দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙলো ফোনের আওয়াজে। ফোনটা করেছে পাড়ার মিলি বৌদি । ফোনটা ধরে বললাম, ” বৌদি বলো।” ” উমা ঘুমোচ্ছিলে? একটা বিশেষ দরকারে ফোন করলাম। ” কিছুটা থেমে বললাম, ” বৌদি বলো। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম গো।। ” ” আমাদের ফ্ল্যাটে তোমার দাদার পুরনো অফিসের একজন কলিগ ভাড়া এসেছেন। ভদ্রলোক ভীষণ অসুস্থ। ওয়াইফ নেই। মেয়েটা জাস্ট পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি করছে। দু বছর আগে ওই দাদার স্ট্রোক হয়ে গেছে। কথা প্রায় বলতেই পারেন না। ঘরের মধ্যে একটু আধটু চলাফেরা করতে পারেন । তোমাকে ফিজিওথেরাপি করাতে হবে।” ” বৌদি, তুমি তো জানো আমার একেবারে সময় নেই। শঙ্করদার সেন্টারে কাজ করেই সময় চলে যায়। বাবার শরীরটা ইদানীং একদম ভালো যাচ্ছে না। প্রেসার বেড়েছে। দোকনেও বসতে পারে না। ” ” উমা, আমি সব জানি গো। আমাদের খুব চেনা। মেয়েটা বারবার বলছে। অল্পবয়সি মেয়ে , অসুস্থ বাবাকে নিয়ে একা থাকে। আত্মীয়স্বজন বলতে এক কাকা। তিনি মাঝে মাঝে আসেন। মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয় গো। মা হারা মেয়ে, তুমি খুব পরিচিত, তাই বললাম। না করো না প্লিজ।” মুহুর্তে একটু ভেবে বললাম , ” ঠিক আছে বৌদি, কখন যেতে হবে ? ” ” এই সন্ধের সময় এসো। তাহলে তুমি রাজি তো? আমি বৃষ্টিকে বলে দিচ্ছি। ” ” ঠিক আছে বৌদি। তোমার বাড়িতে এই ছটা নাগাদ যাচ্ছি। ” ফোনটা রেখে গেলাম রান্নাঘরে। বিকেল হলেই চা ছাড়া বাবার চলে না। দুপুর পেরিয়ে গেলেও রোদটা বেশ চড়াই আছে। একটা হাঁড়িচাচা পাখি অনবরত ডেকে যাচ্ছে। রান্নাঘরের টিনের ছাউনির ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে ধুয়ে দিচ্ছে বাসনকোসন। চায়ের জল বসাতে বসাতে কানে এলো বাবার গলা। বললাম ,” যাচ্ছি”। চা করে নিয়ে গিয়ে দেখলাম বাবা কাগজ পড়ছে, মুখটা একটু শুকনো লাগছে। ” বাবা চা খাও। ” টেবিলে চায়ের কাপ রেখে জানলাগুলো খুলে দিলাম। ঘরের পাশে রাধাচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে হলুদ হয়ে আছে। ” উমা তুই আজ এখন বাড়িতে থাকবি?” ” না বাবা। মিলি বৌদি ফোন করেছিল। বৌদিদের ফ্ল্যাটে একজন এসেছেন, ওই ভদ্রলোকের ফিজিওথেরাপি করাতে হবে। আমি সময় হবে না বলেছিলাম, বৌদি খুব করে বলছে। যাই একবার। ” ” আবার কাজ নিবি উমা? সারাদিন ধরেই তো পরিশ্রম করিস। শরীর দেবে? তোর জীবনটা এই সংসারের হাল টেনে টেনেই গেল। তোকে এতটুকু সাহায্য করতে পারি না। দোকানেও আজকাল বসতে পারি না। একটুতেই খুব দুর্বল লাগে। আগের মতন জোর পাই না । খুব অপরাধবোধে ভুগি রে। কত করে বলেছিলাম উমা নিজের কথা ভাব ….” ” থাক না বাবা ওসব কথা। তুমি অযথা কষ্ট পাচ্ছ কেন? আমি ভালো আছি। আর পরিশ্রম করলে শরীর ভালো থাকে। ” ” হ্যাঁরে উমা তোর ভাই এসেছিল? ” ” ভাইয়ের তো কাজ থাকে বাবা। নিজের সংসার আছে। কারখানার কাজ, জানো তো? রোজ এলে চলে? ওরা ওদের মতো আছে থাকতে দাও না? ও ঠিক সময় পেলেই আসবে? যাগগে শোনো। আমি মিলি বৌদির বাড়ি যাই। তুমি সাবধানে থেকো। ” ” সেই। তেনার আর তোর আমার জন্য সময় কোথায়। বাবা দিদি এখন বাতিলের দলে।” ” আহ্ বাবা। ছাড়ো তো। ” এক এক সময়ে বাবাকে চুপ করাতে গিয়েও কষ্ট হয়। বাবা আরো কষ্ট পাবে বলেই বলতে হয়। হাতের কয়েকটা কাজ সেরে রেডি হয়ে যখন মিলি বৌদির ফ্ল্যাটের দিকে গেলাম তখন বিকেল প্রায় শেষের পথে। ক্ষীণ আলোর রেশ তখনও রয়ে গেছে। চারদিক থেকে শোনা যাচ্ছে শাঁখের শব্দ। ছোট ছেলেমেয়েদের দল খেলেদুলে ফিরছে। একটু হেঁটেই চলে গেলাম বৌদির বাড়ি। কিছুদিন আগে সাতচল্লিশ পার করেছি। একটানা সিঁড়িতে উঠলে হাঁটু দুটো টিপটিপ করে। কলিং বেল টিপতেই হাসি মুখে বৌদি দরজা খুলে দিল। ” এসো, উমা এসো। আগে বৃষ্টির ঘরে চলো। যাওয়ার সময় এখানে চা খেয়ে যাবে। বৃষ্টির খুব কষ্ট হচ্ছে গো দাদাকে নিয়ে। দিনরাতের একজন নার্স বৃষ্টি রেখেছে। কতই বা বয়েস! এতটা ঝক্কি সামলানো সম্ভব? চলো। ” তিনতলার ফ্ল্যাটে গেলাম বৌদির সঙ্গে। দরজা খোলাই ছিল। বৌদি বললো, ” রীতা, দাদা কই? বৃষ্টি ফিরেছে? আমি নিয়ে এসেছি উমাকে। ” রীতা উত্তর দিল ” ওহ্ দিদি এসে গেছেন? চলুন। দাদা ও ঘরে।” ঘরে ঢুকেই চেয়ারে বসা মানুষটার অবয়ব দেখে বুকটা ধড়াস করে উঠলো। মিলি বৌদি বললো ” ও তপনদা এদিকে ফিরুন। ফিজিওথেরাপিস্টকে সঙ্গে করে এনেছি। উমা ভীষণ ভালো কাজ করে। সুস্থ হয়ে যাবেন। ” ঝট করে মুখের একটা পাশ দেখেই আমি অতীতের মুখোমুখি হলাম। আগে আমরা ভাড়া থাকতাম তালডাঙায়। জায়গায়টাতে অসংখ্য তালগাছ ছিল। তপনদারা ছিল পাড়ার বর্ধিষ্ণু পরিবার। ওদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হত। তপনদার বাড়ির টুকটাক জিনিস বাবার মুদির দোকান থেকে যেত। আমাদের সংসারে খুব অভাব অনটন ছিল। মাও সেলাই-ফোঁড়াই করতো। বাবা দোকানের জন্য মালপত্র আনতে গেলে আমি দোকানে বসতাম। তপনদা মাঝে মাঝে জিনিস কিনতে আসত। পাড়ার বয়েজ ইশকুলে তপনদা পড়তো। আমি গার্লস ইশকুলে যেতাম। চোখাচোখি যৌবনের লগ্নে কখন যে ভালোবাসা-বাসি হয়ে গেল, বুঝলাম না। একবার পুজোর অষ্টমীর দিন তপনদা নিজের মনের কথা বলেই দিল। একটি দিনের কথা কখনও ভুলবো না। মুহূর্তের দুর্বলতা যে সারা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে সেদিনকার সতেরো বছর বয়সি আমি তখন বুঝতে পারিনি। আমার উচ্চমাধ্যমিক সদ্য শেষ হয়েছে। তখন মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, বুঝতে পারছিলাম যে মায়ের জীবনের আলো শেষ হয়ে আসছে। সেদিন সন্ধেতে জোরে বৃষ্টি পড়ছিল। বাবা ভাই বাড়িতে ছিল না। তপনদা এসেছিল। প্রদীপের দপদপে আলোয় সেদিন দুজনেই সব জড়তার বাঁধ ভেঙে কাছাকাছি এসেছিলাম। সেই মুহূর্তে ভাবিনি বিত্তের চোখরাঙানির কথা, আমাদের অবস্থার চরম ব্যবধানের কথা। তারপর কিছুদিনের মাথায় জানতে পারি আমি সন্তানসম্ভবা। তপনকে বলি। তপন জানায় ওটা মুহুর্তের দুর্বলতা ছিল, তপনের পক্ষে আর ভাবা সম্ভব নয়। দূরত্ব বাড়তে থাকে। একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তাই লোক লজ্জার ভয় পেয়ে বসে। সমাজকে একেবারে উপেক্ষা করে সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সাহস পাইনি। মহাভারতে পড়েছিলাম কুন্তী সমাজের ভয়ে সন্তানকে নদীতে ভাসিয়ে দেন। যুগ এগিয়েছে। সমাজের চিত্র খুব একটা বদলায়নি। আধুনিক সমাজে কর্ণদের মরতে হয় সুসজ্জিত ঠাণ্ডা ঘরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে। চেনা এক দিদিকে নিয়ে গিয়ে আমিও তাই করলাম। চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটে গেল জঠরে কয়েক মাস লালিত প্রাণটার সঙ্গে। সেদিন কাঁদিনি,কয়েক মাসের সব অনুভূতি দিয়ে যাকে একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলাম, জগত দেখার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। মনে মনে বললাম, ” ক্ষমা করিস মা।” তারপর মাও চলে গেল, আমরাও তালডাঙার পর্ব চোকালাম। ফিজিওথেরাপি শিখলাম। “উমা, উমা শরীর খারাপ লাগছে? চুপ করে আছো? তুমি তপনদাকে চেনো?” মিলি বৌদির কথায় বাস্তবে ফিরলাম। দরদর করে ঘামছি। দেখি তপন প্রাণপণে কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে লুটিয়ে পড়েছে তপনদার শরীর। তপনদাকে আনা হয়েছে হসপিটালে। মিলি বৌদিদের পিছু পিছু আমিও চলে এসেছি। অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। মনে অসম্ভব একটা দোলাচল চলছে, কিছুই ভাবতে পারছি না। অতীত, বর্তমান সব যেন এক হয়ে যাচ্ছ। কে যেন ডেকে উঠলো, ” অ্যান্টি,আমি বৃষ্টি। তুমি বাবার ফিজিওথেরাপি করতে এসেছিলে না? বাবা আর বাঁচবে না বোধহয়, বাবা ছাড়া আর কেউ নেই, মা তো কবেই……” চেয়ে দেখলাম বৃষ্টির দিকে। মেয়েটির চোখেমুখে কোথাও যেন তপনদা লুকিয়ে আছে। বৃষ্টির কাঁধে হাত রাখলাম। অনেক বছর আগে অনুভূত নাড়ির টানটা আবার একবার অনুভব করলাম। বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। স্বচ্ছ আকাশ। সাদা গুলঞ্চে ভরে আছে লন। শূন্যতার মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে পূর্ণতার নরম আলো।