সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৬০)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৬৫ 

ফিং ফোটা জ্যোৎস্নায় তখন ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ভেসে যায় ওরা দু’জনেও। সামনে তখন কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে গঙ্গা। সেদিকে চেয়ে গুন গুন করে সাঁওতালি গান গায় অঞ্জলি। কখনও বা আলাপনবাবু হাল্কা স্বরে আবৃত্তি করেন জীবনানন্দ থেকে জয় গোস্বামী। দুজনেই জড়িয়ে থাকে দুজনের হাত। উত্তাপ ছাড়িয়ে সে হাত থেকে জন্ম নিচ্ছে গভীর প্রত্যয়।
আলাপনবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে, অঞ্জলি বলে তুমি সারাজীবন আমাকে এভাবেই ধরে রাখবে তো আলো , কোনদিন ছেড়ে যাবে না তো ? কথা বলতে বলতেই চিক চিক করে ওঠে অঞ্জলির চোখ। আলাপনবাবু আলতো হাতের ছোঁয়ায় সেই জল মুছিয়ে দিয়ে বলেন , কি সুন্দর তুমি আমায় আলো বললে। তুমি আমাকে ওই নামেই ডেকো। না অঞ্জু,
কোন দিন ছেড়ে যাব না তোমায়। তোমার আলো সারাজীবন তোমাকে আলো দিয়েই ভরিয়ে রাখবে।কোন অন্ধকারের ছায়া পড়তে দেবে না তোমার জীবনে।অঞ্জলি আরও ঘন হয়ে আলাপনবাবুর দিকে মুখ তুলে বলেন , তুমি সত্যি বলছো আলো ?
আলাপনবাবু কোন কথা বলেন না। তার ঠোঁট নেমে আসে অঞ্জলির ঠোঁটে। পরপর তিনটে চুম্বন দেন আর বলেন , সত্যি – সত্যি – সত্যি।
তীব্র ভালোলাগার আবেশে অঞ্জলি এলিয়ে পড়ে আলাপনবাবুর কোলে। আলাপনবাবু অঞ্জলির কপালের চুল সরিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তার দিকে। জ্যোৎস্নায় অঞ্জলিকে দেবীর মতো লাগে তার। শুধু মুখের দিকে চেয়ে কেটে যায় কথাহীন সময়। রাত শেষ হয়ে আসে। একসময় অদুরের কোন মন্দির থেকে ভেসে আসে ঘন্টাধবনির শব্দ।শোনা যায় ভোরের আজান আর ঘুম ভাঙানিয়া ভোরাই। অঞ্জলিরা টের পায় ভোর হয়ে এলো।

কেউ ওঠার আগে এবার ঘরে যাওয়াই ভালো। উঠে পড়ে তারা দুজন। তাদের দেখাদেখি উঠে পড়ে শ্রাবণীরাও। শ্রাবণীদের দিকে চাইতেই পারে না অঞ্জলি। খুব লজ্জা লাগে তার। সেই লজ্জা এড়াতে দ্রুত ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। কিন্তু পিছন থেকে তাকে এসে ধরে ফেলে শ্রাবণী। কানে কানে বলে , কি গো রাতটা কেমন কাটালে বলো ?
অঞ্জলি বলে , ধ্যাত, তুই না বিয়ের পর বড্ড বেশি অসভ্য হয়ে পড়েছিস।
— বাহ ভালো বলেছো। আমি না হয় বিয়ের পর অসভ্য হয়ে পড়েছি। কিন্তু তুমি ? বেশ বেশ ঘরে চলো, সবাইকে না হয় খুলেই বলি সব কিছু। দেখি সবাই কাকে অসভ্য বলে।
—- ওরে বাবা, হয়েছে হয়েছে। ঘাট মানছি। আয় এবার ফেরার তোড়জোড় শুরু হয়ে যাবে।
তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে হাসতে হাসতে ঘরে ফেরে। আলাপনবাবুরাও তাদের ঘরে ফিরে যান। ততক্ষণে আড়মোড়া ভাঙছে লালবাগ। আড়মোড়া ভাঙছে হোমের মেয়েরা। তারা পা টিপে টিপে তাদের পাশটিতে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই তাদের দরজায় টোকা পড়ে।অঞ্জলি গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আলাপনবাবু। তার চোখে চোখ পড়তেই রাতের ঘটনা সব মনে পড়ে যায় অঞ্জলির। আর লজ্জায় মুখ নত হয়ে যায় তার। আড় চোখে দেখে শ্রাবণী তাদের দিকেই চেয়ে আছে। তাই সে আলাপনবাবুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা আন্দাজ করে আলাপনবাবু বলেন , এবার তো বেরনোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমি সেটাই বলতে এলাম। তারপর আলাপনবাবু নিজেদের ঘরের দিকে চলে যান। অঞ্জলিরাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে সবাই। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই বাসে গিয়ে বসে তারা। বাস ছাড়ার মুহুর্তে গতরাতের সেই চালাঘরটার দিকে চোখ চলে যায় অঞ্জলির।

