হৈচৈ ছোটদের গল্পে অংশুদেব

গোপালের পদোন্নতি

সভায় এসে সিংহাসনে বসে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সকলের দিকে বিশেষ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন। মন্ত্রী সেই দেখে বললেন – মহারাজ আজ ভালো কিছু শোনাবেন মনে হচ্ছে?
তা তো অবশ্যই। মহারানী আজ বলেছেন, আমার রাজ্যের সবাই যাকে চেনে , এমন ব্যক্তিকে উনি এবারের পুজোয় সেরা মানুষের পুরষ্কার দেবেন। আচ্ছা মন্ত্রী আমার রাজ্যে কে সকলের পরিচিত,মানে সকলেই তাকে চেনে — এমন হতে পারে?
মন্ত্রী বললেন, কেন মশকরা করছেন রাজা মশাই, এ প্রশ্নের উত্তর কে না জানে? রাজ্যের রাজা সকলের চেনা।
অন্য সকলে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, মন্ত্রী মশাই ঠিক বলেছেন।
কেবল গোপাল ভাঁড় মুখটা ওপর দিকে করে বসে রইল । রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কি হল গোপাল, তোমার মত কি কড়িবর্গায় আটকে গেছে?
গোপাল বলল , মহারাজকে সন্তুষ্ট করার মতো আর কিছু আছে কিনা দেখছিলাম।
গোপাল আর কি বলবে মহারাজ? ভাঁড়ের এর থেকে আর বেশি কি বা বলার আছে ? মন্ত্রী বললেন।
মহারাজ মন্ত্রী মশাই অতি প্রাজ্ঞ ব্যক্তি।যদি বলেন সূর্য উত্তর দিকে ওঠে , আমাদের মেনে নিতে হবে? গোপাল উত্তর দিল।
তা তোমার উত্তরটা কি শুনি? মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
মহারাজ কিছু মনে করবেন না ,রাজ্য আপনার হলেও, কারো অত দায় পড়েনি আপনাকে চিনে রাখার। গোপাল উত্তর দিল চাঁচাছোলা ভাষায়।
গোপালের উত্তরে মহারাজ অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, গোপাল তুমি যা বলছো , তার পরিণতি কি হতে পারে জানো ?
গোপাল হাত জোড় করে বলল , মহারাজ ভাঁড় বলে কি , ঠিকটা বলার অধিকার নেই? তবে তাই হোক, মন্ত্রী মশাই তাহলে প্রমাণ করুন।
বেশ তাই হোক মহারাজ।কালই প্রমাণ হয়ে যাক। মন্ত্রী বললেন।
ঠিক আছে , কালই প্রমাণ হোক। গোপাল, তুমি যদি হেরে যাও , তাহলে এই কৃষ্ণনগর রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বললেন।
তাই হবে মহারাজ। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
বলো তোমার শর্ত?
আমাদের দলে যারা থাকবেন, সকলকে চাষাভুষো ,মুটে মজুর ,দোকানদার সাজতে হবে। কিছু বলশালী পেয়াদাও থাকবে তবে ছদ্মবেশে এবং দূরে ।
পরের দিন অন্ধকার থাকতে যে যার মতো ছদ্মবেশ ধারণ করে বেরিয়ে পড়ল । মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সাজলেন সব্জি ব্যাপারী। মন্ত্রী সাজলেন মুটে । গোপাল হল গোয়ালা। পণ্ডিত হল চাষী । তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে দূরে একটা গ্রামে গিয়ে ঢুকল।
সেখানে তখন চাষের ক্ষেতে ধান রোয়ার কাজ চলছিল । গোপাল বলল, পণ্ডিত মশাই যান ওই চাষীদের একটু জ্ঞান দিয়ে আসুন। আমরা ততক্ষণ এই বটের ছায়ায় বসি।
পণ্ডিত এগিয়ে গেলেন ক্ষেতের কাছে। সেখানে তিন জন চাষী বীজ পুত ছিল। পণ্ডিত গিয়ে বললেন, মূর্খ বামে যাত্রা শুভ নয়। ডান দিয়ে শুরু করতে হয় । সেই জন্য তোরা ভালো ফসল পাস না।
তিন জনে দাঁড়িয়ে উঠে একে অন্যের দিকে তাকাল। একজন বলল, এ কোত্থেকে পণ্ডিতগিরি করতে এলো রে? তা কেমন একটু রুয়ে দেখাও দেখি ?
