সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ২৪)

সালিশির রায়

কিস্তি – ২৪
সে রাতেও এমনি করেই বেজেছিল ধামসা – মাদল। কিন্তু সেই রাতটা ছিল তাদের দুঃশ্চিন্তা আর দুঃসহ যন্ত্রনার। সেই রাত যেন ছিল অনেক দীর্ঘ। কিন্তু আজকের রাত আনন্দের , স্বস্তির। তাই কখন যে রাত শেষ হয়ে যায় তা জানতেও পারে না তারা। সকালে উঠেই দেখে এক রাতেই বদলে গিয়েছে পাড়ার পরিবেশটা। যারা এতদিন তাদের এড়িয়ে যেত তারাই এখন ডেকে ডেকে কথা বলছে। অন্যদিকে কালীরাম এবং তার পারিষদরাই একঘরের মতো হয়ে গিয়েছে। তবে অঞ্জলি অবশ্য তা নিয়ে একটুও পুলকিত নয়। সে চায় গ্রামের সবাই মিলেমিশে থাকুক। সালিশিসভার অনুশাসনে যেন তাদের মতো অবস্থা কারও না হয়। এমনিতে তারা এতদিন বাইরের কল থেকে জল এনেই মুখ ধুয়েছে। আজ পরিবেশটা অনুধাবণ করতেই কলতলায় মুখ ধুতে যায়। মুখ ধুতে ধুতেই সে দেখতে পায় রামবাবু আসছেন।
অঞ্জলি বুঝতে পারে , নিশ্চয় বাবাকে কোন পরামর্শ দিতে আসছেন। মোড়ল নির্বাচনের খবরটা নিশ্চয় তারা কালই পেয়ে গিয়েছেন। সে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে ফেরে। আজ তার অনেক কাজ। দুপুরে খাওয়ার পর দিদি বাড়ি যাবে। হৃদয়দা দিয়ে আসবে। আজ অবশ্য হৃদয়দা নিজের বাড়িতেই খেয়ে আসবে। তবু দিদির জন্য তো সকাল সকাল রান্না করতে হবে। রামবাবুদের জন্য চা করে দিতে হবে। এমনিতে তাদের বাড়িতে চায়ের তেমন চল নেই। শুধু তাদের কেন, অধিকাংশ আদিবাসী পরিবারেই চায়ের চল নেই। অধিকাংশই সকালে রান্নাবান্না করে। ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার ঢাকা রেখে স্বামী স্ত্রী খেয়ে দেয়ে কাজে চলে যায়। কেউ বা আগের রাতের পান্তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। যাদের যেদিন সারাদিনের কাজ থাকে তারা সেদিন টিফিন ক্যারিয়ারেও একই খাবার নিয়ে যায়। কিন্তু কাল রামবাবু বাবার হাতে টাকা দেবার সময় বলেছিলেন , সামনেই বিধানসভা নির্বাচন। বিরোধীরা আদিবাসীদের নানা প্রলোভন দিয়ে ভোট টানার জন্য গোপনে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে। বিরোধীদের ওই উদ্দ্যেশ্য বানচাল করতে তাদের পার্টিও ঠিক করছে আদিবাসী পাড়াগুলোতে বিশেষ নজর দেবে।
তাদের বাড়িকে সেন্টার করে সেই কর্মসূচি পরিচালিত হবে। এজন্য বিভিন্ন স্তরের নেতারা আসবেন। তাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তাতে লিকার চা হলেও চলবে। সেই মতো অঞ্জলি মোড়ের দোকান থেকে চা-চিনি, গুড়ো দুধ , বিস্কুট, কয়েকটা লেবু আর কিছু কাপ আনা করিয়েছে। বাড়ি ঢুকেই দেখে রামবাবু আর একজন লোক চারপায়ে বসে বাবার সঙ্গে ভোট নিয়েই কথা বলছে। চা–বিস্কুট দিতে গিয়েই অঞ্জলি শুনতে পায় রামবাবুর সঙ্গে লোকটা বাবাকে বলছে, এবারে আমাদের সামনে কঠিন লড়াই , গদি বাঁচানোর চ্যালেঞ্জ।