হেলাল ভাই মাঝে মাঝেই ফোনে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে ফোনে কথা বলতো। কখনো কখনো কারও সাথে দেখা করতে যেত তাও জানতাম। তখন বুঝতে পারলাম, হেলাল ভাই অন্য যেসব এলাকায় আগে থেকেছে, ওরা সেসব এলাকার ছেলেপেলে। হেলাল ভাইকে ভুলে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
একদিন হঠাৎ এক ঝলকের জন্য হেলাল ভাইয়ের বাবাকে দেখলাম। রিকশা করে যাচ্ছিলেন। তার মানে তারা গ্রাম থেকে এসেছেন। তাহলে হেলাল ভাই কোথায় ?
সেদিন বিকেলেই সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা হেলাল ভাইয়ের বাসায় যাব।
সারাদিনই বৃষ্টির কামাই নেই। বিকেলে বৃষ্টি আরও বেড়ে গেল। সেই বৃষ্টিতে ভিজেই আমরা গিয়ে জড়ো হলাম বল্টুদের বাসার সামনে। বল্টুদের উপরেই হেলাল ভাইরা থাকে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম উপরে। হেলাল ভাইদের বাসার সামনে গিয়ে আমরা হতভম্ব। দেখি দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। আমরা যে হেলাল ভাইয়ের বাবাকে দেখলাম! নাকি হ্যালুসিনেশন? এখনও তারা আসনি। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলাম।
দুঃশ্চিন্তায় ছেয়ে গেল আমাদের মন। তাহলে কি হেলাল ভাইরা আর আসবে না? নাকি হেলাল ভাইয়ের বড় কোনো অসুখ হল? বল্টু বলল: বাড়িওয়ালার সাথে কথা বললে কিছু জানা যেতে পারে।
আমি বললাম: তাহলে চল, কথা বলে দেখি।
: এখন তো প্রায় সন্ধ্যা। কাল সকালে বলব।
: তাই হবে।
চুপচাপ আমরা যার যার বাসায় চলে এলাম।
আমি সন্ধ্যায় সুবোধ বালক হয়ে পড়ার টেবিলে বসলাম। হেলাল ভাই থাকলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি পড়তে বসা হত না। কিন্তু পড়ায় কি আর মন বসে? শুধুই মনের পর্দায় হেলাল ভাইয়ের মুখ। মাথার ভেতর হেলাল ভাইয়ের চিন্তা। মা এক গ্লাস গরম দুধ রেখে গেল টেবিলে। দুধ জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। খাওয়া হল না। রাতে ভাতও খেতে পারলাম না।
বাবা বলল: তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।
: হেলাল ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে।
: ওরা তো গ্রামের বাড়ি গিয়েছে শুনলাম।
: হ্যাঁ, এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরবে বলেছিল।
: এখনও ফেরেনি?
: না।
: ফোন করে দেখতে পারো।
: তার ফোন বন্ধ।
: ফোন বন্ধু থাকবে কেন?
: সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
অন্য সবাইও আমার মতো চিন্তিত।
রাত বারোটার দিকে বল্টুর ফোন এল। মশুলধারার বৃষ্টির মধ্যে রাত বারোটার দিকে বন্ধুর ফোন আনন্দই নিয়ে আসে। কিন্তু আমি কেঁপে উঠলাম। আজানা খারাপ কোনো আশঙ্কায় মন কেঁপে উঠল। বল্টুরা তো হেলাল ভাইদের বাসার নিচের ফ্ল্যাটে থাকে। খারাপ কোনো খবর পেল কি?
বল্টু বলল: আমি কিছুক্ষণ আগে উপরে উঠেছিলাম। হেলাল ভাইদের বাসা তালাবন্ধ নাই। ভেতরে আলো। মানুষ আছে স্পষ্ট বোঝা যায়।
: তাহলে কাল সকালে আবার যাবো।
: অবশ্যই।
: তুই সবাইকে জানিয়ে দে’।
: জানিয়ে দিচ্ছি। তুই সকাল দশটার মধ্যে চলে আসবি।
: আচ্ছা।
সকাল দশটায় কাকভেজা হয়ে আমরা জড়ো হলাম হেলাল ভাইদের দরজার সামনে। দরজায় তালা নেই। আমি বেল টিপলাম।
একবার।
দুইবার।
তিনবার।
আমাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ। হয়তো দরজা খুলবে অপরিচিত কেউ। বলবে: তোমরা কারা? কাকে চাও? ও, তারা তো বাসা ছেড়ে চলে গেছে।
হয়তো আগুনে পোড়ার এতবড় ঘটনা ঘটার পর হেলাল ভাইয়ের বাবা-মা আর এই এলাকায় থাকতে চাননি। তাছাড়া আফজাল ভাই যে ঝামেলা করছিল তা তো তারা জেনেছে। মাস্তানদের এ দেশের মানুষ ভয়ের চোখে দেখে। একমাত্র ছেলের অমঙ্গল হোক তারা তারা চাইবেন না।
আবার অন্যরকম চিন্তাও আসে। যাই হোক, কাউকে কিছু না বলে চোরের মতো পালিয়ে যাওয়ার কথা না। আসবাবপত্র নিয়ে যাবার সময় কারও না কারও চোখে পড়তোই।
দরজা খুললেন হেলাল ভাইয়ের মা। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন। বললেন: ও তোমরা? এসো, এসো…….।
আমরা স্বস্তি ফিরে পেলাম মনে। অভিবাদন জানিয়ে আমাদের আগে কিছু বলা উচিত ছিল। কিন্তু তা হলো না। এর আগেও কখনো হয়নি। প্রথমেই তিনি একটা হাসি উপহার দেন, আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তারপর তার আহ্বানে ঘরে ঢুকে যাই।
ঘরে প্রবেশ করতে করতে আমি বললাম: হেলাল ভাই,…….?