পণ্ডিত খোঁচা দুলিয়ে নরম মাটিতে হাঁটতে গিয়ে কাদা জলে পড়ে কাপড় গেল খুলে। তাই দেখে মাঠের সব চাষী হেসে উঠলো। তিনি তাড়াহুড়ো করে কাপড় হাঁটুর ওপর তুলে গুঁজে নিলেন এমন ভাবে যে দেখে বোঝা গেল তিনি এ কম্মের কেউ নন ।যাই হোক বীজ হাতে নিয়ে ইষ্ট দেবতাকে স্মরণ করতে গিয়ে মুখে কাদা লাগিয়ে ফেললেন। তাতেও সকলে হেসে ফেললো। তিনি ধমক দিয়ে ক্ষেতে একধারে গিয়ে দক্ষিণ দিক বেছে ডান হাত দিয়ে ডানদিক দিয়ে শুরু করতে গিয়ে বাম দিকে আড় হয়ে পড়লেন কাদা জলে । একজন হাসতে হাসতে কাছে এসে হাত ধরে তুলে টানতে টানতে নিয়ে গেল রাস্তার ধারে । বললো, এখন যাও তো বাপু। আগে কোঁচা ঠিক করে পড়তে শেখো ।পরে এসো চাষ করা শিখিয়ে দেবো।
পণ্ডিতের ল্যাজেগোবরে করুন অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে সকলে হেসে ফেললো। মন্ত্রী বললেন, পণ্ডিত ওপর থেকে যা বলছিলে বলতে পারতে, নিচে নামতে গেলে কেন?
হ্যাঁ, নিচে নামতে গেলে কেন ? দেখো দেখি – রাজা সহমর্মি হয়ে উঠলেন।
উনি তো মন্ত্রী নন রাজা মশাই ,জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানের পরিচয় দেবেন না,তা কি হয় ? তা কি আর করা যাবে । চলুন সামনে একটা স্নানের ঘাট আছে,ওখান থেকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেবেন। ওপর থেকে সব জ্ঞান হয় না পণ্ডিত মশাই, হাতে নাতেও করতে হয়।
গ্রামের পথে লোকজন কম।ঝোপ ঝাড়,গাছ পালা বেশি । কিছুদূর যেতেই দেখা গেল এক বৃদ্ধা ঝুড়িতে করে বড় বড় আম নিয়ে যাচ্ছে । গোপাল বলল, রাজ্যের মন্ত্রী আপনি। যান না, আমাদের ক’জনের জন্য কটা আম নিয়ে আসুন।
মন্ত্রীর বিশ্বাস রাজ্যের লোক তাঁকে রাজার চেয়ে বেশি চেনে । তার প্রমাণ দেবার সুযোগ পেয়ে এগিয়ে গেলেন । গোপালের পরামর্শে রাজা সহ সকলে ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ গো , ও বুড়ি এত আম নিয়ে কোথায় চলেছো ?
কোথায় আবার যাব, এত আম নে লোক খাবে নাকি? বৃদ্ধার মেজাজ গরম। বুড়ি বলে ডাকায় রাগ হয়েছে বোঝা গেল ।
ও ,তা আমাদের কটা দাও, খেয়ে দেখি ।
বৌনিবেলা বেশি দাম নোবনি । একটা আম এক আনা নোব।
তুমি আমাকে চেনো না, আমার কাছে দাম চাইছো?
