• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি তে রসিক অরিন কবি

তিন কন্যা

একবার, দোলের আগে, সারদা মিশন কলেজের কলকাতার একটি শাখার সামনে দিয়ে আসছি – দেখি তিনটি মেয়ে আবীর নিয়ে মহানন্দে রঙ খেলছে!
আমি তাদের রঙ খেলা দেখে, আহ্লাদিত হয়ে প্রকাশই করে বসলাম –
– বাঃ বেশ ভালো লাগছে তো তোমাদের! – ” রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও, যাও গো এবার যাবার আগে … “
তিনজন ছিলো! একজন হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠলো –
“দাদা একটু সাহায্য করবেন?”

তারা শাড়ি পরে আছে – লালপাড় সাদাশাড়ি।

আমি বললাম ” হ্যাঁ, নিশ্চই! বলো কি করবো? “
“আমার ব্যাগটা একটু হোল্ড করবেন? – আমি চটির স্ট্র্যাপটা সেট্ করবো।”
এই বলে, দারোয়ানকে কি একটা বলে, তাদের কলেজ ক্যাম্পাসেরই অভ্যন্তরে প্রত্যন্ত এক কোনায়, আম – জাম – কাঁঠাল ও লিচুতে ভরা ছায়াঘন বাগানে আমাকে,কিছু বোঝার আগেই নিয়ে হাজির হলো, যে স্থানটি একেবারে নির্জন, কে বলবে এটা শহুরে এলাকা এবং ২০০ মিটারের মধ্যেই পড়ে বিশাল বাসরাস্তা? ! আর এই ভর দুপুরবেলা, সব কেমন ফাঁকা! দূরে একটা গাছে কোকিল ডেকে বসন্ত এসেছে মহানন্দে তার যেন জানান দিচ্ছে ,এছাড়া আর সব কেমন যেন অদ্ভুত রকমের থমথমে!
ক্যাম্পাসের এই গাছের ছায়ার মাঝে,ফাঁকা একটা কোনায় আমাকে নিয়ে এসে হঠাৎ একটা মেয়ে আমাকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরলো…
অস্বস্তিতে আমি কিন্তু তার এ অযাচিত আলীঙ্গন ছাড়াতে গেলাম –
” ওঃ! একি করছো! ছাড়ো বলছি! “

অন্য মেয়েদুটো তখন, তাদের সইয়ের পক্ষ নিয়ে মিনতির সুরে বলে উঠলো –

“একটু দয়া করুন দাদা – আমাদের রঙটা কেবল আবীর আর বইয়েই গণ্ডিবদ্ধ – একটু আপনার পুরুষ স্পর্শের, আপনার পৌরুষের আশীর্বাদ ভিক্ষা দিয়ে আমাদের অনুগ্রহ করুন!আমাদের একান্ত অনুরোধ, আপনার এই আশীর্বাদে আমাদের বাসনার ভীক্ষার ঝুলি পূর্ণ করুন, আমরা জানি এ অন্যায় আবদার, তবে এও জানি, আপনি শিবসম দেবতুল্য এক মানুষ, এ বরদানে আপনি নিশ্চয়ই……. মানে… ..ঈশ্বর আপনার অমঙ্গল করবেন না !”
অবাক আমার বিষ্ময় ও খানিক একটু বিদ্বেষও মনে এলো। কি অদ্ভুত অশালীন আচরণ, এ অধর্ম না কি ধর্ম? এক ভালোমানুষকে সঙ্কটে ফেলা অথচ এ আবেদন কি অদ্ভুত এক শালীনতায় মোড়া! এও কি সম্ভব?
কিন্তু ওই জড়িয়ে থাকা অবধিই! তিনজনেই এই একই আচরণের বশবর্তী হলো, আমাকে আলীঙ্গনবদ্ধ করে একপ্রকার বশীকরণ করে ফেললো , -একএকজন প্রায় পনেরো মিনিট – আর আমিও তাদের বঞ্চিত করতে বা রাখতে অপারগ হলাম ,তারা আমাকে এই আচরণে একরকম টেনে নিয়ে এলো!
এই আলীঙ্গনে, আমি নিজেও খানিক কামোত্তেজনার শিকার হলাম সেটা অস্বীকার করাটা আজ হিপোক্রেসি হবে বটে – কিন্তু ব্লাউজ বা পোষাকের কোনো অংশ খোলাখুলি বা শরীরের কোন অংশ নিরাভরণ করা আদৌ নয় -তবু আমিও যেন ওদের জাপটেই ধরেছিলাম – আমার হাত ওদের পিঠের ওপরে রেখে সম্ভোগসম নিবিড়ভাবেই আদর করেছিলাম।আমার শরীর আমার পোশাকের ওপর দিয়ে ওদের শরীর স্পর্শ করলেও যেন উভয়তই তিনজনেরই উষ্ণতায় প্রায় ছ্যাঁকা খাচ্ছিলাম। মনে হলো এই আসল নারী! – সম্ভোগে এভাবেই পুরুষদের তৃপ্ত করে এসেছে, সৃষ্টির আদি হতেই। কি অদ্ভুত এক তৃপ্তি, যা বোঝানোর বিশেষণ আমার নেই। উঃহ!!
আলীঙ্গনের সময় ,তিনজনের কেউই একে অপরকে বিরক্ত করলোনা, একজন ছেড়ে দেবার পর অন্য দুজন নিমেষে চোখের আড়াল হলো, কেবল আমি ও একজন সই, পালা করে, ওই তিনের মাঝে , কয়েকটি আম – জাম – ও কাঁঠাল গাছ ও প্রকৃতি সাক্ষী ছাড়া!
তারপরে প্রায় ৪৫ – ৫০ মিনিট পরে, তাদের এই অকস্মাৎ লিপ্সার, আরো অকস্মাৎ যবনিকা টেনে,আমার পায়ে আবীর দিয়ে তিনজনেই,আলাদা আলাদাভাবে আমাকে প্রণাম করে বললো – ” ক্ষমা করবেন, জানিনা এরকম সৌভাগ্য, কারো সাথেই, আমাদের আর কখনোই হবে কিনা! “
আমি হকচকিয়ে গিয়ে কিরকম বুদ্ধিভ্রষ্ট গোপাল ভাঁড়ের মতন বললাম –
” কেন এরকম বলছো তোমরা? ছিছি , এরকম কক্ষণো ভাববেনা! কি কম আছে তোমাদের রূপে গুণে? অবশ্যই শিবতুল্য ভালো স্বামী পাবে তোমরা বিবাহবন্ধনের দ্বারা ! “
” আপনাকে রং দিলামনা দাদা, বৌদি বুঝতে পারলে, আপনার পারিবারিক অশান্তিই হবে হয়তো, এরকম উদারতা কোন নারী দেখাতে পারে বলুন? আমরা নারীরা, বরাবরই কিন্তু এই বিষয় চূড়ান্ত স্বার্থপর, জানেন তো? তাই আমরা বুঝতে পারি, আপনাদের সুবিধা -অসুবিধা”।এই বলে তিনজনেই খিলখিল করে, অদ্ভুত এক প্রগলভতার হাসি হেসে উঠলো – যেন প্রকৃতি তথা বিধাতাকেই তারা ব্যঙ্গ করছে!
এতোটা সমঝদার এই তিনটি মেয়ে, আমি অবাক হলাম, অথচ….
আমি ওদেরকে বিদায় জানিয়ে বললাম – “আবার দেখা হবে!আজ তবে আসি…. “
কিন্তু ওদের চোখে জল, – “হ্যাঁ দাদা আমরা ঈশ্বরকেই বররূপে পাবো জানি ! ” কিন্তু তারা সিক্ত চোখেই যেন হাসছে! একসাথে তারা আমাকে চোখও মারলো, ওই হাত ধরাধরি করে – হ্যাঁ, তিনজনেই !
আমি বললাম বটে – আবার দেখা হব – কিন্তু অবাক করে তারা মাথা নাড়লো, বোঝালো যেন, তা হয়না, কখনো হবেওনা।
মনটা ভারি দমে গেলো,আমি ওই পৌনে এক ঘন্টার দমকা কামোত্তেজনার থেকে, যেন বেরিয়ে আসতে পারছিলামনা, আদৌ!
এরপরে ওপথ রোজই ধরেছি, ওখান দিয়ে কলেজ আওয়ার্সে অনেকবার গেছি, আমার যাতায়াতের পথে পড়ে বলে, আর ক্ষীণ আশায়, আবার যদি দেখা হয়, কেবলই সৌজন্যতার জন্যই হোকনা কেন? মেয়ে তিনটির সুমিষ্ট ব্যবহার, আমাকে বিমুগ্ধ করেছিলো, অন্য কিছু হয়তো নয়!
কিন্তু ওই তিনটি মেয়েকে আমি ওই তল্লাটে আর কখনোই দেখিনি! যেন হঠাৎ অসহায়া তিন অপ্সরা – ঊর্বশী, রম্ভা ও মেনকা – মানবীর রূপ নিয়ে, আমার কোন জনমের অব্যক্ত অপূর্ণ অভীপ্সা, সেদিন পূর্ণ করতেই এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন!
বহু বছর পরে, বিবেকানন্দ উইমেন্স কলেজের এক শাখায়, আমাকে একটা কাজ নিয়ে যেতে হলো, এক পরীক্ষক রূপে! সেই মহাবিদ্যালয়, জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামেই অবস্থিত , প্রান্তিক ছাত্রীদের শিক্ষাদানার্থে।।
সোজা প্রিন্সিপালকে রিপোর্ট করতে হবে – আমি ওনার চেম্বারে গিয়েই বসলাম,তার আর্দালীর নির্দেশানুসারে !
পেছন থেকে একটু পরে একটা চেনা গলা, ভুল হবার কথা নয়, কিন্তু মনে করতে পারছিলামনা এ কণ্ঠস্বর কার? অথচ কত পরিচিত,কত আন্তরিক এবং আদৌ এ তো ভোলার নয় – “কেমন আছেন দাদা? আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছেন দেখছি, শরীর সুস্থ আছে তো? সব কুশল তো?”
শিউরে উঠলাম, এরূপ কুশল প্রশ্ন তো কেবল নিজস্ব গর্ভধারিণী আর সহোদরাই করতে পারে?

