T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় অম্লান রায় চৌধুরী

প্রেডিকশন

তোমার নিশ্চয়ই আজকে অফিসে কাজের চাপ আছে, তাই না ? ফিরতে নিশ্চয়ই রাত হবে — বলেই তিথি চলে গেলো নিজের কাজে । প্রত্যয়, ঠিক অফিস বের হওয়ার মুখে শুনল কথাগুলো, একটু থমকে গেলো, বলল, কী করে বুঝলে তুমি ? আমি তো তোমায় কিছুই বলিনি – আজকের জরুরী মিটিঙ্গের কথা ।
তিথি ডাইনিং টেবিলে গুগুলের স্কুলের টিফিন রেডি করতে করতে বলল, কেন এটাই তো হওয়ার কথা, তুমি বুঝলেনা । তোমার মুখে বলার প্রয়োজন হয়না । এটা আমার বোঝা, বলতে পারো চেনা ।
প্রত্যয় একটু রাগত ভাবেই বলল, এতই যদি চিনতে পারো তাহলে আর বলো কেন । বুঝতে পারলে তো বোঝানর কোনও প্রয়োজন হয়না — বলেই চলে গেলো । কথাও বাড়ালনা । বোধ হয় অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে ।
তিথি যথারীতি ওর কাজ সেরে গুগুল কে নিয়ে স্কুল ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেড়িয়ে পড়ল স্কুল বাসের অপেক্ষায় —ঠিক ওদের কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তাটাতে । বাসে তুলে তিথি নিজেদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে যাবার মুখে দেখা কেকার সাথে । কেকারা থাকে ওদের ঠিক উপরের ফ্ল্যাটটাতে । কেকাও ওকে দেখে কাছে এলো । তিথিকে দেখে জিজ্ঞাসা করল , আরে আজকে তোমার মা’র বাড়িতে যাওয়ার কথা না , তোমার ছোট বোনের তো পাকা দেখার দিন। তিথি মাথা নেড়ে বলল , হ্যাঁ , সকালেই যাওয়ার কথা ছিল , যদিও মূল অনুষ্ঠানটা বিকালে কিন্তু গুগুলের ক্লাস টেস্ট চলছে আর নিজেরো কিছু কাজ, সব মিলিয়ে বিকালেই যাবো বলে ঠিক করেছি ।
হাঁটতে হাঁটতে লিফট ধরে নিজের ফ্ল্যাটে এলো তিথি । এবার সংসারের কাজ শুরুর আগে বেশ বড় করে একটা চা বানিয়ে খাবে । এটা ওর বহুদিনের অভ্যাস । নানান চিন্তা নিয়ে ও চা খাওয়াটা ঠিক ওর পছন্দ না। এটা ওর কাছে একটা লাক্সারী । চায়ে চুমুক দিয়েই ও প্রত্যয়ের কথা ভাবতে আরম্ভ করল । এই প্রত্যয়কে ওর চেনা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে । সাধারণ একটি ছেলে, সাধারণত্ব বোঝা যায় । আর পাঁচটা ছেলের মতন নয় । যেমন ঘাটতি মেধায় , তেমনই এক আনইম্প্রেসিভ চেহারা । কথায় বার্তায় বড্ড শেকি । পুরো কথাটা গুছিয়ে বলতে পারতোনা । অনেক সময় একটা গোটা বাক্য পর্যন্ত শেষ করতে পারতোনা । সেই প্রত্যয়ের প্রেমে পড়ল তিথি । এখন ভাবলে নিজের উপর রাগ বা ক্ষোভ কোনোটাই হয়না , যেটা হয় সেটা হলো এর সঠিক কারণটা আজ অবধি বার করতে না পারার জন্য – এক জিজ্ঞাসা ।
প্রেম নাকি হয়ে যায়, বোঝা যায়না । কেমন ভাবে হয় সে নিয়ে পন্ডিতদের বিস্তর লেখা লেখি আছে অত শতর মধ্যে না গিয়ে আমরা তিথির বক্তব্যটা একটু শুনি । এতদিন বাদে তিথি বুঝতে পারে যে প্রত্যয়ের সেই সময়কার চোখে মুখে ফুটে ওঠা এক সারল্য পনা ওর কাছে একটা জায়গা করে নিয়েছিল কিনা – সেটাই ভাবার বিষয় । যদি সরলতাই ওর প্রতি আকর্ষণের মুল কারণ হয় তাহলে কিছু প্রশ্ন ওর নিজেকেই করতে হবে ।
