অরুণাভ দাসের ফটো ফিচার

হ্যাভলক নীল স্বপ্নমিছিল

নীলের মাঝে শ্যামল সে দ্বীপ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা। আন্দামানের নীল ও হ্যাভলকের উদ্দেশে ভেসে পড়েছি মার্চ মাসের এক মনোরম সকালে। দ্বীপমালায় বেড়াতে এসে এই দুটি আন্দামান সাগরের বিউটি স্পট না দেখলে ঘোরা নাকি অসম্পূর্ণ থাকে। পোর্টব্লেয়ার-এর ফিনিক্স বে জেটি থেকে রাজহংসের মতো দুধসাদা বাহন এম ভি বাম্বুকা প্রায় দুশ যাত্রী নিয়ে ঠিক সকাল ছটায় ছাড়ল। হ্যাভলক পৌঁছে দেবার কথা সাড়ে আটটায়। এসি ডেকে পুশব্যাক চেয়ারে আরাম করে বসা গেলেও চারপাশের দৃশ্য ভালোভাবে দেখা যায় না। ব্রেকফাস্ট সেরে জাহাজের খোলা ছাদে চলে যাই। বিদেশী পর্যটকরা সেখানেই রোদের তেজ উপেক্ষা করে মৌজ করে বসে পড়েছে। প্রবল বেগে হাওয়া বইছে। সোনা রোদ্দুরে চারপাশ ঝিকমিক। তিন দিকে সুনীল সাগর দিগন্তের নীলাকাশে লীন। এক দিকে ডোবা পাহাড়, বসতিহীন কয়েকটা সবুজ দ্বীপ। ক্রমশ স্থল ফুরিয়ে চারিদিকে জলের আলপনা। জল কেটে ফেনা ছড়িয়ে জাহাজ চলেছে। প্রবল বাতাসে উড়ছে বিরাট জাতীয় পতাকা। অনেক দূরে ঘন নীল আন্দামান সাগরের বুকে কয়েকটা সাদা রঙয়ের জাহাজ দেখা যাচ্ছে। একজন নাবিক জানালেন, ওদের কেউ যাবে নীল দ্বীপ, আবার কেউ নীল ও হ্যাভলক থেকে লোক তোলার পড় আরও দূরে লং আইল্যান্ড। অচিন দ্বীপমালার কথা ভেবে রোমাঞ্চিত হই। তিন ভাগ জলের দুনিয়ায় আশ্চর্য অনুভূতিমালা চোখ থেকে মনে ছড়িয়ে পড়ে। নিসর্গের আশ্চর্য ক্যানভাসে চোখ বুলানো আর ফুরায় না। যেন ঘোরের ভেতরে কেটে যায় দুটি ঘণ্টা। ক্রমশ হ্যাভলক দ্বীপ কাছে আসে। ডানদিকে আরণ্যক দ্বীপটিকে সমুদ্রের বুক থেকে একনজরে লম্বাটে দেখাচ্ছে। আরো কাছে যেতে বন ফুরিয়ে টুকরো বালিয়াড়ি। নারকেলবীথির সবুজ পাড় বসানো সোনা-হলুদ খোলের শাড়ি বিছিয়ে রাখা যেন। শ্যামল ছায়ায় কিছু দোকানপাট। মাছের আড়ত। নৌকো সারাইয়ের ছাউনি। সেতুর মতো লম্বা কজওয়ের শেষে চওড়া হ্যাভলক জেটি। পাশে নানা রঙে রাঙানো অনেক নৌকা ও মোটরবোট। কেউ চলছে, কেউ নোঙর করে। এম ভি রঙ্গত জাহাজের পাশে আমাদের এম ভি ব্যাম্বুকা ভিড়ল। কয়েকটি সিগাল জাতীয় পাখি জাহাজের মাস্তুল ঘিরে চক্কর কাটছে।