জীবনের সেরা অনুভূতি, সুখস্মৃতি সে ফেলে যাচ্ছে ছোট্ট ওই চালাঘরটিতে।
চালাঘরটির কথা এজীবনে আর ভুলতে পারবে না সে। যদি আবার কোনদিন এখানে আসা হয় তাহলে চালাঘরটিতে তাকে যেতেই হবে। সেখানে ফেলে যাওয়া স্মৃতির মণিমুক্তাগুলো খুঁজে নেবে। রাতের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে। শ্রাবণীর নাড়াতে সম্বিৎ ফেরে তার। শ্রাবণী তার কানে কানে বলে, খুব মন কেমন করছে বলো ? মনে হচ্ছে আর দুটো চারটে দিন থাকতে পারলে খুব ভালো লাগত। সুযোগ পেলে আবার আসব এখানে।
— ঠিক বলেছিস, একটা দিন, একটা রাত যে কি করে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।আমারও আবার এখানে আসতে খুব ইচ্ছে।
— আসবে তোমাদের বিয়ের পর ?
শ্রাবণীরর কথা শুনে চোখ পাকিয়ে তাকায় অঞ্জলি। বলে , আবার বাসের মধ্যে এসব কথা ? কারও কানে গেলে কি হবে ?
তার কথা শুনে কানে হাত দিয়ে শ্রাবণী বলে , ভুল হয়ে গিয়েছে। একদম খেয়াল ছিল না জানো। তার চেয়ে এসো ছবি দেখি।
কাল সন্দীপের মোবাইল নিয়ে অনেক ছবি তুলেছে শ্রাবণী। মোবাইলের স্কিনে সেগুলো খুলে ধরে সে। দুজনে মন দিয়ে একের পর এক ছবি দেখতে থাকে। কয়েকটা ছবি দেখে বেশ চমকে যায় অঞ্জলি। দেখতে পায় বেশ কিছু ছবিতে সে আর আলাপনবাবু বিভিন্ন ভঙ্গিমায় একেবারে কাছাকাছি রয়েছে। এ ছবিগুলো আবার কখন তুলল শ্রাবণী ? খেয়াল করে নি তো সে। অবাক হয়ে শ্রাবণীর মুখের দিকে চাইতেই সে বলে, বলো কেমন দিলাম ? কায়দা করে কখন ছবিগুলো তুলেছি তোমাকে টের পেতেও দিই নি। ভালো দেখে ক’টা ছবি ওকে বলে প্রিন্ট করিয়ে তোমাকে দেব। কাছে রেখে দেবে আর যখন খুব মন কেমন করবে তখন একবার করে বের করে ঠোঁটে —
শ্রাবণীকে কথা শেষ করতে দেয় না অঞ্জলি। তার আগেই তার ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে মাঝপথেই তার কথা বন্ধ করে দেয়।