সরল মানে সাধারণ ভাবে খোলা মেলা, গোপনীয়তাকে এড়িয়ে চলে । যারা গোপনীয়তা এড়িয়ে চলে, যদি বোঝা যায়, তাদের ভিতরটা দেখতে পাওয়া যায় । তিথির কাছে এই ভিতর দেখতে পাওয়া মানুষদের নিয়ন্ত্রন বা নিজের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করে কিনা বা সেটাই ওর চাওয়া ছিল কিনা, সেটাই ওকে ভাবাচ্ছে ।
তিথি বুদ্ধিমতী মেয়ে । ওর চাওয়া ও বুঝতে পারে । কেমন ভাবে চাওয়াটাকে পাওয়ায় কনভার্ট করতে হয় সেটাও ওর জানা। কাজেই উপরোক্ত কারণটাকে ও উড়িয়ে দিতে পারছেনা । আসলে এই প্রায় দশ বছরের দাম্পত্য জীবনে ওকে এই সমস্যায় কখনো পড়তে হয়নি যেমনটা ও আজকে বা ইদাণীং যেন একটু একটু করে উপলব্ধি করছে । প্রশ্ন জাগছে – ওর প্রভাবের টেরও পাচ্ছে আর পাচ্ছে বলেই প্রত্যয় বড় বেশী প্রেডিক্টেব্ল হয়ে উঠছে ওর কাছে । এটা আজকের সমস্যা।
যাই হোক ওদের প্রেম একটা হলো । বেশ নিবিড়ও হলো । প্রত্যয় মফস্বলের ছেলে হয়েও তিথির শহুরে ভাবনাগুলোকে নিয়ে বেশ মানিয়ে চলছিলো । আসলে প্রত্যয়ের বেড়ে ওঠাটার সাথে তিথির একেবারেই কোনও মিল ছিলোনা – সেটা তিথি বুঝত । কিন্তু তিথির মনের ভিতর একটা মানসিক চাহিদা ছিল গড়ে পিঠে মানুষ করার প্রবণতা । কারণ তিথির এটা ভালো লাগে । ও আনন্দ পায় । এটাই যদি তিথির প্রেমে পরার একমাত্র কারণ হয় তাহলে বলতে হবে যে নির্বাচনে কোনও ভুল ছিলো না । কারণ প্রত্যয় সেদিক থেকে একেবারেই আদর্শ । তার চলনে বলনে সরলতার থেকেও যেটা বেশী ছিল সেটা হলো বাধ্যতা । তিথির কাছে এটাই সব চাইতে আকর্ষণীয়। যার উপর দাঁড়িয়ে তিথির প্রেমে পড়া । যদিও কারণ টাকে এখন তিথি এভাবে ব্যাক্ষা করতে পারে , কিন্তু তাহলেও মনে কিছু একটা দ্বীধা বা দ্বন্ধ লেগেই থাকে । যেটা যাচ্ছেনা ।
এই ভাবনার রেশ চরমে যাওয়ার মুখেই বাড়ির রান্নার মাসীর ডাক । রান্নার ব্যবস্থার তদারকি করা। কী রান্না হবে জিজ্ঞাসা করাতে তিথি বেশ সপ্রতিভ হয়েই বলল , আজকে একটু বিউলির ডাল করো , কালকেই প্রত্যয় বিউলির ডালের কথা বলছিল , আর পারলে ফ্রীজে থাকা মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি ঘন্ট করো , অনেক দিন ধরে প্রত্যয় মুড়ি ঘন্ট দিয়ে একটু ড্রিঙ্ক করবে বলছিলো । এই নজরগুলো , যদিও স্বাভাবিক তবুও প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে একটু আলাদা । যেমন প্রত্যয় বিয়ের আগে কোনোদিন ছোটো মাছ , যেমন মৌরলা , পুঁটি কিংবা ট্যাংড়া খেতো না কিন্তু বিয়ের পরে তিথির সাহচর্যে এখন এই মাছের ভীষণ ভক্ত । এগুলোও স্বাভাবিক – যে কোনও সুস্থ দাম্পত্য জীবনেই দেখা যায় । কিন্তু তাহলেও তিথির কাছে আজ এগুলো