• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ১৩)

দার্শনিক হেলাল ভাই – ১৩

হেলাল ভাই বলে, মেয়ে মানুষের হৃদয় প্রশান্ত মহাসাগরের চেয়েও গভীর। এর তল পাওয়া সহজ ব্যাপার না।
কিন্তু না। সৈয়দা নার্গিস জাহান সেই আবৃত্তি সংগঠন নিয়েই রইল। দিনে সাতবার ফোন করে হেলাল ভাইকে। মুখস্তের মতো বলতে থাকে একই কথা: হেলাল ভাই, আমাদের ছাদঘরটা নেন। একটা আবৃত্তি সংগঠন চালু করেন। ভাড়া-টারা কিছু দিতে হবে না। আমি সংগঠনের শিক্ষার্থী কাম কর্মী হিসেবে থাকব। সপ্তাহে একটা/দুইটা ক্লাশ নেয়া ছাড়া আপনাকে আর কিচ্ছুটি করতে হবে না। সব আমি করে দিব। সংগঠন থেকে যা আয় হবে সব আপনার।
সৈয়দা নার্গিস জাহানের প্রস্তাবটা আমাদের কাছে খারাপ লাগে না, বরং বেশ ভালই মনে হয়। ভাল একটা সংগঠন দাঁড় করানো যাবে হয়ত। হেলাল ভাই দর্শনিক হলেও কবিতার ওপর আছে তার ব্যাপক পাঠ। ছন্দ, তাল, লয়, মাত্রা ভাল জানে। আবৃত্তির নিয়ম-কানুনও ভাল জানে, সেই সাথে জানে কন্ঠের কারুকাজ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেমন হবে, তেমন হবে কিছু রোজগার।
কিন্তু হেলাল ভাই প্রস্তাবটাকে ভালভাবে নেয় না। সৈয়দা নার্গিস জাহানের কাছ থেকে ফোন এলেই হেলাল ভাই ভীষণ বিরক্ত হয়। তারপর মফিজকে গালাগাল শুরু করে।
মফিজ চিঠিটা সৈয়দা নার্গিস জাহানের বাবার হাতে দেবার পর থেকেই হেলাল ভাইয়ের গালাগাল শুনছে। আহা বেচারা!
ফেকু একবার বলল: মেয়েটা তো খারাপ কিছু বলছে না।
: খারাপ কিছু বলছে না মানে?
: সে নিজে সব দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছে। বিনা ভাড়ায় জায়গা দিতে চাচ্ছে। এই ঢাকা শহরে একটা খুপরি ভাড়া করতে গেলেও দশ/বারো হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হয়।
: ততে কী হয়েছে?
: সেখানে আবৃত্তি সংগঠন চালু করলে এলাকার ছেলেমেয়েরা কবিতার কাছাকাছি যেতে পারবে।
: আমি কি আবৃত্তি সংগঠন করার জন্য বায়ান্নটা চিঠি বিলি করেছি?
: আপনার সে উদ্দেশ্যও সফল হবার সম্ভাবনা আছে এখানে?
: কীভাবে?
: দৃষ্টির কাছাকাছি থাকলে কারও হৃদয়ের কাছাকাছি যাবার সম্ভাবনাও তৈরী হয়।
: খোলসা করে বল।
: এত খোলসার কী আছে? দার্শনিক মানুষ আপনি। সাধারণ সূত্র বোঝেন না? আবৃত্তি সংগঠন চালু করলে সৈয়দা নার্গিস জাহানের সাথে আপনার বার বার দেখা হবে, কথা হবে, আপনার আবৃত্তি শুনবে, এভাবে……..এভাবে প্রেম হয়ে যাবে।
: যাহ! তুই খুব বাজে বকিস। ফাজিল একটা!
হেলাল ভাই লজ্জায় লাল টুকটুকে টমেটো হয়ে গেল। ভাল মানুষেরা খুব সহজেই লজ্জা পায়। লজ্জাহীন হয় খারাপ মানুষেরা। তবে এরকম লজ্জা নিয়ে হেলাল ভাই প্রেম করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে কেন সেটা আমাদের মাথায় আসে না।
শেষ পর্যন্ত হেলাল ভাই আবৃত্তি সংগঠন করতে রাজি হল না। তার চিঠিতে যদি কেউ সাড়া দেয় তো তার সাথে প্রেম করবে। প্রেম করার জন্য সে অন্য কোনো পন্থায় যাবে না।
সৈয়দা নার্গিস জাহানের ফোন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হেলাল ভাই নিজের ফোন নাম্বার বদলে ফেলল।
সৈয়দা নার্গিস জাহান আমাদের কাছে অনেক বার হেলাল ভাইয়ের নতুন নাম্বারটা চেয়েছে। নিষেধ থাকায় আমরা দিতে পারিনি। মেয়েটা অনেক কষ্ট নিয়ে শেষমেশ চুপ হয়ে গেছে।