জেটির গেটে আমাদের বাঙালি ট্রাভেল এজেন্ট অপেক্ষা করছিলেন। ১০ কিমি দূরে রাধানগর বিচে যাবার জন্য একটি গাড়িতে তুলে দিলেন। বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের ভেতর দিয়ে গাড়ি ছোটে। এ যেন আমাদের ঘরের পাশে সুন্দরবন এলাকার গ্রামের দৃশ্য। শাক সবজি ফলছে দুপাশের খেতখামারে। কোথাও নারকেল গাছের জটলা। পাকা রাস্তার ধারে গ্রামের বাড়িগুলি সাদামাটা। হ্যাভলকের বাসিন্দা নাকি প্রায় সকলে বাঙালি। দেশভাগের পর ভাগ্যের সন্ধানে ভাসতে ভাসতে দ্বীপান্তরে চলে আসা। বেশিরভাগ চাষের কাজে যুক্ত, কেউ ব্যবসা করছেন। গাড়িচালক ২০-২১ বছরের ছেলেটিও বাঙালি। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পড় আর পোর্ট ব্লেয়ারের কলেজে পড়তে যায়নি, গাড়ি চালিয়ে বাবাকে সংসারে সাহায্য করার কাজে নেমে পড়েছে। সে-ই হ্যাভলক দ্বীপের মানুষের জীবন জীবিকা সম্পর্কে সব খবর জানায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে পৃথিবীর সেরা একশটি সমুদ্র সৈকতের তালিকায় রাধানগর বিচ জায়গা পাওয়ার পড় থেকে এখানে পর্যটন শিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। এর ফলে স্থানীয় মানুষজনের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।

২০ মিনিটের মধ্যে রাধানগর বিচের কাছে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে ২০০ মিটার হাঁটলেই বিশ্ববিখ্যাত বেলাভূমি। পথের ধারে সারি সারি হোটেল। হইহই করে মাছ-ভাতের আগাম অর্ডারের আহবান। ব্যাগপত্র একটা হোটেলে রেখে খাবার বানাতে বলে দিলাম। কয়েকজন ভ্যানে করে পেল্লায় আকারের গোল্ডেন কোকোনাট নারকেল বেচতে এসেছে। মিষ্টি জলে গলা ভিজিয়ে সৈকতের দিকে পা বাড়াই। বড়ো বড়ো গাছের রাজ্য অতিক্রম করে মিহি বালির তটে। সামনেই দিগন্তছোঁয়া সুনীল আন্দামান সাগর। বাঁয়ে একটি পাহাড় সর্বাঙ্গে অরণ্যের র‍্যাপার জড়িয়ে সটান সমুদ্রে নাইতে নেমেছে। ডানদিকে অনেক দূর পর্যন্ত তটরেখা। একধারে টানা অরণ্য। সকালের আলো মেখে দেশ বিদেশের অগণিত পর্যটক সমুদ্রস্নানের আনন্দে মেতে উঠেছে। গাছের ছায়ায় চেঞ্জরুমে পোশাক বদল করে আমরাও জলে নামলাম। যত দূর চোখ যায়, স্নানার্থীর মেলা বসেছে। রবারের ভেলায় চড়ে জলবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে আন্দামান সি তেমন অশান্ত নয়। ঢেউয়ের সঙ্গে হুটোপাটি করে প্রায় দুঘণ্টা পরে উঠলাম। তারপর মিষ্টি জলের টয়লেটে ১০ টাকায় স্নান। হোটেলে সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি সহযোগে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার গাড়ি চড়ে জেটির পথে।

