T3 || সৌরভ সন্ধ্যায় || লিখেছেন অরিন্দম দেব ( বিদূষক অরিন কবি)

তমসাচ্ছন্ন ও সৌরভহীন কাব্যজগৎ

তাকে তখনও সেরকম চিনিনা। সবেমাত্র এটা – ওটা – সাপ – ব্যাঙ, লিখে ফেসবুকে পোস্ট করছি, আমি একেবারেই কাউকেই চিনিনা, নাঃ কবিতার সার্কিটে তো নয়ই!
একদিন কবি আফতাব মল্লিকের ফোন এলো – তখন সাহিত্য গ্রুপ বলতে আমার একমেবাদ্বিতীয়ম “ স্বপ্নসাজি” – এর বাইরে কোন লেখা প্রায় নেই, তবে ফাদার দ্যতিয়েনের অনুপ্রেরণায় প্রথম ছড়ার বইটা কেবল আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে রামমোহন লাইব্রেরি হলে, নিশিদিন পত্রিকার সমীরদার ( ভট্টাচার্যের) ও ডঃ মঞ্জু সরকারের সৌজন্যে!
আফতাবের প্রস্তাবে শাশ্বতী ভট্টাচার্যের হাত ধরেই প্রথম বাংলা আকাদেমিতে আমার প্রবেশ – সেখানে আলাপ ঋজুরেখ ও অজিতেশের সাথে!
আর তারপর শাশ্বতীই আমাকে আর পিছনে তাকাতে দেয়নি!
তার সঞ্চালনায় তিনটি টিভি অনুষ্ঠানের পরে আমার সৌরভ চন্দ্রের সাথে পরিচয়! হ্যাঁ – চতুর্থ অনুষ্ঠানে শাশ্বতী তারই সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো!
সেদিনের অনুষ্ঠানে অনেকেরই ডাক পড়েছিলো – একসাথে দুটি কি তিনটি স্লটের শ্যুটিং – ফ্লোরে চন্দন ভট্টাচার্য সহ তরুণ তুর্কি কবি তপোব্রত মুখোপাধ্যায়।
আমার নিজেকে কবি বলতে তখনও কিরকম শঙ্কা বোধ হতো, যদিও শাশ্বতী তার অনুষ্ঠানের মাঝ দিয়ে আমাকে শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার বিদূষক পরিচয়টা ছড়িয়ে দিয়েছে!
একটা শ্যুট অলরেডি চলছিলো ওই মহালয়ার একটু আগেই হবে – ২০১৮! আমি ঢুকতেই আমার সাথে এক যুবকের পরিচয় করিয়ে দিলো শাশ্বতী – যার নীল পাঞ্জাবী পরণে দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো, যেন আভিজাত্যের মূর্ত প্রতীক –হ্যাঁ বনেদী পরিবারের ছেলে বটে!
কথায় কথায় জানলাম তার বাংলা আকাদেমিতে কবিদের নিয়ে কাজ, অবশ্যই পাশের মানুষের মুখে, কারণ নিজের ঢাক পেটানোর মতন মানুষ সৌরভ আদৌ নয়!
সেই স্টুডিও ফ্লোরে বসে জমলো আড্ডা অপেক্ষমান কবিদের মধ্যে।!
আমার কবিতা শুনতে চাইলে ছেলেটি!
আমি তাকে আমারই একটি সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করা মণ্ডুকোপনিষদের একটি শ্লোকের বাংলা ও ইংরাজিতে ছন্দে ভাষান্তর পড়ে শোনালাম ,যেখানে মহারাণী মদালসা তার সদ্যোজাত পুত্রকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সেই শ্লোক গেয়ে – যখন তার পিতৃদত্ত নামে অসন্তুষ্ট হয়ে বিলাপে সেই শিশুপুত্র ক্রন্দনরত হয়েছে সেই ক্ষণে – মহারাণী মদালসা গাইলেন – “নামে কি আসে যায় ? “ যার ওপরে সেই শ্লোকের অবতারণা ছিলো!
এই প্রধান সংস্কৃত থেকে বাংলা ও ইংরেজিতে ছন্দানুবাদ সে শুনলো, প্রায় দশ মিনিট – অন্যদের কথা
থামিয়ে দিয়ে, যেই কেউ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।
আরো কয়েকজন পড়লেন তাদের স্বরচিত কবিতাগুলো। তাদের কবিতার যে যে বিশেষ পংক্তিগুলো তার ভালো লেগেছে, সেগুলো তুলে নিয়ে সৌরভ বললো কেন, কী কী কারণে তার সেটি ভালো লেগেছে।
আমার বেলায় কিন্তু কোনো কথা বললোনা। আমি ভাবলাম তার ভালো লাগেনি – আমি আরো কিছু মজার ছড়া পড়লাম – সকলেই উপভোগ করলো – সৌরভ কেবল হাসলে!
