গারো পাহাড়ের গদ্যকথায় অয়ন ঘোষ

ধুলোর আদর

গল্পের ও’পিঠ এই দেখুন অনেকক্ষণ দেখাই হয়নি। আসলে ছেড়ে আসা বারান্দা, পথ, বন্দর, ইস্টিশনের খোঁজ আমরা বড় একটা রাখি না। ছোটো বেলায় মামারবাড়িতে মানুষ। আমার দাদু প্রায়ই একটা কথা বলতেন “জন, জামাই, ভাগ্না তিন নয় আপনা” । ঠিক মতো দেখতে গেলে আমরা সবাই তো প্রায় ওই “জন” এর মধ্যেই পড়ি। তাই না পারি আপন হতে বা কাউকে আপন করতে। সেই মোতাবেক গল্প ঘোরে হাওয়ায় হাওয়ায়, নিজের শর্তে। তার দায় না আছে মনে রাখার বা মনে থাকার। তবু যখন মনে পড়ল একটু ঝাঁক দিয়ে দেখি কেমন চলছে জোড়াতাপ্পি দেওয়া সংসার। সেই কবে পথে বেড়িয়েছি। পা থেকে ধুলোর এক পরত খসতে না খসতেই অন্য পরত এসে জমেছে। তবে ধুলোর ধম্মো তো ধরে রাখা। তা সে নিশ্চই ধরে রেখেছে পুরনো ছাপ লুকোনো কোন দেরাজে। আবার যারা মাথা ঝুঁকিয়ে পায়ের ধুলো নেয় মাথায় তারা বোঝে ধুলোর আদর। মা আমার সব সময় বলে “গেরস্ত বাড়িতে পায়ের ধুলো পড়া ভালো”। আসলে মাটির কাছাকাছি যারা থাকে তারা জানে সেই ধুলোর সাথে কত কথা কত বার্তা চলে আসে বাড়ির মধ্যে। তারপর বহু স্রোত এক হয়ে মিশে যায় একের ভিতর। জড়াজড়ি করে, গায়ে গা লাগিয়ে কাটিয়ে দেয় সোজা সহজ জীবনখানা। তারপর দিন ফুরুলে যখন জোনাকি জ্বেলে ধরবে রাত বাতি চেনা পথের স্বজন সুজন বৃক্ষ দেবতাদের মাথায় মাথায়। নিজের পায়ের ভার আর বইতে পারবে না অতিচেনা পথ রেখা। বাড়ির পিছনের ঝুপসি বাঁশ বাগান থেকে খান দুই সরেস বাঁশ কেটে এনে পাড়ার ছেলেরা বানিয়ে দেবে রাজশয্যা। তাতে উঠিয়ে আনন্দ সঙ্গীতের সাথে নিয়ে যাবে জলমির (আমার গ্রামের শ্মশান ক্ষেত্র) পানে। বাতাসে উড়বে শালিধানের নরম জোৎস্নাস্নাত খই আর অচল পয়সা। এতো আয়োজন তো সেই ক’মুঠি ধুলো হবার জন্য। তাই ধুলোর মন আর মান দুটোই চিনে নিতে হবে রসিক, নইলে শেষ আসরে তাল কাটবে যে।
দেখ কান্ড কি বলতে কি বলছি! হাতে মেলা কাজ। এখন যম আসলেও তাকে বলতে হবে, “হাত জোড়া ঠাকুর ক’বাড়ি ঘুরে দেখ”। ছোটবেলার একটা কথা ভারী মনে পড়ছে আমরা বাবারা আট ভাই চার বোন মানে যে কোনো খেলায় এগারো জনের দল হয়েও একটা অতিরিক্ত খেলোয়াড় পাওয়া যাবে। সেই বংশলতিকায় পরবর্তী সংযোজনটা নেহাত কম না। গন্ডা দুয়েক নতিপুতি। ঠাম্মার বয়স যত বাড়ছিল, শেষের দিকে আর পেরে উঠতেন না। যখন খুব ব্যস্ত থাকতেন কাজে তখন জ্বালালে একটা কথা প্রায়ই বলতেন
“একপাল ছেলেপুলে নাতিপুতি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে উনি ফুলবাবু সেজে স্বর্গে হাওয়া খেতে গেলেন। দেখগে এখন বোধহয় অপ্সরাদের নাচ দেখছেন” । সেই বয়সে স্বর্গ জায়গাটা কোথায় তা বোঝার ক্ষমতা হয়নি কিন্তু এটা বুঝেছিলাম জায়গাটা ভারী সুন্দর। সেখানে গেলে হাওয়া খাওয়া যায় আবার নাচ দেখাও যায়। ওই রথ দেখার সাথে কলা বেচার মতো আর কি! ভেবে মনে মনে ভারী আমোদ পেতাম। ভাবতাম বড় হলে দাদুর মতো এক ঘোরান ঘুরে আসব। পরে বুঝেছি সে বড় কঠিন ঠাঁই। এখন বুঝি ঠাম্মার ওই কথার পিছনে কত বেদনা ছিল। ছিল সদ্য একবছর আগে প্রিয় মানুষটাকে চিরকালের মতো হারানোর যন্ত্রণা। আসলে কথা মানে তো কেবল খানকতক স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ না। আরো অনেক কিছু। যার সবটা শোনা গেলেও সবটা বোঝা সম্ভব হয় না সবসময়। কথার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে কথা না হতে পারা অনেক অনুভব, অনেকটা সেই মুখচোরা প্রেমিকের মতো যার কোনো প্রেমই ঘরে এলো না, বলে উঠতে না পারার জন্য। কবি বললেন বটে ” বলিনি কখনো, আমি তো ভেবেছি বলা হয় গেছে কবে!” কিন্তু সবাই কি আর মন পড়তে পারে। আসলে ছোটবেলা মানে ক্লাস ওয়ান থেকে সেই যে ছাত্রবন্ধু ধরিয়ে দিয়েছিল আমাদের হাতে, ওতেই মুশকিল হয়েছে যত। এখন সবেতেই ছাত্র বন্ধু খুঁজছি বা মানেবই খুঁজছি। কিন্তু মন পড়তে যে শুধুই মন লাগে এটা বুঝতে যে আর কত জন্ম পাড়ি দিতে হবে কে জানে!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।