জেটি থেকে ১ কিমি আগে নতুন রাস্তায় বাঁক নিলাম। হ্যাভলকের প্রধান বাজার অতিক্রম করে সোজা বিজয়নগর বিচে। এই সৈকতের একধারে আন্দামান ট্যুরিজমের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটকাবাস ডলফিন রিসর্ট। বুকিং পাওয়া বেশ কঠিন, এতই চাহিদা। আসলে, হ্যাভলকে যত পর্যটক এসে থাকতে চান, তার তুলনায় থাকার জায়গা খুবই কম। বেসরকারি হোটেল রিসর্টগুলি বেশ দামি। সে তুলনায় সরকারি ডলফিন রিসর্ট মধ্যবিত্তের বাজেট উপযোগী। ডলফিনের কয়েকশ মিটার দূরে অন্য একটা রাস্তা দিয়ে বিচে নামলাম। বিজয়নগর দারুণ নির্জন। আপাতত আমরা ছাড়া আর কোনো পর্যটক নেই। গাছপালা অতিক্রম করে বালিয়াড়িতে গিয়ে দাঁড়াতে ম্যাজিকের মতো আশ্চর্য রঙিন এক জগতের দরজা দুচোখের সামনে হাট হয়ে খুলে গেল। সাদা বালির চওড়া বেলাভূমি। তার প্রান্তে শান্ত সমুদ্র। বিভিন্ন এলাকায় জলের রঙ বিভিন্ন রকমের। কোনো মহান শিল্পী যেন প্যাস্টেল রঙ দিয়ে প্রকৃতির বিরাট ক্যানভাসে ছবি এঁকে রেখেছেন। নীল সবুজের কত যে শেড, হিসেব করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলি। সেই অভাবনীয় রঙিন ছবির নানা অংশে উজ্জ্বল লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, বেগুনি রঙের নৌকো বাঁধা রয়েছে। জোয়ারের সময় মাঝদরিয়ায় ভেসে যাবে মাছ ধরার জন্য। কয়েকজন মাঝিমাল্লাকে দেখা গেল নৌকায় বসে জাল বুনতে ব্যস্ত। নারকেল বাগানের মধ্যে পাতার ছাউনি দেওয়া ইকো হাটে বসে অনেকটা সময় কাটালাম বিজয়নগর বিচের প্রাকৃতিক রংমহলে। সাগর থেকে ফেরা হাওয়ায় ঘুম আসার উপক্রম। নীল দ্বীপ যাবার জাহাজ ছাড়ার সময় এগিয়ে আসতে গাড়ির চালক ছেলেটি ডেকে নিয়ে গেল। ৫ মিনিটেই জেটির পাশে ওয়েটিং রুমের দরজায় নামিয়ে দিল। অপেক্ষারত যাত্রীদের ভিড় ও গরম এড়িয়ে জেটির পাশে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াই। নীল দরিয়াত জল কেটে ম্যাকক্রুজের বিলাসবহুল ক্যাটাম্যারন ছেড়ে গেল। এই দ্রুতগতির জলযান রোজ প্যাকেজ ট্যুরে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে যাত্রী নিয়ে আসে। এক পিঠে দুঘণ্টারও কম সময় লাগায়।

রাতে থাকার ব্যবস্থা করে এলে হ্যাভলকে হাতি টাপু বা এলিফ্যান্ট বিচ বেড়ানো যায়। সেখানে সমুদ্রের তলায় প্রবালের বিচিত্র উদ্যান ও রঙিন মাছের জগৎ। স্নরকেলিং হয়। জেটি থেকে বোট ভাড়া করে হাতি টাপু যেতে হয় জলপথে। রাধানগর বিচের পথে ফরেস্ট ক্যাম্প পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে তারপর খানিকটা হেঁটেও সেখানে যাওয়া যাবে। হ্যাভলকে হোটেলের সংখ্যা সীমিত। বুকিং পাইনি বলে বিকেলের জাহাজে নীল দ্বীপ গিয়ে রাতযাপন করা হবে।