ওইসব খুনসুটি করতে করতেই এক সময় অঞ্জলি টের পায় বাসের গতি আচমকা কমে আসে। চালকের দিকে চাইতেই দেখতে পায় সন্দীপ তাকে রাস্তার দিক নির্দেশ করছে।অঞ্জলি বুঝতে পারে শ্রাবণীর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গাড়ি ঢুকছে। তাদের ফেরার রাস্তাতেই পড়ে গ্রামটি। তাই ঠিক ছিল ফেরার পথে শ্রাবণীদের বাড়িতে নামিয়ে দেওয়া হবে। সেই মতো বাসটা ধীর গতিতে যেতে যেতে একটা মাটির বাড়ির সামনে থামে। স্টার্ট বন্ধ হতেই বাইরের দিকে তাকায় অঞ্জলি। দেখে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছেন সাদা শাড়ি মা – মা চেহেরার এক বৃদ্ধা। অঞ্জলির বুঝতে অসুবিধা হয় না ওই বৃদ্ধাই শ্রাবণীর শাশুড়িমা। তারা ভেবেছিল শ্রাবণী আর সন্দীপকে নামিয়ে দিয়েই ফিরে যাবে। কিন্তু তা আর হতে দিলেন না বৃদ্ধা।
তাদের ফিরে যাওয়ার কথা শুনেই বাসের উপরে উঠে আসেন তিনি। তারা সবাই তাকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রনাম করতে যেতেই উনি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন , উহু বাসের মধ্যে তো আমি প্রনাম নেব না। বাসে প্রনাম সেরে আমার বাড়ির দরজা থেকে চলে যাবে সেটি হবে না। প্রনাম করতে হলে নেমে এসো। না হলে বুঝব এই বুড়িটাকে তোমার মা বলে ভাবতে পারছ না। আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। এরপর চলে গেলে বৃদ্ধার মনে দাগা দিয়ে যাওয়া হবে। নিজেদেরও অপরাধী মনে হবে। অগত্যা একে একে নামতে হয় সবাইকে। নেমে প্রনাম করতেই উনি সবার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খান। আলাপনবাবু ও বাদ যান না। প্রনাম পর্ব শেষে তারা বাসের দিকে এগিয়ে যেতেই ফের তাদের হাতে চেপে ধরেব শ্রাবনীর শাশুড়ি। বলেন , প্রনাম করে শুধু মুখে চলে যাবে, তা তো হবে না। ভাত না খাও , টিফিন না করে যাওয়া হবে না। গৃহস্থের কল্যাণ – অকল্যাণ বলেও তো একটা কথা আছে। এক্ষেত্রেও আর কথা চলে না অঞ্জলিদের। সাধাসিধে মানুষটাকে ভালো লেগে যায় অঞ্জলির। না , শ্রাবণীটার ভাগ্য সত্যিই ভালো। কেমন মায়ের মতো শাশুড়ি পেয়েছে।

শুরু হয়ে যায় টিফিন তৈরির তোড়জোড়। সবাই মিলে হাতে হাত লাগিয়ে তৈরি করে লুচি — আলুর দম। সন্দীপ পাড়ার মোড় থেকে নলেন গুড়ের মিষ্টি নিয়ে আসে । খাওয়া দাওয়ার পর ফের শ্রাবণীর শাশুড়িকে প্রনাম করে তার বাসের দিকে এগিয়ে চলে। উনি সবাইকে আশির্বাদ করে বলেন — ভগবান তোমাদের সবাইকে সুখী করুন। সেই কথা শুনে অজান্তেই অনেকের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অঞ্জলিও ভাবে , ভগবান যদি তাদের সুখের কথা ভাবতেন তাহলে কি আর তাদের এই দশা হতো ? তার মনের অবস্থা আন্দাজ করে শ্রাবণী তার কানে কানে বলে, এবার কাল রাতের কীর্তি কলাপের কথা ভাবতে আর আলাপনবাবুর ধ্যান করতে করতে যাও। আমি নেমে গেলাম। বাগড়া দেওয়ার তো আর কেউ থাকল না। কেউ তো আর জানে না ডুবে ডুবে জল খেতে তোমরাও কতবড়ো ওস্তাদ।
শ্রাবণীর কথা শুনে অঞ্জলির চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে আলতো হাতে শ্রাবণীর পিঠে কিল মেরে বাসে উঠে আসে। একসময় বাস চলতে শুরু করে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকে শ্রাবণীরা। তারাও জানলা দিয়ে হাত নাড়ে। আবছা হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায় ওরা। আর কেমন একটা মন খারাপ করা ভাব গ্রাস করে নেয় অঞ্জলিকে। তারই মধ্যে সাবিত্রীদি আবার বায়না ধরে বসেন তাকেও তাদের গ্রাম লাগোয়া রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দেওয়া হোক। তাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে না হলেও মোড়ের উপর দিয়েই বাস যাবে। সেখানে নামিয়ে দিলেই হবে বলে সাবিত্রীদি জানান। কিন্তু হোমের মেয়েরা কিছুতেই সাবিত্রীদিকে ছাড়তে চায় না। সবাই বলে, একই সঙ্গে তুমিও চলে গেলে আমারা হোমে গিয়ে মন বসাতে পারব না ।তার চেয়ে চলো আজ গল্প করে কাটাব। অঞ্জলি বলে, কাল বরং আমি আর আলাপনবাবু তোমাকে দিয়ে আসব। একই সঙ্গে তোমার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর কাজকর্মও দেখে আসা হবে। অগত্যা সবার দাবি মেনে নিতে হয় সাবিত্রীদিকে। সন্ধ্যের মুখে তারা হোমে পৌঁছোয়। তাদের পৌঁছে দিয়ে আলাপনবাবুরাও চলে যান। তারপরই অঞ্জলির মনটা উদাস হয়ে যায়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।