সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৫৯)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৬৪ 

দুজনের চোখে তখন আবেশের ঘোর। দুজনেরই কথা হারিয়ে যায়। বেশিক্ষণ আলাপনবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না অঞ্জলি। গা টা কেমন যেন করে ওঠে তার। একান্ত ভাবে আলাপনবাবুকে পেতে খুব ইচ্ছে করে তার। কিন্তু মনকে সে প্রশয় দিতে চায় না। আগে সে পড়াশোনা শেষ করে নিজেকে আলাপনবাবুর যোগ্য করে তুলতে চায়। আলাপনবাবুও তাকে সেই কথাই বলেছেন। তাই আলাপনবাবুর কথা তাকে রাখতেই হবে। তাছাড়া সে তো সব হারিয়ে বসে আছে। নিজের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তাকে পড়াশোনা করতেই হবে। না হলে তো সে কোন দিনই বাড়িতে ফিরতে পারবে না। এই হোমেই হয়তো কাটে যাবে তার সারাটা জীবন। কিন্তু কিছুতেই সেটা সে পারবে না। গ্রামে তাকে ফিরে যেতেই হবে। আর সে সেখানে যাবে মাথা উঁচু করে। সেই সাধনাই শুরু হয়ে যায় তার। দিন-রাত এক করে পড়াশোনা শুরু করে সে। তিনটে বছর সে আর কোন দিকে মন দেবে না। তার দেখাদেখি হোমের অন্যান্য মেয়েদের মধ্যেও পড়াশোনার প্রবনতা বাড়ে যায়। একটা প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব জেগে ওঠা সবার মধ্যে।একে একে তার বি-এ র প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা হয়ে যায় যথা সময়ে।
তার বি-এ দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষার সঙ্গেই সঞ্চিতারাও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। আরও দু’জন মাধ্যমিকে বসে। সবাই ভালো ভাবে পাশও করে যায়। একে একে সবার রেজাল্ট আলাপনবাবুই নিয়ে আসেন। অঞ্জলি হাই সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ায় আলাপনবাবু গম্ভীর মুখে বলেন , ফাইন্যালটা কিন্তু আরও ভালো হওয়া চায়। সে শুধু ঘাড় নাড়ে। কিন্তু অন্য সবাই আলাপনবাবুকে একটা পিকনকের জন্য চেপে ধরে। সঞ্চিতা বলে , এই মরসুমে সবাই কেমন পিকনিকে যাচ্ছে। আমরাও একটানা পড়ে হাফিয়ে উঠেছি। আমাদেরও ওই রকম একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করুন না স্যার। আলাপনবাবু বলেন , আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না।

বলে সেদিনকার মতো আলাপনবাবু চলে যান। তারপর পিকনিকের কথাটা ধামাচাপা পড়ে যায়। সবাই ধরেই নেয় তাদের ভাগ্যে পিকনিক লেখা নেয়। তাই সেই প্রসঙ্গও আর কেউ কোন কথা তোলে না।তারই মাঝে একদিন ডি,এম সাহেব আসেন হোমে।সঙ্গে আলাপনবাবুও ছিলেন। বিশেষ কোন কাজ না থাকলে ডি,এম সাহেব সাধারণ হোমে আসেন না। তাই সবাই অবাক হয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অঞ্জলি একবার আলাপনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে ডি,এম সাহেবের আসার কারণটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আলাপনবাবুর মুখেও কোন অভিব্যক্তি খুঁজে পাই না সে।কেমন যেন ভাবলেশহীন মনে হয় তার মুখ। তাহলে কি খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে হোমে ?
