সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৫১)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৫১

সেই ব্যাথার প্রলেপ হয়ে আসে আলাপন ঘোষ। আলাপনবাবু সমাজ কল্যাণ দফতরের জুনিয়ার অফিসার। কয়েকদিন হলো ডি , এম সাহেব তাকে এই হোমের প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করেছেন। খুবই অল্প বয়েস। মিস্টি স্বভাবের গুণে অল্প দিনেই সবার প্রিয় হয়ে উঠেছেন। হোমের সর্বময় কর্তা হয়েও একটুকু খবরদারি করেন না। বরং সবাইকে দিদি – বোন সম্পর্ক ধরে কথা বলেন।হোমের মেয়েদের কি করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো যায় তা নিয়ে নানা রকম ভাবনা চিন্তা করেন। অঞ্জলিরও ভালো লেগে যায় আলাপনবাবুকে।একদিন মনের খেয়ালে হোমের খেজুর গাছ থেকে পাতা আর পড়ে থাকা রাংতা কাগজ দিয়ে ঝুড়ি বুনছিল সে। কখন আলাপনবাবু পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন টের পায় নি। তার হাত থেকে ঝুড়িটা নিয়ে বলেন — বাঃ খুব সুন্দর তো। তুমি এই কাজ অন্যদের শেখাতে পারো তো ?
নিজের কাজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে অঞ্জলির। তবু কিছুটা অস্বস্তি হয়। অস্বস্তির সঙ্গেই সে বলে, আমাদের আদিবাসী সমাজে খেজুরের পাতার তালাই, ঝুড়ি, শর আর ব্যানা কাঠির ঝাঁটার খুব কদর আছে।ছোট থেকেই মেয়েরা মা ঠাকুরমার কাছে থেকে শিখে যায়। অবসর সময়ে ওইসব সামগ্রী তৈরি করে রাখে তারা।
তারপর গ্রামে গ্রামে
ঘুরে ঘুরে কিম্বা হাটে চাল — টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে। সেই টাকাতেই তাদের ছোটখাটো প্রয়োজন মিটে যায়।
— বাঃ, এই বিষয়টাকেই কাজে লাগাতে পারলে হোমের মেয়েরা একদিন স্বনির্ভরতার স্বাদ পাবে। তুমি কাল থেকেই শুরু করে দাও। আপাতত ঝুড়ি , তালাই , আর ঝাঁটা দিয়ে কাজ শুরু হোক। তারপর আর অন্য জিনিসপত্র তৈরির বিষয়েও জোর দেওয়া হবে।
— কিন্তু আমি কি পারব ?
— পারতেই হবে। খোদ ডি,এম সাহেব তোমার উপর খুব ভরসা করেন।

                       আর কিছু বলতে পারে না অঞ্জলি। পরদিনই হোমে এসে পৌঁছোয় খেজুর পাতা, সর, ব্যানাকাঠি আর রাংতা কাগজ। হোমের মেয়েদের মধ্যে চরম উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। অঞ্জলি হাতে ধরে সবাইকে শেখাতে শুরু করে। অল্প দিনেই সবাই রপ্ত করে নেয় কাজগুলো। আলাপনবাবুই জিনিস গুলো সরকারি কর্মীদের কোয়ার্টার গুলিতে বিক্রির ব্যবস্থা করেন। প্রথম দফাতেই খরচ খরচা বাদ দিয়ে ১০০ টাকা লাভ দাঁড়ায়। তাতেই হোমের মেয়েদের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখা দেয়। সাবিত্রী - অতসীদিরা বলে -- লাভটা বড়ো কথা নয় , আমরা যে কিছু করতে পারছি সেটাই আসল। এতদিন তো শুধু খেয়েছি , ঘুমিয়েছি আর লাঞ্ছিত হয়েছি। আমরাও যে মানুষ সেটাই ভুলতে বসেছিলাম। আজ মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে আমরাও কিছু করতে পারি।

তারই মধ্যেই শ্রাবণী আর সুদেষ্ণা আবার একটু হিসেবী। তারা জানায় , এই জিনিসগুলোই যদি আরও একটু রং-চঙ করে মেলায় মেলায় স্টল দিয়ে বিক্রি করা হয় তাহলে লাভের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
অঞ্জলি বলে , তা তো হয়ই। আমাদের গ্রাম থেকে পাইকারেরা কম দামে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গিয়ে মেলায় মেলায় বেশি দামে বিক্রি করত বলে শুনেছি।
এজন্য তারা ওই সব জিনিসপত্র তৈরির করতে আগাম টাকাও দিয়ে যেত। তারজন্য অবশ্য তাদের অনেক কম দামে মাল দিতে হত। কিন্তু এখানে কে অত টাকা দেবে ? মেলার জন্য মাল তৈরি করে জমা রাখতে হলে তো টাকা চায়। অনেক টাকার কথা শুনেই চুপসে যায় সবার মন। কথাটা আলাপনবাবুর কানে পৌঁছোয়। তিনি বলেন , খুব ভালো চিন্তা। টাকার সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অঞ্জলি জিজ্ঞেস করে , কে যোগাবে আমাদের এত টাকা ?
—- সরকার এখন মহিলাদের স্বনির্ভতার লক্ষ্যে স্বসহায়ক গোষ্ঠীর মাধ্যমে খুব কমসুদে ভরতুকি যুক্ত ঋণ দিচ্ছে। সেটার যদি ব্যবস্থা করা যায় তাহলে টাকার সমস্যা হবে না।
অঞ্জলি বলে, সে তো জানি। আমাদের পাড়াতেও আছে। ঋণও পেয়েছে। পাড়ার সবাই বলে গ্রুপ লোন। কিন্তু তার জন্য ব্যাংকের বই চায় আগে। এখানে কি করে আমাদের ব্যাংকের বই হবে ? আমাদের না আছে ভোটার কার্ড , না আছে রেশন কার্ড।

