ক্যাফে গল্পে অমিতা মজুমদার 

নাইওর

নাইওর কথাটা শুনলেই মন চলে যায় অর্ধশতাব্দী বা তারও কিছু আগে।

নাইওর যাওয়ার অপেক্ষা বা প্রতীক্ষা যেন একটি মেয়ের জীবনের সবচেয়ে আনন্দ প্রাপ্তি বা বেদনার অবসান।

একহাত ঘোমটা মাথায় দিয়ে স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি আসা কিশোরী  মেয়েটি যেদিন জানতে পারে সে তার বাপেরবাড়ি নাইওর যাবে এই শ্রাবণে খাল-বিল যখন জলে টইটম্বুর হবে তখন।বাড়ির খোলা ডিঙ্গি নৌকায় কাপড় বেঁধে আড়াল করে স্বামীর আনা নতুন শাড়ির পাট ভেঙে পরে নৌকায় পা রাখবে তখন তার বুকের মধ্যে যেন হাজার বাতির আলো জ্বলে উঠবে।শ্বশুরবাড়ির চেনা পথ ছাড়িয়ে একটু দূরে গেলেই মাথার ঘোমটা ফেলে কাপড়ের পর্দা সরিয়ে বাইরে আসবে। চারিদিকে দেখবে অবাক বিস্ময়ে! যে হিজলগাছটা দেখেছিল ছোট্ট চারাগাছ সে কেমন খালের জলে লালগালিচা বিছিয়েছে তার ফুলের সমারোহ দিয়ে। নদীতে হঠাৎ ভেসে ওঠা শুশুকটাও যেন তার কুশল জানতে চাইছে।মনে মনে নিজের বাপেরবাড়ির ছবিটা দেখতে চাইছে উদাসচোখে। খেলার সাথিরা কি সবাই আছে না তারাও চলে গেছে শ্বশুরবাড়ি। ছোট্ট কুকুরছানাটা কত ন্যাওটা ছিল তার,সে কি চিনবে তাকে! মা কি আর একটু বুড়িয়ে গেছে! ঠাম্মার শরীরটা কি আগের মতো আছে! এবারে গেলে আমসত্ত্ব,আচার,নাড়ু, নারকেলের তক্তি কি পাওয়া যাবে পাশের বাড়ির সুন্দরঠাকুরণের কাছে।এরকম কতশত ছবি দেখতে দেখতে তার নৌকা ভিড়ে বাপেরবাড়ির ঘাটে।

মাসখানেক সময় কেটে যায় ঘুড়ির সুতায় ভর করে।একসময় সুতো কেটে ঘুড়ি ভো-কাট্টা হয়ে যায়।কিশোরী মেয়েটিও আবার বাপেরবড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি নাইওর যাবার প্রস্তুতি নেয়।

মনটা যে আজকাল দুভাগ হয়ে গেছে। বাপেরবড়ি বসে কেন যেন শ্বশুরবাড়ির জন্য মন কেমন করে।

তাই বাবা যখন বলে মা-জননী এবারতো তোমায় ফিরে যেতে হবে,মেয়ে আর জোর করে না বাপের উপর।বাপ মোক্তার মাঝির টাবুরে নৌকা ঠিক করে।

পরেরদিন সূর্য ওঠার আগে নদীর জোয়ার ভাটার হিসেব করে মোক্তারমাঝি উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ে।কইগো মাঠাকুরণ এবার যে রওয়ানা দিতে হয়,নইলে উজান গাঙে নাও বাইতে পারুম না।

মায়ের দেওয়া মুড়ি-মুড়কি,চিড়া খই,গুড় আরও হরেকরকম পোটলাপুটলি নৌকায় তোলে মাঝি।ছোটো ভাইবোনেরা দৌড়ে দৌড়ে নারকেল,আম,কাঁঠাল সব তুলে দেয়।সকলের চোখে জল মুখে হাসি।মা আঁচলে কান্না লুকায়।বাবা এদিক সেদিক ঘুরে তাকায়,যেন আদরের মেয়ে চোখে জল না দেখে। বাপের দেওয়া নতুন শাড়ি পরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরতি নাইওর যায়।

যেতে যেতে ফেলে আসা পথের সাথে অনেক সুখস্মৃতি রেখে যায়।যাওয়ার কালে শ্রাবণ শেষে ভাদ্রমাসেও মুষলধারায় বর্ষা নামে।প্রকৃতিও যেন কেঁদে কেঁদে বলে আবার সামনের বছর এসো কন্যা বাপেরবাড়ির গাঁয়।

“নাইওর নিয়ে লিখতে গেলে

ফুরাবে না লেখা,

একজনমে যায় কী বলা নাইওরের সুখ দুঃখ  গাথা।”

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *