কর্ণফুলির গল্প বলায় আনোয়ার রশীদ সাগর (শেষ পর্ব)

বিনিময়

বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই-ঝরঝর-ঝর্ঝর। ছাগলের খোয়াড়ে ধাড়ি ছাগলটা ভ্যাঁভ্যাঁ ডেকেই যাচ্ছে।সারাদিনের মেঘের কান্নায় ভিজে গেছে মাঠ-ঘাট-উঠোন। ঘাসপাতা কিছুই নেই। ক্ষুধার্ত ছাগলটি ক্ষুধার জ্বালায় ডাকছে, নাকি ডাক এসেছে বুঝতে পারে না জরিনা।
সেই যে তিন দিন হয়ে গেলো করিমের বাপ বাড়ি ফেরেনি। ঘরের চাল-ডালও কয়দিনেই ফুরিয়ে গেছে।
করিম ফ্যানে-ভাতে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। পাশেই জরিনা হাওহুতাশ করতে থাকে,কবে কখন ফিরবিনি লোকটা।
ভোর হয়,দুপুর হয় আবার রাতও ফিরে আসে শুধু ফেরে না করিমের বাপ, লোকটা জাল নিয়ি মাছ মারতি গেছে তো-গেছেই।
মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাপড়ের এককোণা মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে, চেটে চেটে ভিজিয়ে ফেলেছে করিম। করিমের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে জরিনার বুকটা হুহু করে ওঠে,কনে পায় দুমুঠো ভাত? কোনো কুল-কিনারা না পেয়ে পাশের বাড়ির সলিমের মা’র কাছে দৌড় দেয় মধ্যরাতে, দুমুঠো ভাতের জন্য। ঘরের তো দরজা নেই। খোলা ঘরবাড়ি। শুধু মোটা মাটির দেওয়াল রয়েছে। উপরে খড়ের ছাওনি।
ফিসফিস বা টিপটপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। শ্রাবণের শেষের দিকের ঘটনা। ওদিকে করিম একাই ঘরে আছে, ঘুমিয়েও গেছে।
জরিনাও তো সে ঘরে ফিরতে পারে না। দেরি হয়, অনেক দেরি। আজ আর ধাড়ি ছাগলটা ডাকছে না। চারিদিকে চুপচাপ নীরবতা। শুধু গাছের পাতা থেকে দুয়েক ফোটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ হতে থাকে। সে বৃষ্টির সাথে মিষ্টি বাতাস বইছে নিঃশব্দে।
এভাবেই কেটে যায় দু’সপ্তাহ। করিমের বাপও বাড়ি ফেরে না। বাড়ি ফেরে না সলিমের মাও।
সলিমের মা নাকি সলিমকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। সে কথায় প্রথম রাতে জরিনাকে বলেছিল সলিমের বাপ।
ও বাড়িতে সলিমের বাপ একা আর এ বাড়িতে করিমের মাও একা।
মাঝখানে একটা বেড়া ছিল। সে বেড়া বৃষ্টিতে পচে-গলে পড়তে থাকে।
এক সময় ফাঁকা হয়ে যায়। দু’বাড়ির সীমানা ছিল বোঝা যায় না। পাতার বেড়ায় ঘেরা প্রাচীর পচে-গলে গেছে যেন কয়েক দিনেই।
আজ সকালে খবর আসে, করিমের বাপ সলিমের নানী গিয়ে বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। বৃষ্টির মধ্যেও টিনের ছাপড়া দিয়ে ভিজে ভিজে সলিমের মার সাথে ঘর তৈরি করছে। সে ঘরের জমিটুকু সলিমের নানীই দিয়েছে।
কেন জমি দিলো এ প্রশ্ন আর করিমের মা করে না। আবার সলিমের বাপও সলিমের মা’র খোঁজ নেয় না।
এ সব খবর পাড়া-প্রতিবেশীদের কানাকানিতে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
কানে শুনে,নীরবে করিমের মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। মাজায় আঁচলের অংশ শক্ত করে জড়িয়ে বেঁধে নেয় এবং ধাড়ি ছাগলটার গলায় দড়ি দিয়ে টেনে হিছড়ে নিয়ে যায় পাশের বাড়ির পাঠার কাছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।