ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৩৮)

দার্শনিক হেলাল ভাই

রিনি আর ঝিনি আপার সাথে আমি আবার ওপরে উঠে এলাম। আবার কলবেল চাপলাম। রিনি আর ঝিনি আপা তখন আমার পেছনে দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে। দরজা খুললেন খালাম্মা। ওদেরকে খেয়াল করলেন না। আমাকে বললেন: কিছু ফেলে গেছো? নাকি আরও কিছু বলার আছে?
আমি কিছু বলার আগেই রিনি সামনে চলে এল। বলল: আমার নাম রিনি, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। আর ও আমার বড় বোর ঝিনি, ফিলোসোফিতে অনার্স থার্ড ইয়ার। আমরা হেলাল ভাইকে দেখতে এসেছি।
: ভালো, খুব ভালো। এসো….।
দু’জন দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেল। আমি তাদের পেছনে। হেলাল ভাই ওদের কন্ঠ শুনেছে। তার পরনে ছিল লুঙ্গি। গা ছিল খালি। সে দিশেহারা হয়ে গেল। লুঙ্গি পাল্টাবে, নাকি জামা গায়ে দিবে কিছু বোঝার আগেই রিনি আর ঝিনি আপা ঘরে ঢুকে গেল। ওরা চেয়ারে না বসে সরাসরি খাটে বসল। আমি বসলাম সামনের একটা চেয়ারে।
হেলাল ভাই জড়োসরো হয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। তাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। রোগ তাকে যতটা অসহায় করতে না পেরেছে, এই মেয়ে দু’টির আগমন তার চেয়ে অনেক বেশি করে ফেলেছে।
রিনি ঠাস করে বলে উঠল: আপনি তো রীতিমতো কঙ্কাল হয়ে গেছেন-জীবন্ত নরকঙ্কাল। ইশ! একটু জানতেও পারলাম না। কী হয়েছিল আপনার?
: এখন আর কোনো সমস্যা নেই।
: তবু সাবধানে থাকতে হবে, ওষুধ-পত্র ঠিকমতো খাবেন।
: অবশ্যই।
: এরপর থেকে মোজাফ্ফরের দোকানে ওভাবে বসে থাকবেন না। বাসায় থেকে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবেন।
: আচ্ছা।
: আর এই বাঁদরগুলোর সাথে রোদ-বৃষ্টিতে হাঁটাহাঁটি করবেন না।
আমার মেজাজ গরম হল। সে আমাদেরকে বাঁদর বলছে। আমি প্রতিবাদ করে কিছু বলার আগেই হেলাল ভাই বলল: ওরা তো ভালো ছেলে।
: ভালোই যদি হবে তো আপনার অসুখের খবর আমাদের জানালো না কেন?
: ওরাই জানতো না। আমি ওদেরকে জানাইনি।
: ও আচ্ছা। হেলাল ভাই, আমাদের সামনে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে থাকতে আপনার কি অস্বস্তি বোধ হচ্ছে?
ঝিনি আপা গরম চোখে তাকালো রিনির দিকে। রিনি ঝিনি আপার গরম চোখকে পাত্তা না দিয়ে বলল: ব্যাপার না, লুঙ্গি বাংলাদেশের প্রধান পোশাক। এটাকে ছেলেদের জন্য জাতীয় পোশাক ঘোষণা করা উচিত। ভারতের প্রধান ধুতি। ধুতি পরে তারা তাদের সংসদেরও যেতে পারে, জাতিসংঘেরও যেতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তাদের প্রধান পোশাক পরে সর্বত্র যাওয়া যায়। অথচ আমাদের লুঙ্গি নিয়ে…..। লুঙ্গি না পরে থাকার উপায় নেই, কিন্তু লুঙ্গির জন্য শরমে মরণের অবস্থা হয়। এটা ঠিক না।
আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এই মেয়ের মুখ বন্ধ করি কিভাবে। তখনই খালাম্মা নাস্তা নিয়ে এলেন। বললেন: তোমরা খাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
রিনি বলল: খালাম্মা, চা আমি করব।
: তুমি……!
: জি খালাম্মা, আমার কাছে হার্বাল টি-প্যাক আছে। জিনজার মিক্সড। এটা হেলাল ভাইয়ের জন্য খুব উপকারী হবে। শুধু গরম পানি, তারপর চিনি, তারপর টি-ব্যাগ ডুবিয়ে দিলেই হল।
: আচ্ছা, আমি গরম পানি নিয়ে আসছি।
: না, আমিই গরম পানি করব। চা বানানোর পুরো কৃতিত্বটা আমি নিতে চাই। আমি খুব ভাল চা বানাই। বাবা আমাকে বলে, টি-স্প্যাশালিস্ট। তাই না আপা?