বেশী করে মনে পড়ছে – কারণ ও চাইছে ওর প্রেমে পড়ার আসল কারণটা খুঁজে বার করতে । তিথি এতদিন ধরে প্রত্যয়ের প্রতিটা ভালো লাগাগুলোকে , ভালোবাসা গুলোকে জেনেছে , উৎস খুঁজেছে, বেশ কিছু পরিমার্জন করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্ধনও করেছে এবং দিন কে দিন ধরে দেখেছে যে সেগুলো যথাযথ ভাবে পালিত হচ্ছে । এটা তিথির ভালো লাগা আরও বাড়িয়েছে , ও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে , ক্রমশই এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজের সময় কাটিয়েছে আর নিজেকে জয়ী বলে মনে মনে আনন্দ পেয়েছে ।
তিথির জানা , প্রত্যয়ের সুন্দরীদের উপর একটা দুর্বলতা আছে । তাদের দেখলে ও একটু বেশীই বিহ্বল হয়ে পড়ে । এটা তিথি বেশ এনজয় করতো । মিলিয়ে নিতো যেভাবে ও চেয়েছে সেভাবে হচ্ছে কিনা। বেশ মনে পরে এক অনুষ্ঠানে প্রত্যয় তিথিরই এক বান্ধবীর সাথে কেমন অবলীলায় ফ্লার্ট করছে । সারাটা পার্টি প্রত্যয় কাটালো ঐ মেয়েটির সাথে । যাবার সময় আবার বলেও গেল পরের বারে দেখা হওয়ার জন্য । এগুলো যদিও সবই অবশ্য বেশ কয়েকটা ড্রিঙ্কের পরে । কিন্তু এই পরিস্থিতিটা তিথি যেন চাইছিলো – ওর এই নিজের প্রভাবের আনন্দটা এতটাই তীব্র ছিলো যে ঐ বান্ধবীর সাথে যদি কোনও কিছু ঘটনাও ঘটে যায় তাতেও ওর কিছু যায় আসবেনা – কারণ ওর কাছে ওর নিজের গড়ার প্রভাব, প্রত্যয়কে জানার প্রভাব এতটাই মারাত্মক ।
প্রত্যয়ের, তিথির বাড়ির অনেককেই ভালো লাগতোনা , বিশেষত তিথির মাকে – সেটাকে কখনো তিথি শুধরে দেওয়ার চেষ্টা না করে বেশ কিছু লক্ষণ রেখা বেঁধে রেখেছিলো – যেমন বাড়ি গিয়ে কোনও রকমের অসভ্যতা করতে পারবেনা , সকলের সাথে কথা বার্তা বলবে স্বাভাবিক ভাবে মনে তোমার যতটাই ক্ষোভ থাকনা কেন – কিন্তু কখনোই মনের ক্ষোভটা কেন বা সেটা থেকে বেড়িয়ে আসা যায় কিনা সেটা নিয়ে কোনও আলোচনা করবেনা । এভাবে প্রত্যয়কে বোঝানোর চেষ্টাও করতনা । আশ্চর্য এই পরিমার্জনের প্রতিটা স্টেপ প্রত্যয় অনুসরণ করেছে – এটাতেই তিথির আনন্দ । ওর মার সাথে সম্পর্ক খারাপ কি ভালো সেটাতে তিথির কোনও হেলদোল নেই – খালি ও দেখেছে প্রত্যয় ওর কথামতন চলছে কিনা।
এগুলো তিথির কাছে ছিল এক চরম পাওয়া । ওর দিনও কাটতো এই ভেবে যে আজকে প্রত্যয় কতটা ওকে অনুসরণ করেছে , কতটা ওর মতন চলেছে । প্রত্যয় ভালো ছাত্রের মতন সেই ভাবেই চলছিল এবং তিথিকে আনন্দ দিচ্ছিল । প্রত্যয় এই বিষয়টা বুঝতো কিনা সেটা অবশ্য তিথি কোনো দিন যাচাই করে দেখেনি । সমস্যাটা এখানেই শুরু সেটাও তিথি বুঝল সেদিন ।