হ্যাভলক থেকে নীল যাবার জাহাজ ছাড়ার কথা বেলা তিনটেয়। কিন্তু পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসার সময় দেরি করায় এম ভি স্ট্রেট আইল্যান্ড জাহাজ হ্যাভলক জেটি ছাড়ল বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ। এই জাহাজটাই নীলে যাত্রী নামিয়ে সন্ধেবেলা আবার পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে যাবে। এসি নয় বলে ডেকে না ঢুকে প্রথমেই ছাদে উঠে গেলাম। কিন্তু চড়া রোদ্দুরে বেশিক্ষণ সেখানে থাকা গেল না। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর হ্যাভলক দ্বীপ পিছনে সরে গেল। আরো প্রায় আধ ঘণ্টা পার করে নীল দ্বীপ-এর জেটিতে জাহাজ ভিড়ল। দ্বীপ থেকে অনেকটা জলের ভেতরে জেটি। লম্বা সেতু অতিক্রম করে মাটিতে নামা। দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে। আমাদের নাম লেখা প্লাকার্ড হাতে রঞ্জন নামে একজন গেটে অপেক্ষা করছিল। মোট জনা তিরিশ যাত্রী নেমেছে নীলে। রঞ্জনকে সহজেই পেয়ে গেলাম। সে তাড়া দিয়ে গাড়িতে চড়াল ও নিজেই স্টিয়ারিংয়ে বসে গেল। দ্রুত গাড়ি ছোটাল লক্ষণপুর-২ বিচের দিকে। গাড়ি চালানোর ফাঁকেই রঞ্জন কিছু দরকারি কথা জানিয়ে দিল, যা সব ভ্রমণকারীর জেনে রাখা দরকার।

নীল দ্বীপকে বলা হয় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সবজিপাত্র। রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারের বাজারে যত আনাজ বিক্রি হয় তার একটা বড়ো অংশ যায় জলপথে ৩৬ কিমি দূরবর্তী নীল দ্বীপ থেকে। পর্যটকদের প্রিয় নীলে আছে মোট চারটি সমুদ্রসৈকত। লক্ষ্মণপুর ১ ও ২ ছাড়াও আছে ভরতপুর ও সীতাপুর বিচ। প্রবালের বিচিত্র ও বর্ণময় জগৎ, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধুরিমা, প্রকৃতির আশ্চর্য খেয়ালে নির্মিত পাথরের সেতু ও গুহা– এ সবই রয়েছে মাত্র ১৮.৯ বর্গ কিমি আয়তনের নীল দ্বীপ-এ। কিন্তু হ্যাভলক দ্বীপ-এর মতো বিশ্বব্যাপী পরিচিতির আলো পায়নি বলে নীলে আজও সীমিত সংখ্যক পর্যটক আসেন। তাই নির্জনতা সুলভ, বাসিন্দাদের মধ্যে সারল্য ও আন্তরিকতা অনেক বেশি।

নীলের ছোটো বাজারে পৌঁছে ডানদিকের পাকা রাস্তা ধরে খানিক চলার পর আবার ডাইনে জঙ্গলের কাঁচা রাস্তায় পড়লাম। একনজরে নীলকে বড়ো গ্রাম মনে হল। পথের প্রান্তে যখন বালিয়াড়ি দেখা গেল তখন বিকেলের আলো প্রায় মরে গিয়েছে। কিচিরমিচির করে কুলায় ফিরছে ঝাঁক ঝাঁক পাখি। গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পা চালিয়ে সানসেট পয়েন্টে। লক্ষ্মনপুর-২ বিচ খানিকটা ইংরেজি এল আকৃতির। হঠাত ৪৫ ডিগ্রি বেঁকে গিয়েছে। ঘুরে গিয়ে দেখি আগে থেকেই অনেক দর্শক ভিড় করেছেন সূর্যাস্ত দেখার জন্য। রাঙা আলোয় ধোয়া সমুদ্রে কয়েকজন মহা উৎসাহী বিদেশী নাইতে নেমেছে। ক্রমশ আকাশের চিরনতুন রংবাহার ঢেকে গেল অন্ধকারের চাদরে। রঞ্জন ফিরিয়ে দিল বাজারের পাশে হোটেলে।