ঝিনি আপা কিছু বললো না। খালাম্মা মুখে মিটিমিটি হাসি ধরে বললেন: এসো তাহলে।
রিনি খালাম্মার সাথে গেল, আমরা হাফ ছাড়লাম। আমার মনে হলো, রিনি আর কিছুক্ষণ এ ঘরে থাকলে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যেতাম।
আমি আর ঝিনি আপা বসে রইলাম। আমার তো বিশেষ কোনো কথা নেই। যা বলার আমরা আগেই বলে গেছি। ঝিনি আপা কিছু বলতে পারে। কিন্তু সে তো চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। তার ছোট বোনের ঠিক উল্টো। সে কিছু বলছে না। আমি দেয়ালে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিছু ন্যাংটা ছেলেপেলে ঝাপাঝাপি করে গোসল করছে। আমারও ইচ্ছে হলো ওভাবে গোসল করি। মনে হল, বাথরুমে মগ ভরে, অথবা সাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে, অথবা বাথটাবে শুয়ে যে গোসল সেটা কোনো গোসল নয়। বাংলার ছেলেমেয়ের আসল গোসল হল পুকুর, নদী, খাল, বিলে ঝাপাঝাপি করে গোসল করা। এমন গোসল যে না করছে, সে জীবনে গোসলই করে নাই। তবে ন্যাংটা হওয়ার বয়স এখন আমার নাই।
রিনি এল কেটলি ভরে গরম পানি নিয়ে। গরম পানি কাপে ঢাললো। চিনি মেশাল। নিজেদের প্যাকেট ছিড়ে প্রতি কাপে টি-ব্যাগ দিল। তারপর বলল: হেলাল ভাই, আমরা দু’বোনই কিন্তু দেখতে সুন্দর, তাই না?
ঝিনি আপা মাথা নিচু করল। হেলাল ভাই বলল: হু।
আর আমি মনে মনে বললাম: তুমি সুন্দর, কিন্তু মাথা খারাপ টাইপের। তোমার মতো সুন্দর মেয়েরা মাথা খারাপ টাইপের হয়।
রিনি বলল: আচ্ছা, অপেক্ষাকৃত বেশি সুন্দর কে?
হেলাল ভাই বলল: দু’জনই সুন্দর।
: তবু যদি কম্পেয়ার করতে বলা হয়। ঊনিশ-বিশ তো হবেই।
: এরকম বিষয়ে আমি কম্পেয়ার করতে পারি না। প্রতিটা মানুষ তার মতো সুন্দর, প্রতিটা মানুষই ইউনিক। সেই সৌন্দর্য, সেই বিশেষত্ব ধরার ক্ষমতা আমাদের থাকে না বলে আমরা কাউকে সুন্দর বলি, কাউকে অসুন্দর বলি।
: মারাত্মক কথা বলেছেন। তবু আমার মনে হয়, আমি আপার চেয়ে একটু বেশি সুন্দর। আমার ডান পাশে ঠোঁটের একটা কালো তিল….।
: মনে হওয়াটা মন্দ কিছু না।
: আমি হাসলে ডান গালে টোল পড়ে। আচ্ছা, গালে টোল পড়া মেয়েরা নাকি খুব দুঃখি হয়?
: এরকম কিছু আমার জানা নেই।
: দুঃখি হলে হব, এ নিয়ে ভাবি না। দুঃখকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, দুঃখি মানুষরা কোনো না কোনো দিক দিয়ে শিল্পী হয়ে উঠতে পারে।
আমি মনে মনে বললাম, তুমি দুঃখি হবে বলে মনে হয় না। তবে অন্যের দু খের কারণ হবে।
হঠাৎ ঝিনি আপা ধমক দিয়ে উঠল: তুই একাই কথা বলবি? আমরা কিছু বলব না?
আমি খুশি হলাম। এই ধমকটার দরকার ছিল। দেরিতে হলেও ধমকটা কাজে লাগবে। রিনি বলল: ওমা! আমি চা বানাতে গেলে তোমরা কথা বলো নাই? মুখ বন্ধ করে বসে ছিলে?
তখন খালাম্মা এলেন। ঝিনি আপাকে জিজ্ঞেস করলেন: মা, তুমি যেন কী পড়ো?
ঝিনি আপা মুখের কাছ থেকে চায়ের কাপ সরিয়ে উত্তর দিতে যাবে তার আগেই রিনি বলল: আপা ফিলোসফিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে। আর আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। সায়েন্স গ্রুপ। আমি ডাক্তার হব। ঐ দর্শন-ফর্শন আমার ভাল লাগে না।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।