সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ১৬)

সালিশির রায়

কিস্তি — ১৬ 

বাইরে থেকে দেখে বৌদির সম্পর্কে কত খারাপ ভেবেছিল। বাইরেরটা দেখে মানুষকে বিচার করাটা যে ঠিক নয় তা অনুভব করে অঞ্জলি। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় স্বস্তির ঘুম নেমে আসে সবার চোখে। অঞ্জলি শুধু ভাবে, বৌদির গয়নাটা পরাণকাকুদের বাড়িতে বন্ধক দিলে টাকাটা পাওয়া যাবে। কিন্তু গয়নাটা ছাড়াবে কি করে ? কোন উপায় খুঁজে পায় না সে। কিন্তু যেমন করেই হোক গয়নাটা সে ফিরিয়ে দেবেই। মেয়েদের কাছে এমনিতেই গয়না খুব প্রিয় জিনিস, তার উপরে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া গয়না। তার কথাতেই তো বৌদি গয়না দিতে রাজী হয়েছে , তাই যেমন করেই হোক ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থাও তাকেই করতে হবে। ভোর ভোর দাদা- বৌদি বেরনোর উপক্রম করতেই পথ আটকায় পাড়ার লোকেরা।
অঞ্জলি বুঝতে পারে জরিমানা না দিয়ে তারা যাতে গ্রাম ছেড়ে পালাতে না পারে তারজন্য সারারাত পাড়ার লোকেরা তাদের বাড়ি ঘিরে পাহারায় ছিল। জরিমানার টাকা আনতে যাচ্ছে শুনে অবশ্য দাদা বৌদিকে যেতে দেয় ওরা। কিন্তু সাফ জানিয়ে দেয় ওরা না ফেরা পর্যন্ত আর কেউ বাইরে যেতে পারবে না। বলে না দিলেও এটা অঞ্জলির জানাই ছিল। তাই দাদারা রওনা দিতেই বাড়ির ভিতের ঢোকে সে। ঠিক হয় বিকালের মধ্যেই ওরা গয়না নিয়ে ফিরলে সে আর বাবা পরাণকাকুদের বাড়ি যাবে। পরাণকাকুকে আগে থেকে একটু জানিয়ে রাখতে পারলে ভালো হত। বাড়িতে যদি অত টাকা না থাকে তাহলে তখন ছুটতে হবে আমোদপুরের মনোজ স্যাকরার কাছে। সে একই ব্যাপার , পরাণকাকুর কাছে টাকা নিলে মাসে শতকরা ৫ টাকা ধরাট দিতে হবে, মনোজ স্যাকরাও তাই নেয়। একটু দুরে যেতে হবে এই যা।
তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গয়নাটা ছাড়াতে হবে। না হলে সুদ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছোবে তখন সেই গয়না ছাড়ানোটাই লোকসানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাদের পাড়ার অনেকেই গয়নাগাটি তো বটেই , অভাবের সময় থালা-বাসন বন্ধক দিয়ে আর ছাড়াতে পারে নি। সেবারে ভাইয়ের ডাইরিয়ার মতো হয়েছিল। ভর্তি করানো হয়েছিল লাভপুর হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছিল , ৭ বোতল স্যালাইন লাগবে। দুবোতল স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মিলবে , বাকিটা কিনতে হবে। বাবা দিদির বিয়ের জন্য করানো নাকফুলটা নিয়ে ছুটেছিল মনোজ স্যাকারার কাছে। সেই নাকফুলটা আর ছাড়ানো যায় নি। দিদির কথা মনে পড়তেই বিষন্ন হয়ে পড়ে অঞ্জলি। দিদির তো এসময় এখানে থাকারই কথা ছিল। বাদনা পরবে তার দিদির শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। সে গেলে দিদি-জামাইবাবু তার সঙ্গেই আসত।