এতদিন আদিবাসীদের ভোট আমাদের একচেটিয়া ছিল। কিন্তু সেই ভোটে থাবা বসাতে বিরোধীরাও উঠে পড়ে লেগেছে। আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করছে। তাই সবাইকে এককাট্টা করে বিরোধীদের গ্রামে ঢুকতই দেওয়া হবে না। তাড়া করে বের করে দিতে হবে। ওদের যারা বসার জায়গা দেবে প্রয়োজনে তাদেরও গ্রাম ছাড়া করতে হবে। কথাটা শুনে খুব একটা ভালো লাগে না অঞ্জলির। রামবাবুদের দলের জন্য আদিবাসীদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই , কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এইভাবে গ্রামের মানুষকে নিজেদের মধ্যে ঝামেলায় জড়ানোর ইন্ধন দেওয়াটা সে মেনে নিতে পারে না। বিরোধীদের গ্রামে থেকে তাড়া করে বের করে দেওয়ার নির্দেশটাও ভালো লাগে না তার।
ওই করতে গিয়ে কোর্ট- কাছারি একটা কিছু যদি হয়ে যায় ? প্রথম প্রথম অবশ্য দল পাশে থাকবে। তারপর আর ফিরেও দেখবে না। তাদের পাড়াতেই তো এমন অনেকে আছে , যাদের ধারদেনা করে কোর্টে হাজিরা দিতে যেতে হয় বুড়ো বয়সে।আর যে দলের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তাদের ঘাড়ে ওই মামলা চেপেছিল, সেই দল আর কোন খোঁজখবর পর্যন্ত রাখে না। রামবাবুদের দল যদি ভালো কাজ করেই থাকে তাহলে তো লোকে তাদেরই ভোট দেবে। তাহলে ক্ষমতা হারানোর এত আশঙ্কা কেন ? আসলে রামবাবুদের দলেও এখন কিছু খারাপ লোক ঢুকে গিয়েছে। তারাই এখন আগেকার বাবুদের পার্টির মতো হয়ে গিয়েছে। নানা ফিকিরে আদিবাসী মেয়ে–বৌদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করছে। তাই আদিবাসীদের কেউ কেউ ক্ষোভে ফুঁসছে। সেইজন্যই নাকি রামবাবুদের এত ভয়। এতসব কথা তার জানার কথা নয়। অরুণস্যারের বাড়িতে সে ওইসব কথা শুনেছে। স্যারের বাড়িতে মাঝে মধ্যে বোলপুর থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষক মশাই আসেন। তার সঙ্গেই স্যার একদিন ওইসব কথা আলোচনা করছিলেন।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর রামবাবু বলেন, আমাদের সরকার আদিবাসীদের উন্নতির কথা কত ভাবে দেখ। তোমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য আলাদা হোস্টেল করে দিয়েছে। বনডাঙ্গা হোস্টেলে আমরা দুটো কোটা পেয়েছি। একটা দিয়েছি সেকমপুরের মোড়ল ঘোষাল মুদির ছেলেকে। বাকিটা রেখেছি তোমার ছেলের জন্য। এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে। খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনা একেবারে নিঃখর্চায়। রামবাবুর এই প্রস্তাবটা তার খুব ভালো লাগে।আবার পরক্ষণেই ভাবে, ভাই চলে গেলে সে একা সবদিক সামাল দেবে কি করে ? কিন্তু তা বলে এত ভালো একটা সুযোগ হাতছাড়া করতেও মন চায় না তার। বিষয়টি নিয়ে দিদির সংগে কথা বলতে হবে। সে দ্রুত হাতে রান্নাটা শেষ করে নেয়। খাওয়ার সময় দিদির কাছে কথাটা পাড়ে। দিদি বলে, হলে তো খুব ভালো হবে। কিন্তু তুই কি সবদিক সামল দিতে পারবি ?
