবি আঁকি কামিনীর। কবিতাও লিখি দু’চার লাইন,
তুমি আমার চন্দ্রবালিকা-তুমি আমার নীরব সাধনা।
একদিন বন্ধুরা দল বেঁধে আমার কাছে এসে দাবী জানালো,আন্দোলন করতে হবে-প্রয়োজনে মিছিল করতে হবে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,কেন-কি কারণে?
ওরা সমস্বরে বললো,স্কুলে গণিতের স্যার নিয়োগ দিবে,আমরা দাবী করবো পরিমলদাকে নিয়োগ দিতে হবে।
আমি মনে মনে আনন্দে আন্দোলিত হয়ে উঠি,হ্যাঁ ঠিকই তো!- চল্ যাই, আগে হেড স্যারের কাছে গিয়ে বলি।
হ্যাঁ-হ্যাঁ উচ্চারণ করে সবাই, মাঠে গঁজানো কচিধানের মত একসাথে হাত তোলে।
গেলাম হেড স্যারের কাছে বললাম,স্যার পরিমলদাকেই নিতে হবে।
স্যার অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন,বাবা তোমরা আমার কাছে এসেছো, খুব ভালো-খুব ভালো। কিন্তু বাবা-রা,আমার যে কিছু করার নেই। নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর আমিই করি। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা,সভাপতি ও এমপিদের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই যে?
আমরা একসাথে বললাম,স্যার আমরা সবাই মিলে ওই নেতার কাছেই যাবো।
স্যার থামিয়ে দিয়ে নরম সুরে বললো,তোমরা যাবে তো,গেলে ওরা আমাকেই দোষারোপ
করবে- বলবে,আপনি কেমন শিক্ষক যে, ছাত্ররা আপনার কথা শোনে না।
আমরা হেডস্যারের শান্ত ও নরম কথায় থামলাম না।
চালাতে লাগলাম আমাদের আন্দোলন। দাবী একটায়, পরিমলদাকে নিয়োগ দিতে হবে।
এভাবে দু’মাস হয়ে যায়। আমাদের নির্বাচনী পরীক্ষাও হয়ে যায়। এরপর এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। তাও করতে থাকি আন্দোলন।ঝড়ো-বৃষ্টির গতি আমাদের আন্দোলনে।
হঠাৎ একদিন বউদি আমাকে বললেন, সকলকে সঙ্গে নিয়ে আসবা তো নজির।
আমরা জোটবেঁধে গেলাম সেখানে। এই প্রথম বউদি নেত্রীর মত আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন- বললেন,তোমাদের আন্দোলন করতে হবে না। তোমাদের দাবী মেনে নিবে, তোমাদের দাদাকেই নিয়োগ দিবে। তোমরা বাড়ি গিয়ে পড়াশুনায় মনোযোগ দাও-গা।
বৌদির কথা বলার সময় তার পাশে ফুলপাখির মত নীরবে ও মলিন মুখে দাঁড়িয়েছিল কামিনী।
আমরা জয়ের আনন্দে খোশমেজাজে জয়-ধ্বনি করতে করতে যার যার বাড়িতে চলে আসি।
টেবিলে বসি। পড়ার কথা কিছুক্ষণ ভুলে থাকি। খাতার পাতায় ছবি আঁকতে থাকি কামিনী ফুলের ছবি। যে ফুলের মৌ মৌ সুঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকে সারারাত।
@@@
সূর্যটা অতিদ্রুত উঠলো আর তারচেয়ে দ্রুত ডুবলো। কবে, কখন উঠলো আর কখন ডুবলো টেরই পেলাম না হায়!
সময় তো কারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের জন্যও করেনি। এসএসসি পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে বিদ্যালয়ে প্রতিবছরের মত পরীক্ষার্থীদের বিদায় এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে আগতদের বরণের জন্য বিশাল অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। মঞ্চে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত রয়েছেন। প্রধান শিক্ষক মহোদয় স্বাগত বক্তব্যে আমাদের সম্পর্কে আবেগঘন বক্তব্য রাখলেন,নিজেও চোখ মুছলেন এবং আমাদের কাঁদালেন। তিনি এসএসসি পরীক্ষার হলে প্রবেশপত্রসহ কিভাবে উপস্থিত হতে হবে, কক্ষপরিদর্শকদের সাথে কিভাবে ভালো আচরণ করতে হবে তাদের পরামর্শগুলো মনো যোগ দিয়ে শুনতে হবে ইত্যাদি বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিলেন।
তারপর ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন,এই বিদ্যালয় বড় পবিত্র স্থান,মসজিদ-মন্দিরে মানুষ যায় প্রার্থণা করতে আর বিদ্যালয়ে শেখানো হয় কিভাবে প্রার্থণা করতে হয়। অর্থাৎ বিদ্যালয় প্রার্থণালয় থেকেও কোনো অংশে কম নয়। তাই তোমরা আচার-আচরণ,ভদ্রতা, প্রার্থণা করার নিয়মসহ দেশ প্রেম শিখবে এখানেই।
সকলের বক্তব্য শেষে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু বিদায়ী পুরস্কার দেওয়া হল শিক্ষক মহোদয়দের। আর শিক্ষক মহোদয়রা আমাদেরসহ ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের পুরস্কার দিলেন।
এরই মাঝে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং সদস্যরা আলাপ করছে, প্রধান শিক্ষক এইসব ছেলেমেয়েদের প্রশংসা করলেন; এরা আন্দোলন করছে আমাদের বিরুদ্ধে। আর একজন বললো,চুপ থাক্; চলে যাক সব জঞ্জাল।
কিছু কানে গেল, আর কিছু গেল না।চারদিকে গুণগুণ শব্দ হচ্ছে।
আজকের দিন আমাদের বড় কষ্টের দিন-দুঃখের দিন। আর আমাদের অভিভাবক প্রতিনিধিদের সুখের দিন। মনে বড় খটকা লাগলো,তাহলে কী আমরা চলে গেলে,পরিমলদাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ দিবে?
মনে মনে বিভিন্ন ধরনের হতাশা কাজ করছে। এর মধ্যে চলছে শেষ বিদায়ের পালা। স্যারদের পা-য় সালাম করে বিদায় নিচ্ছি।
পিছন ঘুরতেই দেখি, আমার গা-ঘেষে সামনে দাঁড়িয়ে কামিনী। উহ্ কী যে আনন্দ আমার মধ্যে,রঙে-রঙে পুলকিত হয়ে ওঠে মন-রঙধনু আকাশি মন আমার!
অনুষ্ঠান শেষে চাঁদের মত কামিনীর হাতে ছিল ফুলের তোড়া। শিক্ষক মহোদয়গণ, এই পুস্পমাল্য নবীনদের প্রত্যেককে দিয়ে বরণ করেছেন ।
সেই বরণমাল্যটি আমার হাতে দিয়ে কামিনী ঠোঁট জড়িয়ে, নদীর ঢেউ খেলানো হাসি দিয়ে, দ্রুত আমার সামনে থেকে চলে গেল।
আমি চেয়ে থাকি তার পায়ে পায়ে ছন্দ তুলে হেঁটে যাওয়ার পথে। মনে হচ্ছিল কেন যে বিদায় নিলাম? কিন্তু জীবন গড়ার জন্য বিদায় নিতেও হবে, যেতেও হবে ভবিষ্যতের পথে হাঁটার জন্য।
তাই ধীরে ধীরে আহত পাখির মত, অনেক কষ্টে,অনেক স্মৃতি পিছনে ফেলে, বিদ্যালয় চত্বর থেকে বিদায় নিলাম।
@@@
এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমরা বেশীর ভাগ ছেলেমেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য জেলা শহরে এসে, মেসে উঠেছি।-কোচিং এ ভর্তি হয়েছি। কোচিংএর পড়ার গতি প্লেনের মত-দ্রুত বিমানবন্দরে পৌঁছানোর গতি।
একদিন স্থানীয় একটি পত্রিকা দেখতে দেখতে চোখে পড়লো, আমাদের গ্রামের খবর
“সংখ্যালঘু একটি পরিবার রাতের আঁধারে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে” শিরোনাম পড়েই খবরটা পড়তে শুরু করলাম। মনের ভিতর টান-টান উত্তেজনা কাজ করছে।
পরিমল রায় স্বপরিবারে ওই রাতে,ঘরের পিড়িতে ল্যাম্প জ্বেলে রেখে চলে গেছে। নজির নামের এক শিক্ষার্থীর কাছে পরিমল রায়ের গৃহিনী একটি আবেগপূর্ণ পত্র লেখে রেখে গেছে।
আমি তখনই বাড়ি রওনা হলাম। দুই ঘণ্টার পথ।
গ্রামে এসে বাড়ি না গিয়ে পরিমলদার বাড়ি গেলাম। তখন মার্চ মাস চলছে। পাতা ঝরার দিন। স্বাধীনতার মাস-নতুন জীবনের জয়-গান। নতুন পাতা গজানোর সুরধ্বনি প্রকৃতির ডালে ডালে। কষ্টগুলো বাড়তে বাড়তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে স্থানীয় এক লুকাল পত্রিকার সাংবাদিকের কাছে চিঠিটা পেলাম। তবে উনি ফটোকপি রেখে দিলেন।
আমি পড়ছি, চোখের পানি ছলছল করছে–
ভাইডি আমার,
তোদের বললাম আন্দোলন করবি না। তোরা হয়তো আমাদের ভালো চেয়েছিলি। কিন্তু নেতারা তো ভালো চায়নি। তারা গুটি কয়েক লোক আমাদেরকে রাতের আঁধারে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছিল। সে কারণে তোদের আন্দোলন করতে বাঁধা দিয়েছিলাম। শেষমেষ যা ভেবেছিলাম তাই হলো।
আমি জানতাম সব দোষ আমাদেরই হবে। কারণ,আমার বাবা-দাদারা সেই গ্রামের কিছু লোকের জন্য দেশ ছেড়েছে। তারা আমাদের পুকুর-জমি-বাগান দখল করার জন্য প্রতিরাতেই ভয় দেখিয়ে যেতো। আমি আর তোদের পরিমলদা তখন রাজবাড়ি কলেজে স্নাতকে লেখাপড়া করছিলাম। দেশের সিংহরাজা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেললে,তারা আনন্দ করেছে,মিছিল করেছে,পিকনিক করেছে,লিফলেট ছড়িয়েছে। সবই আমাদের বাড়ির চাল-ডাল-ছাগল দিয়ে।
বাবা প্রতিবাদ করেছিল,চাল-ডাল নি-যাবি, যা; বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বাজে কথা বলবি না। সে রাতেই বাবাকে মেরে পঙ্গ করে দিয়েছিল ওরা। দাদারা পালিয়েছিল।
তারপর আমার উপর নজর পড়ে। সে রাতেই ভয়ে আমি, তোদের পরিমলদার হাত ধরে মেহেরপুরের এই গ্রামে এসে, বসবাস করতে থাকি। আমি চলে এলে তাদের চোখ পড়ে,আমার ছোট বোন কামিনীর উপর। বিখ্যাত রায় পরিবারের সম্মান আমাদের কামিনী। আমি তাকে নিয়ে আসি। তারপর বাবা ও দাদারা সব ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়। অভিজ্ঞতা থেকেই তোদের বলেছিলাম, আন্দোলন করা দরকার নেই।
আমি জানি, এই গ্রামের নব্বই ভাগ মানুষ আমাদের ভালো বাসে। বাকি দশভাগ চরিত্রহীন-স্বার্থবাদী মানুষের জন্য আমাদেরও চলে যেতে হলো। এ চিঠি দেখলে হয়তো সবাই গল্প ভাববে। আসলে গল্প নয়, আমাদের জীবনের সত্য ঘটনা। ভালো থাকিস ছোট ভাইডি আমার–
ইতি
। তোদের বৌদি।
বৌদির চিঠি পড়ে মাটিতে বসে-বসে, হাউ-মাউ করে কাঁদছি। কাকে ধরবো,কী বলবো-কোনো ভাষায় খুঁজে পাচ্ছি না।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।