আমি আন্দাজ করলাম যে আমি মনঃসন্তুষ্টিতে ভুগছি – মজার ও ভালো লিখি বলে, আজ কষ্টিপাথরে যাচাই করে বোঝা গেলো আদৌ পাতে দেবার যোগ্য হয়তো নয় এবং কেবলই বাণিজ্যিক তোষামোদির জন্য সবাই আমার লেখা ভালো বলে!
এহেন আচরণ বা প্রসংসার অভাববোধ আমার আদৌ খারাপ লাগেনি, কারণ বিজ্ঞানের মাষ্টার, বাংলা কবিতা – ছড়া লেখার ধৃষ্টতা হয়তো সাজেইনা, ( কাকের ময়ূর পালক পরার মতন এক প্রয়াস) তবু শাশ্বতীর ওপরে আমার ভরসা অগাধ, মেয়েটি আর যাই হোক, মিথ্যা তোষামোদ করেনা, সে প্রকৃত জহুরী, কাব্য কবিতার বেলাতে!
তবে আমি ভাবলাম হয়তো আমাকে কবিতা লেখার ইতি টানতেই হবে! কারণ বাংলা আকাদেমির এমন একজন মানুষ, কবিতাই যার ঘরবাড়ি, তার প্রকৃত অর্থে পছন্দ হয়নি আমার লেখা!
একটু পরে শাশ্বতী ,একটি শ্যুট সেশনান্তে, আমাকে, তপোব্রত ও সৌরভকে ডাকতে বেরিয়ে এলো!
প্রথম প্রশ্ন সৌরভকে – “ আমার এই বিদূষক দাদাটিকে কিরকম লাগলো? “
ততক্ষণে কবি চন্দন ভট্টাচার্য বেরিয়ে এসেছেন তার শ্যুট শেষ করে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন – “ দাদাভাই , আপনাকে দেখে মনটা ভরে গেলো! কিন্তু আজ বড্ড তাড়া – শ্বশুরমশাই অসুস্থ, এখুনি মেদিনীপুর ফিরতে হবে যে। পরে কথা হবে! “তিনি বেরিয়ে পড়বেন – এমন সময়
সৌরভ হঠাৎ বলে উঠলো –
“ আজ অবধি কিন্তু আমি এমন দেখিনি! “
আমরা সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে সে বলে চললো – “ একজন মানুষ, একজন মাস্টারমশাই, তিনি অবলীলাক্রমে চার পাঁচটি ভাষা বলছেন, নির্ভুল উচ্চারণে, এবং একটি সংস্কৃত শ্লোক উপনিষদের অনুবাদ করেছেন, তিনটি ভাষায়?
আর তাছাড়া এতগুলো ভাষায় অনায়াস দক্ষতা, এর আগে কারো আমি দেখিনি! আপনাকে মশাই
কাল্টিভেট করতে হবে “
স্মৃতি উস্কে দিলেও, কোনো ভাঁড়ামো বা কমেডি বা শ্লেষ তার কণ্ঠে কিন্তু একেবারেই নেই!
“শাশ্বতী তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এমন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে! “
আমি আমার উত্তর ও সৌরভের নীরবতার ব্যাখ্যা পেলাম আমার রচনার বিষয়, তাকে সেই শ্লোক যেন তখনও ভাবাচ্ছিল।
“ সৌরভদা এতো সবে শুরু – অরিন্দম দা কে আমাদের সকলেরই চেনা বাকি! চলো তোমরা শ্যুটিং এর সময় হয়ে গেছে! “
সে অনুষ্ঠানেই তার স্বকণ্ঠে ধর্মকুকুর গ্রন্থের – “ বাবার শেষ পেনশন “ শুনে নিজের বাবার স্মৃতিতে যেন মনটা কঁকিয়ে উঠলো!
অনুষ্ঠান তো দারুণ হয়েছিলো, এবং আমার ছড়াকে “ সুকুমারী” তকমা দিয়ে আমি “বিদূষক শিশুসাহিত্যিক”, এটি যেন জ্যামিতিক পাইথাগোরীয় পদ্ধতিতে তার অ্যানালিসিসে শাশ্বতীর এই বিশেষণের সাথে মতৈক্য পোষণ করে আমাকে কলম চালিয়ে যেতে বললো সৌরভ ।
অনুষ্ঠানের শেষে – শিগগির দেখা হবে – বলে এই “ কাব্যরাজপুত্র “ সেদিনের মতন বিদায় নিলো।
এই “ শব্দশ্রমিক “, চ্যানেল ভিশনে আজও সমান জনপ্রিয় , যদিও করোণার জন্য এখন স্থিত হয়ে আছে!
সেই শুরু!
এরপরে একদিন কাগজে দেখলাম “সুনীল সারণী” নামক একটি অনুষ্ঠান হবে, সুনীলদা অর্থাৎ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে!
তিনদিনব্যাপি অনুষ্ঠানের শেষ দিনে হাজিরা দিলাম জীবনানন্দ সভাগৃহে, কেবল শুনতে। গিয়ে শুনলাম সৌরভ একজন উদ্যোক্তা!