মফিজ ঝামেলা বাঁধিয়েছিল ভুল জায়গায় চিঠি দিয়ে। সঠিক জায়গায় চিঠি পৌছে দিয়ে আমরা নিজেরাই কেউ কেউ ঝামেলায় পড়ে গেলাম। হেলাল ভাইয়ের বকাবকির মধ্যে না পড়লেও ঝামেলা কম হল না।
যেমন আমি। আমি যে কয়টা মেয়ের কাছে চিঠি পৌছে দিয়েছি তাদের একজন হল, আলহাজ্ব হাফিজুর রহমানের মেয়ে মোসাম্মত খাদিজা খাতুন। সবাই ডাকে খাদিজা। খাদিজা খাতুন অপরূপা। সুন্দরী মেয়েরা সহজ-সরল হয়। খাদিজা একটু বেশিই সহজ-সরল। সহজ-সরল ব্যাপারটা অনেকের মাথায় আসে না। এই জটিল-কুটিল যুগে সহজ-সরল মানুষকে লোকে বোকা ভাবে।
আমি মোসাম্মত খাদিজা খাতুনের হাতে চিঠি দিতেই সে খুলে দেখল। দেখে বলল: হেলাল ভাই দিছে?
: হু।
: শুনেছি সে পাড়ার সব মেয়েকে চিঠি দিতেছে।
: সব মেয়েকে না। নিচের ক্লাশের মেয়েরা বাদে…..।
: ওমা! এইটা তো আমার চিঠি না। আমারটা দ্যাও।
: এটাই তোমার।
: আজাইরা কথা বইল না। এইখানে লেখা সুরঞ্জনা। সুরঞ্জনারা থাকে ২৪৩ নম্বর বাড়ির পাঁচ তলার ডান পাশের ফ্ল্যাাটে।
: আরে না, এটা তোমার।
: আমার বাবা তিনবার হজ্ব পালন করছে। সে মেয়ের নাম রাখবে সুরঞ্জনা?
: সুরঞ্জনা সব মেয়ের প্রতীক।
: তুমি আমার চিঠি হারায়া ফেলছ তাই বলো। এখন বানাইছো সুরঞ্জনা সব মেয়ের প্রতীক। অতো কিছু বুঝি না। আমার নাম দিয়া তুমি আরেকটা চিঠি লেইখা আনবা।
: ধ্যাত্তারি!
খাদিজা কিছুতেই চিঠি নেবে না। চিঠি যদি ফেরত নিয়ে আসি তো হেলাল ভাইয়ের মেজাজ গরম হয়ে যাবে। শেষে জোর করে খাদিজার হাতে চিঠিটা গুঁজে দিয়ে ছুটে পালালাম।
চিঠিটা ঠিক জায়গায় পৌছে দিয়ে হেলাল ভাইয়ের বকা থেকে রক্ষা পেলাম। কিন্তু ঝামেলা রয়েই গেল।
খাদিজা আমাকে দেখলেই ডাক দেয়। আর সে যে মসুলমান, তার বাবা তিনবার হজ্বব্রত পালন করেছেন, এবং তার নাম কিছুতেই সুরঞ্জনা হতে পারে না সেটা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগে: হেলাল ভাই কিছুতেই আমার নাম সুরঞ্জনা লিখতে পারে না। আমার বাবা আমাকে সব সময়ই বোরখা পরার উপদেশ দেন। আমারও বোরখা পরার খুব ইচ্ছা। কিন্তু পারি না। বোরখা পরে হাঁটতে গেলে আমার পায়ে পায়ে টান লাগে। বাবার বকা খেয়ে একবার পরেছিলাম। সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে আমার হাতে কুনুই ছিলে গিয়েছিল। আর এই দেখো, কপাল কেটে গিয়েছিল। তিনটা সেলাই পড়েছিল। এই দেখো…….।
আমি খাদিজার কপালের কাটা দাগ দেখলাম। দাগটা ওকে আরও সুন্দর করেছে। ওটা যে কাটা দাগ তা বোঝাই যাচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো জন্মদাগ।
খাদিজা বলে: আসলে পোশাক হিসেবে বোরখা আমার পছন্দ। না পরার পেছনে আরও একটি কারণ হল, বোরখা পরলে আমার খুব গরম লাগে। এমনিতেই আমার শরীরে গরম একটু বেশি। দিনে দুই/তিন বার গোছল করি। বোরখা পরলে শীতের দিনেও আমার শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়।
বোরখা না পরার কারণ হিসেবে খাদিজা যা বলতে লাগল তা প্রচার হলে নিশ্চিত বোরখা ব্যবসায়ীরা ক্ষেপে যাবে। আমি বললাম: ঠিক আছে, তোমার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। আসলে ব্যাপারটা হল কী……।
: আর আমার এইম ইন লাইফ হল, কোনো বাহিনীতে চাকরি করা। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, পুলিশ বাহিনী এর যে কোনোটায়। বোরখা টানবো না বন্দুক টানবো তাই…..।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।