• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় অন্তরা দাঁ

চিরসখা হে

শোবার ঘরের বিছানার ঠিক মাথার দিকে রবি ঠাকুরের যৌবনের একটি পোর্ট্রেট টাঙানো আছে, সাদাকালো। নন্দিনী রোজ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে ।এখন সর্বক্ষণ বিছানা বন্দী সে। আদ্যান্ত আটপৌরে জীবনে এমন কিছুই নেই যা দিয়ে অন্তত বেঁচে থাকা টুকুকে প্রাণময় করে তোলা যায় ! শুধু এই ছবিটুকু ছাড়া ! একটা সাদামাটা যাপনে ওই একটিমাত্র ঢেউ, ক’টা কবিতা,গান, আর একটি ছবি !
মাছের ঝোল রান্না, বিছানা বালিশ রোদে দেওয়া, ইস্কুলের চাকরিটি ব্যতীত নিজের বলতে যখনই একটুকরো সময় পেতো নন্দিনী তখন শোওয়ার ঘরে এসে সেইদিকে তাকিয়ে কত কথা হতো, কত কী যে বলতো সে, অভিযোগ, অনুযোগ, প্রেম, বিরহ এমনকি সকাতর অনুরোধ অবধি করে ফেলতো , মাঝে মাঝে। এই নিয়ে তার স্বামী, ছেলে,বন্ধু-বান্ধবরা আওয়াজ দিলেও নন্দিনীর বিন্দুমাত্র কোনো কুণ্ঠা ছিলো না। ঠাকুরঘরেও তো মানুষ ঈশ্বরের সাথে কথা বলে? বলে না? তবে ? নন্দিনী তো ঠাকুরপুজোই করে, রবি ঠাকুরের পুজো। পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ বিশেষ করে সে ফুলমালা দেয়, সুগন্ধি ধূপ,শ্বেতপাথরের ছোট ডিশে সাদা সন্দেশ। খুব পবিত্র একটি অনুভূতি হয় তার। রবি ঠাকুরের গান গেয়ে সে পুজো হয়, সেইই তার মন্ত্রোচ্চারণ। বাড়িশুদ্ধ সবাই জানে তার রবীন্দ্রপ্রীতির কথা, তার সমর্পনের কথা। শুধু যে কথাটুকু জানেনা, তা বুকের কোন গভীর অতলে ডুবে আছে ঝিনুকজাত মুক্তোর মতো, তার খোঁজ তো একজনই জানে ! সেই এক আষাঢ়ের মেঘে মেঘে যে তাকে চিনেছিলো, ঝড়ের রাতে সেই এক সকাতর অভিসারে !
সামান্য লেখালিখির সূত্রে একজনের সাথে আলাপচারিতা পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠতায় এসে দাঁড়িয়েছিলো, তখন প্রায় শেষ যৌবন। কাছাকাছিই বয়েস ছিলো দুজনের, সব চাওয়া তো আর পাওয়াতে ধরা দেয় না, সেটা মেনে নিয়েই সম্পর্কটা শুরু হয়েছিলো, সেই আড়াল-আবডালের প্রেমে কোথাও বড় সামাজিক বাধা ছিলো, তার পরিবার, নন্দিনীর নিজের পরিবার, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, সম্মান এসব চিন্তা করে যা চেয়েছিলো তারা, তা আর করা যায়নি, তবে দুজনেই দুজনের প্রতি অত্যন্ত সৎ থাকতে পেরেছে এইই যা প্রাপ্তি। ভিন্ন ভিন্ন পরিবার তাদের, অথচ সে মানুষটি যেন একেবারে তার মতো, ইস্কুলফেরত কত বিকেল সন্ধে হয়ে গেছে, তারা নদীর জলে পা ডুবিয়ে কবিতা পড়েছে, রেস্তোরাঁ, বাজারে, সিনেমায়, ময়দানে তাদের দেখা হয়েছে, বিনিময় হয়েছে ভাবনাচিন্তা। সে এক প্রবল ভালোবাসার চূড়ান্ত সময়। দুজনেই মুগ্ধ দুজনাতে ,না-দেখা সইছে না তেমন করে। অথচ দুটি মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা জায়গা, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ! অথচ চিন্তাভাবনায় কী ভীষণ মিল তাদের, ইচ্ছে এমনকী রুচিবোধেও। রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতায় দুজনের প্রবল উৎসাহ, প্রায়ই এদিক ওদিক ম্যানেজ করে তারা শান্তিনিকেতন চলে যায়, সোনাঝুরির বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, কোপাইয়ের ধারে গলা ছেড়ে গান গায়। সময় কিন্তু গুহাবাসী শ্বাপদের মতো এগিয়ে আসছিলো গুঁড়ি মেরে, ওরা বুঝতেই পারেনি কোনোদিন অতর্কিতে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে তাদের প্রিয় সময়টুকু যা তাদের একান্ত নিজস্ব, যাকে তারা আগলে রাখে শিশুর মতো, দুজনেই, অনেক যত্নে।
শাশ্বত তাকে অনেকবার বলেছে আলাদা করে অন্যকোথাও থাকার কথা, এ জীবন ছেড়ে আলাদা করে বাঁচার কথা ! নন্দিনী পারেনি, কিছুই পারেনি সে কোনোদিন ,বারবার শাশ্বতকে সে বলছিলো তার অক্ষমতার কথা, সে শোনেনি। নন্দিনী বলেছিলো
—তুমি কেন চাইবে আমায় নিয়ে বাঁচতে?