তুই কে রে ড্যাগরা? বিনে পয়সায় আম নিতে এ্যায়চিস ? দুর হ , মুখপোড়া — বলে রাস্তার পাশ থেকে একটা ডাল তুলে নিয়ে তেড়ে গেল।
মন্ত্রী সেখান থেকে ছুটে মেরে পালিয়ে নিজের মান রক্ষা করলেন।
সেই দেখে রাজার মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি গোপালকে বললেন — আর পরীক্ষা করে কাজ নেই। চলো ফিরে যাই ।
পণ্ডিত এবং মন্ত্রী ততক্ষণে বুঝে গেছে শেষ পর্যন্ত কি ঘটতে চলেছে। কিন্তু নিজেদের অপদস্থ হবার রাগটা মেনে নিতে পারছিল না। তাই পণ্ডিত বললেন, সেকি মহারাজ, রাজ্যের লোক আপনাকে চিনবে না এ হতে পারে?
কক্ষনো না , রাজা সর্বত্র পুজ্যতে , শাস্ত্রে বলেছে। মন্ত্রী বললেন।
ঠিকই, ঠিকই। পণ্ডিত সমর্থন করলেন।
আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে, যদি —
মন্ত্রী বলে উঠলেন, না রাজা মশাই গোপালের কথা সত্যি হতে পারে না। ও ভাঁড় , রাজপদের মহিমা ও কি বুঝবে ?
তাই চলো ,দেখি ।
সকলে হাঁটা শুরু করলে গোপাল পিছন থেকে বলল , একেই বলে সংকট কালে বুদ্ধি নাশ ।
রাজা মশাই পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বললে গোপাল ?
না বলছিলাম,এদিকটা না এলেই ভালো হত।
কেন কেন গোপাল?
লোকজনের হাব ভাব দেখে —
মন্ত্রী তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন — বলেছিলুম না । যার রাজ্যে বাস করে, তাকে চিনবে না হতে পারে ?
মুখে যা বলুন না কেন, মনে মনে তিনি হাসছিলেন। কেননা লোকজনের চলা ফেরায় তার কোনো লক্ষণ ধরা পড়েছিল না।
পণ্ডিতও মন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললেন, রাজা মশাই,গোপালের এবার জোর শিক্ষা হবে।
রাজা মনে মনে আনন্দ অনুভব করলেন।
তাঁরা ততক্ষণে একটা নদীর ঘাটের কাছে এসে পড়েছেন। সেখানে পাইকাররা পাশের বাজার থেকে মাল কিনে মুটের মাথায় করে নৌকায় তুলতে ব্যস্ত। গোপাল একটু দূর থাকতে দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, রাজা মশাই ওখানে গিয়ে নৌকায় মাল বোঝাই করা বন্ধ করুন দেখি ।
মন্ত্রী উৎসাহিত করলেন, যান যান রাজা মশাই, এ আবার কঠিন কাজ কি ? আপনি রাজ্যের রাজা।
রাজা মশাই উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে গেলেন। ঘাটের কাছে গিয়ে বললেন, এই মাল বোঝাই করা বন্ধ করো ।
মুটেরা থমকে একটু দাঁড়ালেও মাথার বোঝা নামাতে নৌকায় উঠে গেল।
রাজা মশাই সেই দেখে রেগে উঠলেন, কি হল কথা কানে যাচ্ছে না বুঝি ?
প্রথম নিষেধে কেউ কেউ ফিরে তাকিয়ে ছিল। দ্বিতীয়বার আদেশ করতে পাইকাররা তাঁকে ঘিরে ধরলো — তুই কে রে , রাজার পেয়াদা নাকি ?
আমি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
ওরে রাজা এসেছে রে । সিংহাসন নিয়ে আয় ।
আরো অনেকে না না রকম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা শুরু করলো। একজন খালি ঝাঁকা সামনে ফেলে দিয়ে বললো, বসুন মহারাজ।
রাজার রুচিতে বাঁধলো। তিনি আরো রেগে উঠে বললেন, এই কে আছো , এদের বন্দী করো ।
জনতা ততক্ষণে পাগল ভেবে ঠেলাঠেলি টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মাটিতে পড়ে গেলেন সামলাতে না পেরে।পরণের কাপড় খুলে যাবার মতো অবস্থা।
মন্ত্রী আর পণ্ডিত তাই দেখে দিল ছুট। গোপালের ইঙ্গিত পেয়ে পেয়াদারা ছুটে এল । তাদের নিয়ে গোপাল ছুটে গিয়ে মজা পাওয়া জনতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো । গোপালকে দেখতে পেয়ে রাজার কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা।
ও গোপাল আমাকে রক্ষা করো।
গোপাল দু হাত তুলে জনগণের উদ্দেশ্যে গলা তুলে বললো, তোমাদের এই ঘাট বন্ধ করে দেওয়া হল । এই বাজারও বন্ধ করা হল। রাজা মশাই এসেছিলেন এখানে পাইকারদের কাজকর্ম নিজের চোখে দেখতে । তোমরা দেশের রাজাকে চেনো না ? তোমাদের এই রাজ্যে আর বাণিজ্য করা চলবে না ।
জনতা অনেক পিছনে সরে গেল। দূরে গিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাদের মধ্যে একজন বলে উঠলো ল– আমাদের খুব ভুল হয়ে গেছে মহারাজ। আমাদের এবারের মতো ক্ষমা করে দিন।
সকলে তাকে সমর্থন করে বলল , হ্যাঁ হ্যাঁ রাজা মশাই আমাদের ক্ষমা করে দিন । এ ভুল আর কখনো হবে না ।
আস্তে আস্তে। গোপাল হাত তুলে থামিয়ে বলল , তোমরা রাজা মশাইকে সত্যি কেউ চিনতে পারনি?
সত্যি বলছি গোপালদা । আমরা ভাবলুম আমাদের মতো কেউ। মাথার গোলমাল হয়েছে বোধহয়। একজন উত্তর দিল।
পটা ঘটা এসেছিল?
হ্যাঁ, একজনকে বসিয়ে রেখে চলে গেছে কলুরহাটে । ওই রকম তো করে। সেই লোকটা বললো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল তোমরা রাজসভায় এসো, দেখি কি করা যায়।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে জনতার মুখোমুখি হননি কোনো দিন। কিন্তু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, রাজ্যের লোক রাজাকে চিনবে না এ হতে পারে? তিনি সারাটা পথ কারো সঙ্গে কথা বললেন না ।ওই ধস্ত অবস্থায় রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন ।
পরের দিন রাজসভায় রাজা এলেন বেশ গম্ভীর। সিংহাসনে বসে তিনি কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকার পর মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন — কাল তুমি কোথায় গিয়েছিলে শুনি?
মন্ত্রী আমতা আমতা করে বললেন – না মানে আমরা ভয় পেয়েছিলুম।
মন্ত্রীর কর্তব্য কি ?
মানে এই ,রাজাকে পরামর্শ দেওয়া।
কাল কে আমাকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল?
খুব ভুল হয়ে গেছে মহারাজ। আর কক্ষনো হবে না। এবারের মতো ক্ষমা করে দিন মহারাজ।
ক্ষমা ? অযোগ্যের হাঁড়ি । কাল থেকে ওই দ্বাররক্ষীর পাশে দাঁড়াবে। তোমার জন্য কাল আমার এত হেনস্থা হল। তারপর সভাসদদের উদ্দেশ্যে বললেন — সত্যি অবাক কাণ্ড, রাজ্যের লোক রাজা বা মন্ত্রীকে চেনে না!
সেটাই স্বাভাবিক মহারাজ । রাজবদ্যি বললেন ।
স্বাভাবিক কেন বলছো রাজবৈদ্য ?
মহারাজ সবাই যে যার কাজ নিয়ে থাকে। তাছাড়া রাজ্যে চুরি, ডাকাতি , অশান্তি লেগে থাকলে লোক রাজ দরবারের দিকে ছোটে। আমাদের রাজ্যে প্রজা সুখে আছে বলে, রাজা ও রাজকর্মচারীদের অত চিনে রাখার প্রয়োজন হয়না। দুর্নীতিবাজ প্রজারাই তো রাজকর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ।
বিজ্ঞানী রাজবৈদ্যকে সমর্থন করে বললেন — রাজবৈদ্য ঠিক বলেছেন মহারাজ।
অন্যরাও সমর্থন জানালেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ‘ , কেবল গোপাল ছাড়া। রাজা মশাই তাকে জিজ্ঞেস করলেন — গোপাল চুপ কেন ? তুমি কিছু বলবে মনে হচ্ছে ?
মহারাজ প্রজা সুখে আছে কিনা সেটার খোঁজ রাখাও তো রাজার কর্তব্য। গোপাল বলল।
কেন গোপাল মন্ত্রী আছে, সভাসদ, পাইক, বরকন্দাজ, প্রহরী আছে। এরাই রাজাকে খবর দেবে। এটাই তো নিয়ম !
মহারাজ নিয়ম মেনে কি সব কাজ হয়। ছেলে না কাঁদলে মা দুধ দেয়। আপনি খোঁজ নিতে চাইলে ওনারা এনে দেবেন। সে তো ওপর থেকে দেখা, হাঁড়ির খবর কি দিতে পারবে ?
তা তো ঠিক । তাহলে কি করা যায়?
আমি বলব মহারাজ? মাঝে মাঝে নগর ভ্রমণে বের হলে প্রজাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। মেলা করলেও বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। মন্ত্রী বললেন।
রাজা মশাইয়ের তো আর কোনো কাজ নেই, উনি কেবল নগর ভ্রমণ করে বেড়াবেন। গোপাল বলল।
ঠিক আছে রাস্তায় রাস্তায়, বাড়িতে বাড়িতে, দোকানে দোকানে রাজার ছবি রাখার হুকুম দিলে তো হয় !
রাজা মরা কোনো ব্যক্তি নয়। মনে করিয়ে দেওয়াটা, মনে করা নয় । যাদের মনে সংশয় থাকে ,তারাই মনে করিয়ে দিতে চায় । ঠাকুর দেবতা কাউকে মনে করায় না । তাঁদের নগর ভ্রমণ বা মেলা করত হয় না। তাছাড়া আপন না ভাবলে কেউ মনের কথা বলে না। গোপাল বলল।
ঠিকই। এই মাথামোটা মন্ত্রীর ঘটে সে বুদ্ধি আছে ? রাজা মশাই মন্ত্রীর ওপর চটে গেলেন। তারপর সভাসদদের দিকে তাকিয়ে বললেন — আজই এর একটা উপায় বের করতে হবে।
সবাই চুপ।
রাজা মশাই বললেন, গোপাল তুমিই বলো। এরা সব গোবর গণেশ। এদের মাথায় কিছু খেলে না।
রাজা মশাই , রাজার শক্তি বাহুতে বা সৈন্যসামন্ত রাজকর্মচারীতে নেই । জলের নিচে বাঁধা ভাঙছে কি না তা আগে টের পায় জেলে , ডুবুরি। তাই লোকের মনের খবর জানতে হলে ওদের লোকই দরকার । মানে আপনার নিজের গোপন লোক। তাহলেই রাজার সঙ্গে প্রজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। প্রজারা আপনার কথা মনে করবেন, আপনিও প্রজাদের কথা ভাববেন ।
বাঃ এটা তো রাজনীতিসুলভ পরামর্শ। এতেই রাজশক্তি বৃদ্ধি পাবে । কি বলো তোমরা?
সভাসদরা ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ‘ করে উঠল ।
তাতেও সবাই চিনবে না রাজা মশাই।
সেকি ! আবার কি করতে হবে?
পোষাকে চেনে রাজা ,কর্মে চেনে মেথর।
ও হোঃ হোঃ, গোপাল এবার বুঝতে পারছি কাল কেন সব্জি ব্যাপারী সাজতে বলেছিলে। সত্যি বুদ্ধি তোমার, আমার চোখ খুলে দিলে গোপাল।
আরো একটু বাকি আছে।
এখনো বাকি ?
সেই সময় প্রহরী এসে বললো , মহারাজ ব্যাপারীরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
দাও , ওদের পাঠিয়ে দাও। রাজা মশাই আদেশ করলেন।
সব্জি ব্যাপারী,পাইকার,মাঝি সব দল বেঁধে সভায় এসে দাঁড়ালো । রাজা মশাই জিজ্ঞেস করলেন — তোমাদের কি দরকার বলো ?