না হলে এত লুকোছাপা কেন ? এর আগে তো যখন ডি,এম সাহেব এসেছেন তখন কোন না কোন ভালো খবর কিম্বা কাজ নিয়ে এসেছেন।
সেইসব কর্মসূচির আগাম খবর তারা আলাপনবাবুর কাছে থেকেই পেয়েছে। এবারে কি এমন ঘটল , যে সেই আভাষটুকু পর্যন্ত মিলল না। দুঃচিন্তার কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে অঞ্জলির চোখে মুখে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য ডি,এম সাহেবের কথায় সে মেঘ সরে গিয়ে সবার মুখে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে শীতের সোনা রোদ।হোমের সব মেয়েরা তখন জড়ো হয়েছে অফিস ঘরে। সবার মুখের দিকে এক পলক চেয়ে নিয়ে ডি,এম সাহেব বলেন , আজ একটা সুখরব দিতে এসেছি আপনাদের কাছে। এটা শুধু আপনাদেরই নয়, আমাদের জেলা প্রশাসনের কাছেও সুখবর।
ডি,এম সাহেবের কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচে অঞ্জলিরা। ডি, এম সাহেবের কথা শোনার জন্য অধীর হয়ে ওঠে তারা। ডি, এম সাহেব আবার শুরু করেন , আমাদের এই হোম শিক্ষা, কর্ম সংস্থান এবং সামাজিক পুনঃবার্সনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনের জন্য রাজ্যের সেরা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেই জন্য সরকার ঘোষণা করেছে , এই হোম থেকে যারাই বি,এ পাশ করবে তারা সবাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাবে। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই আনন্দে হোমের মেয়েদের নিয়ে শিক্ষামূলক ভ্রমণ তথা একটা পিকনিকের ব্যবস্থা করা হবে। এখন বলুন আপনারা কোথাই যেতে চান ?

মেয়েদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতির বিপাকে পড়ে সবাই দীর্ঘদিন ধরে কার্যত হোমে বন্দী হয়ে রয়েছেন। বাইরের জগত সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই বললেই চলে। তাই সবাই অঞ্জলির মুখের দিকে তাকায়। অঞ্জলির অবশ্য শিক্ষামূলক ভ্রমণ সম্পর্কে ততদিনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে। একটা জায়গার কথা তার মনেও এসেছে।কিন্তু নিজের পচ্ছন্দের কথা সে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায় না। তাই বলটা অন্যদের কোর্টেই ঠেলে দেয় সে।সঞ্চিতাদের উদ্দ্যেশ্য করে সে বলে, হ্যারে হাজারদুয়ারি গেলে কেমন হয় ? বইয়ে পড়া জিনিসগুলো যেমন দেখা হয়ে যাবে , তেমনই সবার গঙ্গাস্নানটাও হয়ে যাবে একেবারে। তার কথা শেষ হয় না , সবাই হই হই করে উঠে। এক বাক্যে সবাই বলে , এর মতো ভালো জায়গা আর হয় না। গঙ্গাস্নানের কথায় কয়েকজন তো মহাখুশী। মেয়েদের মধ্যে গঙ্গাস্নানের আগ্রহ যেন সহজাত।সামনের রবিবারই যাওয়ার দিন স্থির হয়।যেহেতু এতটা দুরের রাস্তা তাই একটা রাত সেখানে কাটিয়ে পরদিন ফেরা হবে। না হলে সব দেখা হবে না। সেই মতো ডি,এম সাহেব বলেন, কোন সমস্যা নেই , ওখানে আমাদের সরকারি গেষ্ট হাউস আছে , সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হাজারদুয়ারি যাওয়াই চূড়ান্ত হয়ে যায়। ঠিক হয় আলাপনবাবুই দায়িত্ব করে নিয়ে যাবে তাদের। সঙ্গে রাধুনি আর একজন সরকারি কর্মীও যাবেন। সাবিত্রীদি, শ্রাবণী আর তার বর সন্দীপকেও সঙ্গে নেওয়া হবে। মাঝে একটা দিন বাকি। উৎসাহ আর উত্তেজনায় সবাই ফুটতে থাকে।খবর পাঠানো হয় সাবিত্রী আর শ্রাবণীর কাছে। শনিবার বিকালেই এসে পৌঁছে যায় তারা।আলাপনবাবু সন্দীপকে নিয়ে কেনা কাটা করেন। এসে পৌঁচ্ছে যায়, হাঁড়ি, কড়াই , গ্যাস, রান্নার সরঞ্জামও। সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে আলাপনবাবু সন্ধ্যার মুখে সন্দীপকে নিয়ে ফিরে যান। একেবারে ভোরবেলায় বাস নিয়ে আসবেন তারা।

হোমে জুড়ে বইছে তখন খুশীর হাওয়া। পিকনিকে যাওয়ার উত্তেজনা তো আছেই, তার উপরে সাবিত্রীদি আর শ্রাবণীকে দীর্ঘদিন পর কাছে পেয়ে সবাই মহা খুশী।শ্রাবণী তো বটেই , সাবিত্রীদিও দাদা-বৌদির সংসারে যে সুখেই আছে তা তার চেহেরাই বলে দিচ্ছিলো।তারা দুজনেই বাড়ি থেকে তাদের জন্য নিয়ে এসেছে নাড়ু, আলুর পাপড়, চিঁড়ে ভাজা সহ নানা রকম খাবার।সেইসব খাবার খেতে খেতে গল্প গুজবে মেতে ওঠে তারা।সাবিত্রীদির মুখেই তারা জানতে পারে দাদা – বৌদিরা তাকে আপন করে নিয়েছে। ভাইপো ভাইঝিরাও তার খুব ন্যাওটা হয়ে পড়েছে।শ্রাবণীর শাশুড়িও নাকি তাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসে।শুনে সবার প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সেদিন আর রাতে কারও খাওয়ার ইচ্ছে হয় না। কথায় কথায় কখন রাত ভোর হয়ে যায় কেউ টের পায় না। কিছুক্ষণ গা গড়িয়েই সবাই একে একে উঠে পড়ে। চোখ মুখ ধুয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। তার মধ্যেই ডেকে ওঠে ভোরের পাখি। হোমের গেটের বাইরে বাসের হর্ণ শোনা যায়।আর তারপরেই সবার মধ্যে তাড়াহুড়ো পড়ে যায়।
আলাপনবাবু জিনিসপত্র বাসে তুলতে তুলতে তাদের তাড়া লাগায়। চা খেয়ে সবাই বাসে গিয়ে ওঠে। তখন সবে আলো ফুটি ফুটি ভোর। সারা রাস্তা বাসে গল্প, গান, হাসি হুল্লোড় করতে করতে আসে তারা। জীবনে এত আনন্দ বোধ হয় কেউ পায় নি। মাঝে একবার বাস থামিয়ে মুড়ি তেলে ভাজা তুলে নেওয়া হয়। তাই খেতে খেতে তারা পৌঁছে যায় হাজারদুয়ারী। চারিদিকে ঘোড়ার গাড়ি , বিশাল বড়ো, বড়ো পুরনো পুরনো সব বাড়ি। মনে হয় যেন ইতিহাসের রাজ্যে এসে পৌঁছে গিয়েছে তারা। এক মুহুর্তের জন্য অঞ্জলির মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। ভাইটাকেও যদি আনতে পারত ! ওরও নিশ্চয় খুব আনন্দ হতো।যদি কোনদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তাহলে ভাই, মা , দিদি , জামাইবাবুকে নিয়ে আসবে এখানে। আর বাবা ? বাবাকে খুঁজে পেলে তাকেও আনবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবাকেও খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে সে।