: হ্যাঁ আছে, এসো…..। বেশ কিছুদিন ধরে ওর জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, মাথাব্যথা।
আমাদের শব্দ পেয়ে হেলাল ভাই তার ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে তাকিয়ে ছিল। আমরা তার ঘরে গিয়ে বসলাম। চেয়ারে এবং খাটের চারপাশ ঘিরে।
হেলাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কষ্টে ভরে গেল আমাদের মন। ভীষণ শীর্ণকায় একজন মানুষ হয়ে গেছে। কোটরাগত চোখ। বসে যাওয়া চোয়াল আরও ভেতরে ঢুকে গেছে। দাঁতগুলো যেন একটু বের হয়ে এসেছে।
নদু বলল: হেলাল ভাই, আপনি যে অসুস্থ তা আমাদের জানাবেন না?
: তোদের জানিয়ে কী হবে? তোরা কি ডাক্তার? তোদের কি নার্সিং এর ওপর ট্রেনিং আছে?
: মানুষ অসুস্থ হলে শুধু ডাক্তার আর নার্সকে জানায়? আর কাউকে জানায় না? এই আপনার দর্শন? আমার সন্দেহ হয়, আপনি ফিলোসফিতে অনার্স কি না…..। হয়তো জিওগ্রাফিতে……।
: আই এ্যাম এ্যা ফিলোসফার, দেয়ার ইজ নো ডাউট। একবার ভেবেছিলাম, তোদেরকে খবর দেই। কিন্তু খবর দিব কাকে দিয়ে? বাবা বাসায় ছিলেন না। গ্রামে গিয়েছিলেন মাস খানেকের জন্য। গ্রামের বাড়ি-ঘর ঠিক করার কাছে হাত দিয়েছেন।
: আপনার সেলফোন কই?
: চার্জ দেয়া হয় না কতদিন তার হিসাব নাই। আর ব্যালেন্সও নাই।
: বাসায় আর কোনো সেলফোন নাই?
: এমন সময় হেলাল ভাইয়ের মা এলেন নাস্তা নিয়ে। বললেন, খাও তোমরা।
আমি বললাম: এতকিছু কেন খালাম্মা? শুধু চা দিলেই তো হতো।
: এত কোথায়? সকালে নাস্তা খেয়েছো?
আমরা যে ঘুম থেকে উঠেই হাত-মুখ ধুয়ে ছুটে এসেছি, তিনি হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছেন।
খালাম্মা বললেন: আমি অনেকবার বলেছি, তোমাদের খবর দিতে।
: আমাদের খবর দিলে তার সমস্যা কী হতো?
: আমি কী করে বলব? মা হয়ে ওকে বুঝতে পারি না বুঝলে……।
: দার্শনিকরা এরকম উল্টাপাল্টা হয়।
: কিসের দার্শনিক? দার্শনিক হলে একটা নিয়মের মধ্যে চলতো। দার্শনিক কান্টের চলাফেরা দেখে এলাকার মানুষ বুঝে যেত যে, তখন কয়টা বাজে। তার রুটিনের এক চুল হেরফের হতো না।
খালাম্মা দার্শনিক কান্ট সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। আমরা হেলাল ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবার আগে কান্টের নামই শুনি নাই। এই না হলে দার্শনিকের মা।
খালাম্মা বললেন: ফোর্থ ইয়ারে এসে আর বই স্পর্শ করে নাই। এইসব একাডেমিক লেখাপড়ার আর নাকি কোনো দরকার নেই।
: আশ্চার্য!
: বলে, পৃথিবীর সব দর্শনেরই সমালোচনা করা যায়। প্রকৃতির কোনো সমালোচনা নেই। বৃক্ষ, নদী, বৃষ্টি এসবের কোনো সমালোচনা নেই। সে নাকি বৃক্ষের কাছে যাবে।
: ঠিক বুঝলাম না।
: কৃষক হবে। ফুল-ফল-ফসলের দার্শনিক হবে।
: কৃষক! মোজফ্ফরের দোকানের পেছনে একটু কাঁচা মাটির জায়গা আছে, সেখানে……।
সবাই উচ্চ কন্ঠে হেসে উঠলো। খালাম্মাও হাসলেন। খালাম্মার হাসিটা অনেক ভালো লাগল। তিনি বললেন: তোমরা খাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
তোরা খা, তারপর কথা হবে-এই বলে হেলাল ভাই পিঠের নিচে বালিশ গুঁজে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসল।
আমরা কেউ এক টুকরো ফল, কেউ একটা বিস্কুট, কেউ এক টুকরো কেক হাতে তুলে নিলাম।
হেলাল ভাই বলল: সেমাইটা আগে খা। গুড়ো দুধ বা প্যাকেটজাত দুধের সেমাই না। খাঁটি গরুর দুধের সেমাই। বাবা গ্রাম থেকে গরুর দুধ এনেছেন।
আমরা সেমাই খেলাম। সত্যিই সুস্বাদু। তেজপাতা, এলাচ, দরুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদির সুগন্ধ মাখা। তারপর চা। হেলাল ভাই আমাদের সাথে সেমাই আর চা খেল।
হেলাল ভাইয়ের প্রতি আমাদের যে অভিমান ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। পেটে ক্ষিধে থাকলে রাগ-অভিমান বাড়ে। পেট ভরে গেলে তা কমে।
বল্টু বলল: সমস্যা কী আপনার?
: জ্বর।
: কী ধরনের জ্বর? ব্লাড টেস্ট……?