— একটু চাপ হবে ঠিকই , কিন্তু ভাইকে ওখানে পাঠাতে পারলে খুব ভালো হবে। জামবুনির দুটো ছেলে তো হোস্টেল থেকে পড়ে গতবছর লাভপুরের দুটি স্কুলে মাস্টারি করছে।আমরা তো পয়সা খরচ করে বেশি দুর পড়াতেও পারব না। তাই কষ্ট হলেও ভাইকে পাঠাতে হবে। তাছাড়া তুই আছিস আর — —
—- আর হৃদয়দা তো আছে তাই না ?
সে কোন জবাব দেয় না। দিদিই বলে, ঠিক আছে দে তাহলে পাঠিয়ে। আমি যখন যেমন সময় পাব এসে দু’চারদিন কাটিয়ে যাব। হৃদয়ও তো রইল। তাদের আলোচনার মাঝেই বাইক নিয়ে হাজির হয় হৃদয়দা। বেলা পড়ে আসছিল বলে দিদিও আর দেরি করতে চাইছে না। দিদিকে পৌঁছে দিয়ে হৃদয়াদাকে ফিরতে হবে। বাবা–মা’য়ের কাছে বিদায় নিয়ে দিদি ভাইকে আদর করে বলে, বাবু হোস্টেলে ভালো ভাবে থাকবে। আমরা মাঝে মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব , ছুটিতে বাড়ি নিয়ে আসব। ভাই ঘাড় নাড়ে। দিদি ভাইয়ের হাতে ৫ টা টাকা দিয়ে মোটর বাইকে গিয়ে বসে। সে ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে দিদির হাতে তুলে দেয়। মোটর বাইক এগিয়ে যায় তাদের পিছনে ফেলে। যতক্ষণ দৃষ্টি চলে ততক্ষণ দিদি পিছন দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে থাকে। তারাও দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে। একসময় মিলিয়ে যায় বাইক। কেমন একটা নিঃসঙ্গ ভাব ঘিরে ধরে তাকে। এই কয়েকদিন দিদি যেন বাড়িটাকে ভরিয়ে রেখেছিল। ভাই চলে গেলে আরও শুন্য হয়ে যাবে বাড়িটা। তবু ভাইকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিতে হবে।
সন্ধ্যের মধ্যেই একটা ছোট্ট বাক্স নিয়ে ফিরে আসে হৃদয়দা। বাক্সটা দেখে অঞ্জলি কিছুটা অবাক হয়। হৃদয়দা বাক্সটা নিয়ে ভিতরে ঢোকে। ইশারায় অঞ্জলিকে বাক্সটা খুলতে বলে। বাক্সটা খুলতেই দেখা যায় বাচ্চাদের দু’সেট জামা প্যান্ট, সাবান, পেষ্ট, ব্রাস সহ আরও কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র। সেগুলো দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হৃদয়দার দিকে চেয়ে থাকে সে। হৃদয়দা বলে, কি হলো কিছু বলছো না যে, পচ্ছন্দ হয় নি ?
— না, ভাবছি এসব কার জন্য ?
— তুমি দেখছি আস্ত একটা টিউবলাইট। সহজে জ্বলবে না। আরে দুলাল যে হোস্টেলে যাবে, ওর তো এসব লাগবে নাকি ?
—- কোন কথা বলতে পারে না অঞ্জলি। এই জিনিসগুলোর কথাই তো ভাবছিল সে। কিন্তু কিভাবে যোগাড় হবে ভেবে পাচ্ছিল না। হৃদয়দা কি তার মনের ভাব আন্দাজ করেই ওসব কিনে আনল ? একেই বোধ হয় বলে ভালোবাসা। মুখে না বললেও প্রিয়জনের মনের কথা ভালোবাসার মানুষই তো উপলব্ধি করতে পারে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।