                              ওই কথা শুনে অঞ্জলির মুখের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন আলাপনবাবু।চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে অঞ্জলি বলে -- কি আমি কিছু ভুল বললাম।

— না, না ভুলের তো কোন প্রশ্নই নেই। আমি ভাবছি তুমি কত এডভান্স । তুমি যা জানো অনেক শিক্ষিতা মহিলাও তা জানেন না।
— এই দেখুন , আপনার আবার শুরু হলো তো।
দ্রুত আগের প্রসঙ্গে ফিরে যায় আলাপনবাবু । কিছুটা চিন্তাগ্রস্থ গলায় বলেন, তুমি যেটা বলেছে সেটা সাময়িক একটা সমস্যা বটে। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি ডি, এম সাহেবের সঙ্গে কথা বলব। আশাকরি একটা সমাধান সুত্র নিশ্চয় বেরোবে।
— আরও একটা সমস্যা আছে।
— আবার কি সমস্যা।
— ব্যাংক এখন নিয়ম করেছে গ্রুপের কাজে টিপছাপ দিয়ে লেনদেন চলবে না , সবাইকে সই করতে হবে। সেই শুনেই না আমাদের পাড়ার গ্রুপের মেয়েরা একে তাকে ধরে নাম সই করা শিখেছে। কিন্তু এখানে তো বেশির ভাগই সই করতে জানে না।
—- ঠিক কথা। এই জন্য আগে নাম সই করা শেখাটা জরুরী। তবে শুধু নাম সই নয় , আমি চাই হোমের মেয়েরা সবাই পড়াশোনা করে অন্তত পক্ষে একটা করে পাশ করুক।

                ওই কথা শোনার পরই গুঞ্জন ওঠে মেয়েদের মধ্যে। সবাই বলাবলি করে -- এই বয়সে আবার লেখাপড়া মানায় নাকি ?

কথাটা শোনামাত্রই আলাপনবাবু বলেন — লেখাপড়ার কোন বয়েস নেই।
আর শেখার কোন শেষ নেই। আপনাদের মধ্যে অঞ্জলিই সব থেকে বেশি ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে। আপাতত অঞ্জলিই আপনাদের নাম সইয়ের পাশাপাশি লেখাপড়া শেখাবে। তারপর তো আমি আছিই। কাল থেকে হাতের কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া শিখতে হবে আপনাদের। আমি কালই আপনাদের জন্য বইপত্র পাঠিয়ে দেব।পরদিন সকালেই পৌঁচ্ছে যায় বইপত্র। কাজ বেড়ে যায় অঞ্জলির। শ্রাবণীকে নিয়ে সে বসে যায় বইয়ে মলাট দিতে। তারপর প্রতিটি বইয়ের উপরে নাম লিখে তুলে দেয় সবার হাতে। আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্লেটে নাম লিখে হাত ধরে ধরে বোলানো রপ্ত করায় একে একে। দুপুরের পর চলে তালাই, ঝুড়ি, আর ঝাঁটা তৈরির কাজ। ঝিমিয়ে থাকা হোমটা যেন সরগরম হয়ে ওঠে। কয়েকদিনের চেষ্টাতেই অধিকাংশই নাম সই শিখে যায়। অতসীদি আর বন্দনাদিই কেবল পারে না। অঞ্জলি কপট রাগ দেখিয়ে বলে — এবার কিন্তু তোমরা দুজনে বকুনি খাবে। তোমাদের জন্যই আমি বর্ণ পরিচয় শুরু করতে পারছি না।
সবাই বলে — এই তো দিব্যি সই করা শিখে গিয়েছি। আবার বর্ণ পরিচয় শিখে কি হবে ?
—- আরে এতদিন যেটা শিখলে সেটাকে আঁকসই বলে। দেখে দেখে অনেকটা ছবি আঁকার মতো ব্যাপার। ব্যাংকের প্রয়োজনে তোমাদের ওটা তড়িঘড়ি শিখিয়ে দেওয়া হলো। এবার কি করে ওই নাম সইটা হলো তা বর্ণপরিচয় না শিখলে জানবে কি করে ? আর শুধু তো বর্ণপরিচয় নয়, আরও অনেক কিছু শেখার আছে। এ,বি,সি,ডি, নামতা-চন্দ্র সব কিছু পড়তে হবে কিন্তু।
শ্রাবণী বলে , ওরে বাবারে তুমি তো একেবারে মাস্টারিনী হয়ে উঠেছে গো দিদি।
— আমি কিন্তু খুব রাগী মাস্টারিনী। পড়ায় ফাঁকি দিলে কারও নিস্তার নেই।
বয়সে বড়ো যারা তারা বলে — পড়া না পারলে তুই আবার মাস্টারদের মতো মারবি নাকি আমাদের। পারিনা না বাবা এই বয়সে মার খেতে। তার চেয়ে কই কি করতে হবে বল ?
অঞ্জলি দেখে , হাতের কাজ আর আঁকসই শেখাতে গিয়ে কখন সে যেন সবার আরও আপনার জন হয়ে উঠেছে। সবাই তাকে ভরসা করতে শুরু করেছে। সেও সবাইকে নিয়ে কাজের মধ্যে মেতে থাকে। তারই মধ্যে সুখবর আসে হোমে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।