প্রত্যয় আসলে ধীরে ধীরে তিথিকে খুব ভাল করে বুঝে গেছিল । ওর দুর্বলতা গুলোকে অন্য ভাবে কাজে লাগাতে শুরু করল । তিথির কথার মান্যতা দিয়েই তিথির সাথে অনেক কিছুই শেয়ার করা বন্ধ করে দিলো । এই শেয়ার করাটা ছিল ওর নিত্যদিনের হোম টাস্ক যেটা তিথির কাছে দিতে হতো। ওর এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স বেশ কিছু দিন হলো ডেভেলাপ করেছে – যেটার সম্পর্কে তিথির জানা নেই কারণ এটা প্রত্যয় গোপন করেছে যদিও তিথির এ বিষয়ে সেরকম আপত্তি ও কোনোদিন দেখেনি । বরংচ সুন্দরীদের প্রতি ওর আকর্ষণ আছে সেটা তিথির জানা । এর সাক্ষী ও বহুবার হয়েছে । কিন্তু ধরা পড়ল প্রত্যয়ের অফিস ট্যুর থেকে ফিরে আসার পরে – ওর মোবাইল দেখে এবং ব্যাগে কিছু লেডিস পারফিউম দেখে। তিথি আঘাত পেলো এই ভেবে যে প্রত্যয় এমন কিছু করেছে যেটা ওর অজানা বা যার জন্য ও প্রত্যয়কে আগে শিক্ষা দেয়নি । এই আঘাতটা ও নিতে পারলোনা । প্রত্যয় যে এখন আনপ্রেডিক্টেব্ল সেটা বুঝতে পারলো । তিথি প্রত্যয় কে কিছুই বললনা । সব জেনে শুনেও নিজেকে সংযত রাখলো । ভাবলো ওর শিক্ষার বোধ হয় সমাপ্তি । বুঝতে পারছেনা তিথি এটাকে ওর পরাজয় বলবে না কি এক সফল গুরু বলবে । এই দ্বীধায় ও বেশ চিন্তান্বিত । খানিক্ষুণ চুপ করে থেকে বলল , দেখো প্রত্যয় আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যে আমি যা চেয়েছিলাম সেটা পাওয়ার দিন শেষ । আমাকে এখানেই থামতে হবে কিনা আমার জানা নেই তবে আমি গর্বিত এটাও ঠিক । গুরু হওয়ার সম্মানটা তো পেলাম । এটা কম কিসে।
তিথির হাব ভাবে প্রত্যয় বুঝল সবকিছুই । নিজের থেকেই বলল, দেখো তিথি আমার জীবনের সব পরিবর্তনেই তোমার অবদান । আমার বেড়ে ওঠাটাতেও তোমার অবদান সব চাইতে বেশী । আমি অবজ্ঞা করছিনা । কিন্তু আজ নিজেকে খুলে দেবার কথা মাথায় এলো । তোমার শিক্ষায় এটা বুঝেছি যে নিয়ন্ত্রনেরও একটা আনন্দ আছে এবং সেটা যদি নিজের উপর নিজেরই হয় তাহলে বোধ হয় আনন্দের মাত্রাটা অনেক বাড়ে। সেই বেড়ে যাওয়াটাটার স্বাদ আমি পেয়েছি ।
তিথি আনন্দও যেমন পেল তেমনই পেলো এক অখন্ড অবসর মাথা থেকে প্রত্যয়ের জীবনের উপর প্রেডিকশনের প্রহর গোনা থেকে নিস্কৃতির ফলে ।
এই দোলাচল ওর মানিয়ে নেওয়া এবং সাংসারিক জীবনে প্রেমের বন্ধনে কিভাবে চলবে – তাই ভাবছিল। প্রত্যয়ের কথায় চমক ভাঙ্গল, দেখলো প্রত্যয় হাতে দুটো আইনক্সের টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । বলল, ডিনার টা বাইরে করার ইচ্ছা ।
বাড়ির মাসীকে বলে দাও আজ একটু রাত অবধি গুগুল কে পাহারা দেবে।
ওরা দুজনে কাছে এলো, জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল । সামনে তখন সূর্যাস্তের লাল আভায় বেশ ঠান্ডা আমেজ । ঘুরে গেলো ওরা, জানালার পর্দাটা ঝাপটা মারছিল দুজনকে । কখনও প্রত্যয় কে বা তিথিকে – একে অপরকে মাঝে মাঝেই আড়ালে যেতে হচ্ছে পর্দার ঝাপটায় ।
তিথি তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে ফোন করল কাজের মাসীকে – নিশ্চিত করল গুগুলের পাহাড়া ।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।