—তোমায় ছাড়া আর কিছুই যে বাঁচিয়ে রাখে না আমায়!
—তোমার লেখা, ছাত্রছাত্রী, প্রেস…
—কোনোটাই যে তোমায় ছাপিয়ে নয়, নন্দিনী।
এ ঝড় ঠেকাবার সাধ্য যে তার নেই, তা স্পষ্ট বুঝেছিলো সে। দীর্ঘ মনহীন, শরীরহীন, অভ্যাসের দাম্পত্যে অভ্যস্ত নন্দিনী কি মুক্তি চেয়েছিলো জীবনের কাছে? নাকি একটি আপাদমস্তক রোমান্টিক পুরুষের তীব্র এই ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার শক্তি তার ছিলোনা আদপেই কোনোদিন। এই ম্যাজিক মোমেন্টসগুলো হারাতে চায়নি বলেই কী সে শাশ্বত’র সাথে থাকতে রাজি হয়নি কোনোকালে!
সেবার, খুব গরমের পর বৃষ্টি নেমেছে কলকাতা শহরে, মাটির সোঁদা গন্ধে নেশা লাগে নন্দিনীর। বাপের বাড়ি যাবার নাম করে সেবার সোজা শান্তিনিকেতন চলে গেছিলো তারা। শাশ্বত’র ও বর্ষা খুব পছন্দের ঋতু। ডাহুক ডাকা একটা আষাঢ়ের সমস্ত দিন তারা মেঘদূত পড়েছে দুজনে, একটার পর একটা বিরহের গান গেয়েছে নন্দিনী, শাশ্বত তাকে বলেছে
—তুমি আমার কাদম্বরী !
—রবি ঠাকুরের বুঝি এমন সাদা শাড়ি পরে, মাথায় জুঁইয়ের মালা দিয়ে কবিতা পড়া পছন্দ ছিলো?
—ছিলোই তো!
দুহাতে কাছে টেনেছে নন্দিনীকে। তারপর একটা স্বপ্নের মতো রাত। নন্দিনীর পিঠে লাল জরুলটিতে যে কতবার মুখ রেখেছিলো সে, প্রতিটি আঙুলে, নখে, সিঁথিতে, রোমকূপে রোমকূপে আদর করেছিলো তারা পরষ্পরকে। সেই প্রথম নন্দিনী বুঝেছিলো ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ‘! এতদিন যা হয়েছে শরীরে, তা শুধুই নিবৃত্তি, এই প্রথম বাঁধ ভাঙলো মিলনের। সেই রাত সকাল হয়, দুটি মানুষ দুজনকে আঙুল ছুঁয়ে কথা দেয় আবার ফিরে আসার, নির্দিষ্ট রিসর্টের সেই ঘরটিতে। এরপর বহুবার তারা একসাথে ভোর দেখেছে, রাতের তারা গুনে গুনে কাটিয়েছে সময়, আনন্দঘন অবকাশ ঘিরে রেখেছে তাদের ইচ্ছের এক্কাদোক্কা ঘর।
বছর তিনেক আগে হঠাৎই ক্লাস নিয়ে আসার সময়, কমনরুমে ঢোকার আগে, বুকে একটা তীব্র ব্যথা, অন্ধকার সবকিছু, কানে এসেছিলো একটা অস্ফুট গুঞ্জন ‘পড়ে গেছে, পড়ে গেছে ‘। ম্যাসিভ স্ট্রোক, তিনদিন সজ্ঞাহীন ।পরে পরে জেনেছিলো আত্মীয়স্বজনের মুখে, শাশ্বত রোজ এসে সারাদিন বসে থাকতো নার্সিংহোমের বাইরে, আবার রাতে ফিরে যেত। কোথায় যেত সে ? এ শহরে নন্দিনী ছাড়া যে তার আর কেউ নেই, কেউ ছিলো না কোনদিন। বড় বাড়ির বড় কেচ্ছা রটানো খুব সহজ। নন্দিনী ফিরে এসেছিলো, কিন্তু আংশিক পক্ষাঘাত কেড়ে নিলো তার শরীরের ডানদিকের সব কর্মক্ষমতা, লেখালিখিও গেলো, চিরদিনের মতো। শাশ্বতকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু মন থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য কী কারোর আছে ? নন্দিনীর সব গান, কবিতা, লেখা তো তারই। আজও নন্দিনী রবি ঠাকুরের ওই ছবিটির ভেতর শাশ্বতকে খোঁজে, ওই ছবিটি তাকে উপহার দিয়েছিলো শাশ্বত, তাদের পাগল-পাগল প্রেমের দিনে। বড় প্রিয় ছবিটি। এই পড়ন্ত বেলার আলোয় গুরুদেবের ছবির ভেতর স্পষ্ট ফুটে ওঠে শাশ্বত’র মুখের আদল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।