বাড়ির কথা ভাবতে ভাবতেই তারা পৌঁচ্ছে যায় গেষ্টহাউসে। একেবারে গঙ্গার প্রান্ত ছোওয়া গেষ্ট হাউসটি দেখেই মন ভরে যায় অঞ্জলির। গেষ্ট হাউসের ভিতরেই রয়েছে ছোট্ট একটা বাঁধানো ঘাট। সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে নৌকায় নদী পারাপার করছে মানুষ। অন্যপাড়ের জনবসতি যেন ভিন্ন কোন জনপদ মনে হয়। আলাপনবাবু সবাইকে স্নান করে দ্রুত রেডি হয়ে নিতে বলেন। তারপরই ঘুরতে বেরোনা হবে। ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে ফের বেরোনা হবে। তাদেরকে তাড়া দিয়েই আলাপনবাবু রাঁধুনি, তার সংগী এবং আর একজন সরকারি কর্মীকে নিয়ে রান্নার জায়গা নির্বাচন করতে বেড়িয়ে পড়েন। তারা রেডি হতে না হতেই তিনটে টাঙা নিয়ে ফেরেন আলাপনবাবু। একে একে গিয়ে সবাই বসে টাঙাতে।অঞ্জলির টাঙাতেই ওঠেন আলাপনবাবু। যেতে যেতেই তারা দেখতে পায় একটি আমবাগানে তাদের রান্নাবান্নার যোগাড় হয়েছে।কয়েকজন ছেলে ছুটতে ছুটতে তাদের পিছু নেয়। তারা আশ্চর্য্য হয়ে তাকায়। বুঝতে পারে না ছেলেগুলো তাদের গাড়ির পিছনে পিছনে ওভাবে ছুটছে কেন ? তাদের কৌতুহল দেখে আলাপনবাবু বলেন , ওরা গাইড। টাকার বিনিময়ে দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে। ব্যাখা করে বলে দেবে ইতিহাসের কথা।
অঞ্জলি বলে , তাহলে তো নিলেই ভালো হয়।
আলাপনবাবু বলেন , তার দরকার হবে না। আমিই ওই কাজটা করে দিতে পারব।
সবাই অবাক হয়ে তাকায় আলাপনবাবুর দিকে। আলাপনবাবু ছেলেগুলো হাতের ইশারায় তাদের প্রয়োজন নেই বলে নিরস্ত করেন। কথায় কথায় জানা যায় , এর আগে দুবার শিক্ষামূলক ভ্রমণে এখানে এসেছিলেন আলাপনবাবু। তারপর পড়াশোনাও করেছেন এখানকার ইতিহাস নিয়ে।ইতিহাসটাকে তিনি যে গুলে খেয়েছেন তার নজির মিলল তার কথাবার্তায়। একে একে জাহানকোষা কামানের ইতিকথা থেকে নবাব প্যালেস, ইমামবাড়া, মতিঝিল, তোপখানা, নাচঘর, বিভিন্ন সমাধি প্রভৃতি জায়গার ইতিহাস এমন সুন্দর ভাবে তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন যে সবাই আলাপনবাবুর মুখের দিকেই অবাক হয়ে বিষ্ময়ে চেয়েছিল।

দুপুরে খাওয়া — দাওয়ার পর নৌকা পেরিয়ে তারা গিয়েছিল নশিপুরের রাজবাড়ি কাটরা মসজিদ সহ আরও কয়েকটি জায়গায়। সন্ধ্যার মুখে যখন গেষ্ট হাউসে ফেরে তখন সবাই ক্লান্তিতে আর দাঁড়াতে পারছে না। আসলে সবার চোখ টানছিল। একে গত রাতে কেউ ঘুমোয় নি , তার উপরে সারাদিন ঘোরাঘুরির ধকল আর শরীর নিতে পারছিল না। তাই সবাই বিছানা নেয়। একটু ছাড়া ছাড়ি দুটো ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। একটাতে মেয়েরা, অন্যটাতে ছেলেরা। বিছানায় পড়তেই সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ঘুম আসে না কেবল অঞ্জলির। তার কানে যেন তখনও মধু ঢেলে চলেছে আলাপনবাবুর সেই ইতিহাসের ব্যাখ্যা। কি সুন্দর করে বলছিলেন তিনি।সবাই তার দিকে কেমন বিষ্ময় ভরা দৃষ্টিতে চেয়েছিল। তাই দেখে অঞ্জলির মনে একটা চাপা গর্ববোধও হচ্ছিল। এই মানুষটাই তার একান্ত আপন। একেবারে নিজের মনের মানুষ।ওইসব কথা ভাবতে ভাবতেই কিছুতেই ঘুম আসে না তার। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় উশখুশ করে বারন্দায় বেরিয়ে আসে। বারন্দা থেকেই দেখা যায় গঙ্গা। চাঁদের আলো পড়ে গঙ্গার শোভা তখন আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। সেই শোভা দেখতে দেখতেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেবে ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই থমকে যায় অঞ্জলি। দেখে গঙ্গার দিকে মুখ করে কেউ একজন একমনে সিগারেট টেনে চলেছে। গেষ্ট হাউসে আরও অনেক বাইরের লোক আছেন। তারাই কেউ হবে ভেবে সে ঘরের দিকে ফিরতেই তার পায়ের শব্দে লোকটি মুখ ফেরায়। আর তার দিকে চেয়ে অঞ্জলির হৃদয়টা দুলে ওঠে। আধো অন্ধকারেই সে বুঝতে পারে লোকটি আর কেউ নয়, এতক্ষণ মনে মনে সে যার কথা ভাবছিল সেই মানুষটিই দাঁড়িয়ে আছে তার অদুরে। তার মতো আলাপনবাবুও তাহলে ঘুমোতে পারেন নি ? মনটা খুশিতে ভরে যায়।

কিন্তু চরম দোটানায় পড়ে যায় সে। একা রাতে আলাপনবাবুর কাছে যাওয়া কি উচিত হবে তার ? ঘুম ভেঙে কেউ যদি দেখে ফেলে তাদের ? তাহলে আর লজ্জার শেষ থাকবে না। সেই দোটানার মাঝেই আলাপনবাবু তাকে ডাকেন — ঘুম আসছ না বুঝি ? এসো রাতের গঙ্গার মোহময়ী রূপ দেখি।ওই ডাক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না অঞ্জলি। গুটি গুটি পায়ে সে আলাপনবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আলাপনবাবু তার হাতটা তুলে নেন নিজের হাতে। চুপচাপ দুজনে চেয়ে থাকে গঙ্গার দিকে। কেউ কোন কথা বলেতে পারে না। কিন্তু সেই নিস্তব্ধতাই যেন অনেক কথার জন্ম দেয়। কিন্তু আচমকা পায়ের শব্দে ভেঙে যায় সেই নিস্তব্ধতা।অঞ্জলি চেয়ে দেখে তাদের ঘর থেকে এক নারী মূর্তি আর আলাপনবাবুদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এক পুরুষ মুর্তি। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে দুজনে দুদিকে ছিটকে যায়। তাদের ওই অবস্থা দেখে নারী মূর্তি বলে ওঠে , ভয় নেই আমরা। গলা শুনেই অঞ্জলি বুঝতে পারে নারী মূর্তিটি শ্রাবণী।
যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে তার। আর যাই হোক শ্রাবণী এই ঘটনার কথা রসিয়ে রসিয়ে পাঁচ কান করে বেড়াবে না। ততক্ষণে এগিয়ে আসে সন্দীপও। দুজনকে একসঙ্গে দেখে অবাক হয়ে যায় অঞ্জলি। তাহলে দুজনে তাদের ফলো করছিল ? শ্রাবণী তার ভুল ভেঙে দেয়। সে বলে , আমারও ঠিক করে রেখেছিলাম সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বাইরে বেড়িয়ে একসঙ্গে গল্প করে কাটাব। রাত্রি ১২ টায় সময় ঠিক করে রেখেছিলাম। সেই মতো বেরিয়ে দেখি এই কাণ্ড। চলো চলো , আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই।গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি। অঞ্জলি ভেবে দেখে , শ্রাবণীদের কাছে আর লুকানোর কিছু নেই। তাছাড়া তারা দুজন সঙ্গে থাকলে কেউ জেগে উঠে তাদের দেখলে অন্য কিছু ভাববে না। তাই আলাপনবাবুর হাত ধরে তারা এগিয়ে যায় গঙ্গার ধারে। গেষ্ট হাউসের ভিতরেই গঙ্গার ধার বরাবর ছোট ছোট গোলাকার খড়ের ছাউনির চালা ঘর। বিপরীতমুখী দুটি চালায় আলাদা আলাদা ভাবে গিয়ে বসে তারা। সেই চালাঘরে আলাপনবাবু তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। অঞ্জলির ঠোঁট নেমে আসে আলাপনবাবুর ঠোঁটে। ফিং ফোটা জ্যোৎস্নায় তখন ভেসে যাচ্ছে চরাচর।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।