বাবা শিকার পরবে গিয়েছিল বলে সে দিদির বাড়ি যেতে পারেনি । ভাগ্যিস পারে নি। তাহলে জামাইবাবুর সামনে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হত তাদের। আদিবাসী অধ্যুসিত সব গ্রামেই অবশ্য সালিশি সভার প্রচলন রয়েছে। কিন্তু নতুন জামাইয়ের সামনে শাশুড়ির ওই ধরণের হেনস্থা হলে মরমে মরে যেত হত তাদের। দিদির শ্বশুরবাড়িতে ও তার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা ছিল। তাদের গ্রামের এই খবর যদি সেখানেও ছড়িয়ে পড়ত তাহলে আর মায়ের কোনদিনই দিদির বাড়ি যাওয়া হত না। কারণ দিদির বাড়িতে থাকাকালীন সেখানে কারও অসুখ বিসুখে মৃত্যু হলে সন্দেহের তিরটা মায়ের দিকেই তাক করা হত, জামাইবাবু এবং তার পরিবারেরও লোকেরাও মা’কে ডাইন ঠাওরাত সেক্ষেত্রে দোটানায় পড়ে দিদির জীবনটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠত। দিদির কথা ভাবতে ভাবতে একসময় দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়। এদিন হাঁড়ি চড়ে নি উনুনে। রান্না করার মতো বাড়িতে তো কিছুই নেই। খাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই। চাট্টি মুড়ি ছিল, সেটাই জল ভিজিয়ে খেয়েছে কেবল ভাইটা।
যত সময় যায়, তত উতলা হয়ে পড়ে অঞ্জলি। সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরিও নেই। এখনও আসছে না কেন দাদা ? তার তো বিকালেই চলে আসার কথা। একে একে লোক জমতে শুরু করে মোড়লের বাড়িতে। উৎকণ্ঠা আর দুঃশ্চিন্তায় মাথার শিরা দপদপ করতে থাকে তার। দাদাটা কি করছে এখনও ? তার তো অজানা নয় জরিমানার টাকা না পেলে মায়ের কি ভয়ানক পরিনতি হতে পারে। বৌদির গয়না বন্ধক রেখে টাকার সংস্থান হবে ভেবে তারা আর অন্য কোথাও টাকা যোগাড়ের চেষ্টাও করে নি। অন্য জায়গায় টাকা যোগাড়ের মতো সময়ও আর হাতে নেই। দুঃশ্চিন্তায় সে একবার উঠোনে পায়চারি আর একবার ঘরবার করে। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। কিন্তু তখনও দাদা এসে পৌঁছোয় না। আসে মোড়লের লোকজন। অঞ্জলি বোঝে আর কিছু করার নেই। ওরা মাকে ধরে নিয়ে যায়। আর পিছনে পিছনে তারা কাঁদতে কাঁদতে চলে। সেই তালগাছেটাতেই মাকেও দড়ি দিয়ে বাঁধে ওরা। তারপর সবাই গোল করে ঘিরে ধরে। সবার হাতেই ঝাঁটা, লাঠি, ইট কিম্বা পাথর।
প্রচণ্ড শব্দে বেজে ওঠে ধামসা মাদল। ইতিহাস বইয়ে পড়া সেই সতীদাহ প্রথার কথা মনে পড়ে যায় তার। ইতিহাসের স্যর বলেছিলেন, স্বামীর জলন্ত চিতায় জীবন্ত স্ত্রীর আর্তনাদ যাতে বাইরে থেকে শোনা না যায় তার জন্য তখনকার সমাজপতিরা নাকি এমনি করে ঢাকঢোল বাজাত। তার মায়ের আর্ত চিৎকারও যাতে চাপা পড়ে যায় তার জন্য বাজানো হচ্ছে ধামসা — মাদল। আর ভাবতে পারে না সে। গা’টা শিউড়ে ওঠে তার। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাও তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক পৌশাচিক দৃশ্য। সবাই মা’কে এলোপাথাড়ি মেরেই চলেছে। আর যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত মা নেতিয়ে পড়েছে। সেই সময় ধামসা-মাদলের শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় কে যেন বলছে — দাঁড়ান, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন।