আমি একেবারে শেষ সারিতে বসে আছি ।সৌরভ ঢুকে আমায় দেখতে পেয়ে, আমি হাত নাড়াতে,এসে আমাকে পায়ে হাত দিয়ে একেবারে সোজা প্রণাম!
আমি তখন লজ্জায় কুঁকড়ে যাই, বলতে গেলে! সে কিন্তু বললো “ স্যার, আপনি প্রথম সারিতে এসে বসুন! “
আমি বললাম “ এখানেই তো ঠিক আছি, দর্শকরূপে ,দর্শকাসনে “
“ তা বললে হয়! আমরা পেছনের সারিতে থাকার লোক। আপনার মতন মানুষকে আমরা চিনতে পারিনি এটা আমাদের লজ্জা,বাংলা আকাদেমির লজ্জা! আপনাকে সামনের সারিতে বসতেই হবে, নাহলে আমার অপমান, আমাদের সকলের অপমান ! “
এরপর অগত্যা সামনের সারি না হলেও সলজ্জে , দ্বিতীয় সারিতে উঠে গিয়ে বসলাম!
বেশ ডুবে গিয়ে ছিলাম! সকলে স্মৃতিচারণা করছিলেন, একের পর এক নামকরা নামকরা সব কবিরা – আমি তাদের পরিবেশনে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম….
হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এলো একটি ঘোষণায় – “ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট শিক্ষক এবং কবি অরিন্দম দেব। আমি তাকে আগামী এক ঘন্টা, পরবর্তী কবিতার সেশনটির সভাপতিত্ব করার জন্য মঞ্চে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করছি! “
কিছু বোঝার আগেই যেন যান্ত্রিকভাবেই আমি চালিত হয়ে মঞ্চের মধ্যমনি হয়ে বসলাম এবং আমার স্মৃতিচারণায়,সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পাঠ করা সুনীলদার “ আমার কজন বন্ধু “ আমি পড়ে শোনালাম, যা আলাদা করে আমাকে উনি শুনিয়েছিলেন।তাও ১৯৮৫ সালে! মানে ৩৪ বছর আগে!
এই যে এতটা সম্মান প্রদর্শন বাংলা আকাদেমিতে,আমার মতন নগন্য এক শিক্ষকের যোগ্যতা থাক কি না থাক,না ভেবে, এর প্রদর্শন হয়তো সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের মতন এক মহিরুহের পক্ষেই সম্ভব ছিলো!
তারপরে বহু কথা তার সাথে তথা বন্ধুতা, বেশ কিছু অনুষ্ঠানে একসাথে কথাবার্তা , শেষ গত মার্চের শুরুতে অভিনেত্রী সোনালী ঘোষের জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের ডাক – যেতে পারিনি স্কুলের পরীক্ষার কাজের জন্য – কেন? – আজকে তার জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে, চোখ জলে ভরে আসছে – এত শীঘ্র যে সব অতীতের স্মৃতি হয়ে যাবে এ আমার কল্পনাতীত ও ভয়ংকর দুঃস্বপ্নসম!
১৯৮০ সালে মহানায়ক উত্তমকুমারের তিরোধানে বিকাশ রায় বলেছিলেন – “ এক বয়ঃজ্যোষ্ঠ চলচ্চিত্রশিল্পী হয়ে, একজন অনেক কণিষ্ঠ শিল্পীর হয়ে শোকজ্ঞাপন মারাত্মক মর্মন্তুদ নয় কি ? সে তো আমার চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোট, সন্তানসম , আমি না হয়ে সে কেন? এর উত্তর আমৃত্যু আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে! “
আমিও একই সুরে বলবো, বকরূপী ধর্মকে যুধিষ্ঠির তারই এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন – “ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ “ – কিন্তু নিঃসন্তান স্নেহশীল এক মানুষের কাছে এ দুঃসংবাদ পুত্রশোকের চেয়ে কি কিছু কম? পাঠকেরাই বলুন না?
সৌরভের অনুরোধে আমি তার দুটি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলাম, সে দুটি পড়ে সে ভীষণ খুশি হয়েছিলো, বলেছিলো “আমার কবিতার ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে, ছন্দে অনুবাদ, কেবল আপনার পক্ষেই সম্ভব স্যার আমার এটা পরম সৌভাগ্য ও প্রাপ্তি “
আজ তাই, তারই একটি প্রিয় কবিতার ইংরেজি অনুবাদ এখানে স্থান দিলাম, তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে!
সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু নেই, সে মৃত্যুঞ্জয়! কারো সাথে তার কোনোই তুলনা হয়না – সে নিজে এক প্রতিষ্ঠান বা ইন্সটিটিউশন!
SPEAK OUT
A Poem in Bengali by Sourav Chandra Mukherjee
The first love letter
After birth from the womb
A carcass of love
Bespattered in a tomb!
A silence so tranquil
Uncannily as it pleads
Oh flower, bleeding flower
Do speak out, speak out please!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।