সন্ধ্যায় বাজার ঘুরতে বেরনো। একটা দোকানে চা পান, সিঙাড়া সহযোগে। দোকানি বাঙালি ও যত লোক ভিড় করেছেন সকলেই বাঙালি। দোকানদারের সঙ্গে ভাব জমাতে জানা গেল আদি নিবাস পূর্ববঙ্গে হলে বাড়ি আছে উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে। তিনিই জানালেন, নীলবাসীর ১০০ শতাংশ বাঙালি। প্রায় সকলে চাষ করে জীবীকা নির্বাহ করেন। এখানকার মাটি খুবই ঊর্বর, হ্যাভলকের থেকেও বেশি। তাই দেশ গ্রাম ছেড়ে সাগরপারে সকলে ভালোই আছেন। বছরে একবার পশ্চিমবঙ্গে যান প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলিত হতে। গল্পের অবকাশে অনেকটা সময় যেন আপনজনদের মধ্যেই কাটানো গেল।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার অনেকক্ষণ আগেই রঞ্জনের গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম সীতাপুর বিচের উদ্দেশে। ৫ কিমি দূরে সীতাপুর সূর্যোদয়ের জন্য বিখ্যাত। বাজার ছাড়িয়ে একদম সোজা রাস্তা। অন্ধকারের মধ্যেই বাজারে লোকজন ভিড় করেছে। রঞ্জন খবর দিল, আজ নীলে হাটবার। নানা রকম শাকসব্জি হাটে নিলাম করা হবে তারপর ব্যবসায়ীরা জাহাজ ও মোটরবোটে চাপিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার ও হ্যাভলকের বাজারে নিয়ে যাবে। বাজারের ভিড় উজিয়ে নিরালা গ্রাম্য পথ। চাষীরা সাইকেল ভ্যানে অনেক ঝাঁকা চাপিয়ে বাজারে চলেছেন। এখানে সকলের তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে। জাহাজ আসা যাওয়ার সময় অনুযায়ী জীবন চলে। শুধু বর্ষাকালে প্রবল বৃষ্টি নামলে সামান্য অবসর।

        

সীতাপুর সৈকতের ঠিক ওপরে রাস্তা শেষ। আমরা ছাড়া কেউ কোথাও নেই। অথচ কাল আমাদের জাহাজেই অনেক পর্যটক এসেছেন। যে হোটেলে উঠেছি তারও সব ঘর ভর্তি। সীতাপুরের আকাশে হালকা আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। গাছে গাছে পাখিদের কোলাহল শুরু হয়েছে। কয়েকটা পাথরের ধাপ অতিক্রম করলেই বালিয়াড়ি। সীতাপুরে সামনের দিকটা রকি শোর। কিন্তু তারপরে মিহি বালির চর অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এখন লো টাইড বা ভাঁটার টান বলে বিচের দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া সম্ভব। জোয়ারের সময় সমগ্র বালিয়াড়ি সমুদ্রের তলায় চলে যায়। ঢেউ আছাড় খায় পাশের পাহাড়ে। পাহাড়ের প্রাচীর ৩০ ফুট পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। জোয়ারের জল ধাক্কা মারার ফলে পাথরের দেয়ালে নানা রকম প্রাকৃতিক ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। বেলাভূমির শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে দেখি সেখানে জলের ক্ষয়কার্যের ফলে এক জায়গায় গুহা তৈরি হয়েছে। ফিরতি পথে যখন বিচের মাঝ বরাবর, আকাশ রাঙিয়ে সূর্যোদয় হল। সমুদ্রতীরে এই দৃশ্য কখনো পুরনো হয় না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক মিনিট। আর কেউ নেই বলে প্রকৃতির এই সাম্রাজ্য একান্তই আমাদের তিনজনের বলে মনে হচ্ছিল। ঊষালগ্নের অনেক ছবি তোলা হল। রাঙা রোদ্দুর ক্রমশ কমলা হলে গাড়িতে ফিরে গেলাম।

নীল বাজারের ঠিক আগে গাড়ি ডানদিকে বাঁক নিল। গাছপালার ভিড়ের ভেতর দিয়ে সুঁড়িপথ। বড়ো বড়ো কেয়া গাছের ঝোপ অতিক্রম করে সোজা ভরতপুর সৈকতে। জঙ্গলের পাড় বসানো বালুতট বিশেষ চওড়া নয়, কিন্তু বাঁক নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁদিকে প্রায় আধ কিমি দূরে নীলের জাহাজঘাটা দৃশ্যমান। পাড়ে দুটি রঙচঙে গ্লাসবটম বোট বাঁধা। এইগুলিতে চড়িয়ে পর্যটকদের মাঝ সমুদ্রে সাগরতলের প্রবালরাজ্য দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন সকাল সাতটা বাজতে দশ। ভরতপুর বিচে কোনো লোক নেই। হলুদ বালির ওপরে মৃত প্রবাল ছড়িয়ে রয়েছে। এখনই রোদ্দুর বেশ চড়া। মাথার ওপরে দূষণহীন আকাশ আশ্চর্য রকমের ঘন নীল। তার ছায়া পড়ে সাগরজল আরো নীল। ফিরতে মন চাইছিল না। বোটের চালক থাকলে হয়তো জলবিহারে যাবার কথা ভাবা হত। কিন্তু সবই সময়ে বাঁধা বলে ভরতপুর বিচ ছেড়ে রওনা হলাম লক্ষণপুর-১ বিচের উদ্দেশে।