অঞ্জলি চোখ খুলে দেখে দেবদুতের মতো সাইকেল থেকে নামছে হৃদয়দা। সেই মূহুর্তেই বল-ভরসা ফিরে পায় অঞ্জলি। চেয়ে দেখে মায়ের চোখে মুখেও ফুটে উঠেছে বাঁচার আর্তি। সাইকলে থেকে নেমেই হৃদয়দা সোঁজা মোড়লের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর গুনে গুনে ১০টা ১০০ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলে , ওনাকে খুলে দিতে বলুন। জরিমানা তো পেলেন, কিন্তু জরিমানা আদায়ের জন্য আপনারা যা করলেন তা ফিরিয়ে দিতে পারবেন ? আপনাদের পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এদের তো এই গ্রামেই থাকতে হবে তাই কিছু করা গেল না। হৃদয়দার কথা শুনে মোড়লের চোখ দুটো পিটপিট করতে থাকে। কথাগুলো খুব একটা মনোপুত হয় না তার। কিন্তু কড়কড়ে ১০ খানা নোট হাতে পাওয়ায় আর কথাও বাড়ায় না। আর কখন যে তার দুচোখ জলে ভরে যায় টের পায় না অঞ্জলি। মা’কে নিয়ে ঘরে ফেরে তারা। সেই ফাঁকে একবার আসি বলে হৃদয়দা কোথাই যে উধাও হয়ে যায় তা বুঝতে পারে না অঞ্জলি।
কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে একটা ঝোলা ঝুলিয়ে ফিরে আসে। ঝোলাটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলে, চাল – ডাল আর ডিম আছে। মুখ দেখেই বুঝেছি আজ কারও পেটে কিছুই পড়ে নি। আবার ঝাপসা হয়ে আসে অঞ্জলির চোখ। হৃদয়দা তাদের জন্য এত ভাবে ? আবেগে গলা বুজে আসে তার। মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না। কোন রকমে বলতে পারে — চলে যেও না কিন্তু। রান্না বসাচ্ছি। তুমিও আজ এখানে খেয়ে যাবে। হৃদয়দাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রান্নাশালে ঢুকে যায় সে। খুব দ্রুত রান্না সেরে নেয়। হৃদয়দাকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে। বাবা-মা কে আগে খাইয়ে দিয়ে ভাই, সে আর হৃদয়দা খেতে বসে। খেতে খেতে টুকটাক কথা হয়। দাদার বিষয়টা বলতে পারে না হৃদয়দাকে। কি যে হল দাদার কে জানে। তখন সময় মতো হৃদয়দা না এলে এতক্ষণে সর্বনাশ হয়ে যেত। খুব বাঁচিয়ে দিয়েছে হৃদয়দা।
তাই হৃদয়দাকে সে বলে , তোমার এই ঋণ কি করে শোধ করব জানি না।
—- জানি না বললে তো হবে না। আর শুধু আসল দিলেও হবে না। সুদও দিতে হবে , আমার সুদ আবার খুব চড়া।
—- মনোজ স্যাকরার চেয়েও ?
—- হু উ।
দুজনেই শব্দ করে হেসে ওঠে।খেতে খেতে তার রান্নার খুব সুখ্যাতি করে হৃদয়দা। খাওয়া দাওয়ার পর সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় হৃদয়দা। সে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। যাওয়ার আগে হৃদয়দা বলে, আজ তা হলে যাই ? সে বলে, যাই নয় বলো আসি।
হেসে হৃদয়দা বলে,আসি ?
— হ্যা এসো, আমি পথ চেয়ে থাকব।
সাইকেল এগিয়ে যায় গ্রামের পথে। অঞ্জলি মনে মনে ভাবে শুধু ভালোবাসায় নয় , আজ থেকে হৃদয়দার কাছে সে কৃতজ্ঞতা পাশেও বাঁধা পড়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।