চমকে তাকিয়ে দেখি, সৌম্যদর্শনা এক মাতাজি – মস্তক মুণ্ডিত, গেরুয়াধারিণী তিনি!

” আমি এই কলেজের অধ্যক্ষা।আমি সেই তিন সখীর একজন, আর আমার অন্য দুই সই, যাদের সাথেও যুগ দুয়েক আগে আপনি পরিচিত হন, তাদের একজন দেওঘরে আর অন্যজন আজ ইংল্যান্ডে সন্ন্যাসীনি। আমাদের কি সংসার করার সৌভাগ্য হয়, কোনদিন? “
নিঃশব্দে, এক দীর্ঘশ্বাস যেন নিসৃত হলো তার নাসিকা হতে, যা তাকে অপ্রস্তুতে না ফেলে, তাই সামাল দিতে, কোন প্রয়াসই যেন বাকি রাখলেননা তিনি!
এটুকু বলে তিনি তার সাধ্বী হবার আগের জীবনের কথা উল্লেখ তো করলেনই না, উল্টে বরঞ্চ আর্দালীকে ডাকার আগে, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে, আমাকে নীরবতার অঙ্গীকারবদ্ধ করালেন, তার চোখের ইশারার অনুনয় সাথে!
তাদের যৌবনে যেমন একদিন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, আজ হলাম তার মাতৃরূপ দেখে!
আরো অনেকদিন পরে, আরেক সহকর্মী অধ্যাপিকার কাছে, শুনলাম, ওই তিনটি মেয়ে কিন্তু অনাথিনী ছিলো। তারা ব্রহ্মচারিণীর শপথ নিয়েই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
ভাবতে লাগলাম নারী কতশত রূপেই না অনন্যা!
কখনো কন্যা, কখনো মাতা! কিন্তু ভার্যা হওয়ার অধিকার কেন সকলে লাভ করেননা?
মহামায়ার এ কি মায়া?শ্রীগোবিন্দের এ কেমন বিচার! অনুভূতির স্বীকৃতি স্বরূপ এক ফোঁটা চোখের জল,যেন আমার নোট খাতায় পড়ে, আমার কলমের কালিকে, একটু হলেও ম্লান করে দিয়ে, ওই স্থানের একটি পংক্তিকে, নতুন করে পুনর্লিখিত করালো, ঠিক যেমন তিনটি কন্যার জীবনে এক অদ্ভুত মোড় এনে দিয়েছিলেন, ঈশ্বর, তাদের জীবনশৈলীর, প্রায় আড়াই যুগ পূর্বেই!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।