   

বাজার অতিক্রম করে এবারে গাড়ি ঢুকল বাঁদিকে। পাড়ার ভেতরে সারি সারি ঘরবাড়ি। পুকুর ঘাটে মহিলারা কাপড় কাঁচার কাজে ব্যস্ত। ছোটোরা সাইকেলের টায়ার নিয়ে হইহই করে খেলছে। হাঁসের দল প্যাঁক প্যাঁক শব্দে চারদিক মুখরিত করে এ পুকুর থেকে ও পুকুরে চলেছে। চায়ের দোকানে বুড়ো মানুষদের আড্ডা জমে উঠেছে। সুন্দর সকালে দ্বীপবাসীর রোজনামচা দেখতে দেখতে একটা ঢিপির কাছে পৌঁছে যাই। ওপরে উঠতেই ম্যাজিক। সামনে হালকা ঝোপ জঙ্গলের ওপারে রকি শোর এবং তার বুকে সমুদ্রের ঢেউ আছাড় খাচ্ছে। বাঁদিকে সামান্য তফাতে প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি ন্যাচারাল রক ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। রঞ্জন তাড়া দিয়ে জানায়, ‘এখনই পাথরে পা দিয়ে দিয়ে জায়গাটা দেখে আসুন। জোয়ার আসছে। জল বেড়ে গেলে ফিরে আসতে অসুবিধা হবে।’

দ্রুত পা চালিয়ে রক ব্রিজে। সত্যিই অবাক করা জায়গা। অনেক ছবি তুলি। এর পিছনেই নাকি বিস্তীর্ণ প্রবালের বাগান। ভাঁটার সময় দেখা যায়। তার জন্য অন্তত ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। সে সময় আপাতত হাতে নেই। সাড়ে নটায় জাহাজ আসবে আমাদের পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছে দিতে। নীল দ্বীপ-এর নীল নির্জন ছেড়ে আসতে মন চায় না, বার বার ফিরে চাই সদ্য স্মৃতি হয়ে যাওয়া পথের প্রান্তে।

দরকারি তথ্য: দমদম থেকে দুঘণ্টায় এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগোর বিমান যায় রোজ সকালে পোর্ট ব্লেয়ার। কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের হাড্ডোর মধ্যে মাসে কয়েকবার জাহাজ চলাচল করে। মোটামুটি তিন দিনের জলযাত্রা। পোর্ট ব্লেয়ারের ফিনিক্স বে জেটি থেকে রোজ একাধিক জাহাজ যায় হ্যাভলক ও নীল দ্বীপ। হ্যাভলক যাবার জন্য ম্যাকক্রুজের বিলাসবহুল ক্যাটাম্যারন ও সি প্লেন সার্ভিস আছে। এই দুটি দ্বীপ-এ কয়েকটি হোটেল আছে থাকার জন্য। হ্যাভলকে আন্দামান ট্যুরিজমের ডলফিন ট্যুরিস্ট রিসর্ট অবস্থানের দিক থেকে অসাধারণ। নীল দ্বীপের হোটেল হ্যাভলকের তুলনায় সস্তা। বেড়াতে যাবার সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস। আন্দামানে শীত পড়ে না আর প্রচুর ঘাম হয়। অনেক দাবের জল খাবেন আর সানব্লক ক্রিম ও সানগ্লাস ব্যবহার করবেন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।