সেকি রাজা মশাই কাল যাদের দেখলেন,আজ তাদের ভুলে গেলেন ? গোপাল বললো।
ও , তাই তো । তা তোমাদের কি দরকার বলো?
ওদের কথাটা আমি বলছি রাজা মশাই। এরা নিয়মিত বাজার কর , জল কর দিয়ে আসছে। তবু মন্ত্রী মশাই বোঝা পিছু এক টাকা সবজি ব্যাপারীদের কাছ থেকে, পাইকারদের কাছ থেকেও এক টাকা এবং মাঝির কাছ থেকে আট আনা আদায় করে। এটা অনেক দিন থেকে লোক মুখে শুনছিলাম । নিজেও একদিন গিয়ে দেখে এলাম। তাই কথা উঠলো যখন আপনাকে নিয়ে গেলাম। ওই তো বাজার সর্দার এসেছে, ওকেই জিজ্ঞেস করুন।
বাজার সর্দার , গোপাল যা বলল তা সত্যি?
হ্যাঁ মহারাজ, প্রতিদিন সকালে পটা ঘটা গিয়ে লোক বসিয়ে আসে , বিকেলে গিয়ে টাকা নিয়ে আসে। মন্ত্রী মশাই নিজে গিয়ে এই ব্যবস্থা করে এসেছেন। বাজার সর্দার হাত জোড় করে বললো ।
মন্ত্রী! ওই জন্যে তুমি দূরে দাঁড়িয়েছিলে ? দাঁড়াও তোমার হচ্ছে।
না মানে , এই — এবারের মতো ক্ষমা করে দিন রাজা মশাই। আর কক্ষনো হবে না।
হবে না , তোমার বিচার পরে হচ্ছে। তারপর ব্যাপারীদের দিকে চেয়ে বললেন — যাও তোমরা,যে যা করছিলে,তাই করো গিয়ে।
না রাজা মশাই, এবার থেকে প্রতি মাসে বাজার সর্দার আর ঘাটবাবুকে রাজদরবারে এসে রাজকোষে কর জমা দিয়ে যেতে হবে। তার জন্য প্রত্যেককে পথ খরচও দেওয়া হবে ।
হ্যাঁ হ্যাঁ,তাই হবে। তোমরা এখন এসো।
ব্যাপারীরা চলে গেলে রাজা মশাই গোপালকে জিজ্ঞেস করলেন — আচ্ছা গোপাল বাজার সর্দার আর ঘাটবাবুকে রাজদরবারে আসার কথা কেন বললে , খুলে বলো দেখি।
রাজা মশাই নিজের কানে তো শুনলেন মন্ত্রী মশাইয়ের কীর্তি। আরো কোথায় কি ,কার করা আছে। কথায় আছে না, রাজকর্মচারীদের অর্থক্ষেত আর শুয়োরকে কচুক্ষেত দেখাতে নেই ,অনর্থ হবে।
ঠিক বলেছো। আজ থেকে মন্ত্রীর বেতন গোপালকে দেওয়া হবে, আর গোপালের বেতন পাবে মন্ত্রী।
রাজা মশাই, একেবারে মরে যাবো। আর এ ভুল কক্ষনো হবে না। এই কান মুলছি ,নাক মুলছি ।
না না , যতই নাক কান মলো। আমার কথার নড়চড় হবে না ।
রাজা মশাই, আমার কি হবে ?
তোমার আবার কি হবে! তোমাকে গুপ্তচর দপ্তরের দায়িত্ব দিলাম। তার জন্যও বেতন পাবে ।
সেটা তো মহারাজের অসীম কৃপা। কিন্তু ওই চেনা চিনির ব্যাপারটা। আমি কি তবে —
রাজা হেসে বললেন — না না তোমাকে কে যেতে দিচ্ছে! তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো । তোমাকে আমি, আমার এই বহু মূল্যের গজমতির হার উপহার দিলাম। বলো সবাই — জয় গোপালের জয়।
সবাই বললো – জয় গোপালের জয়।
না না , সবাই বলুন – জয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জয় ।
সবাই একসঙ্গে বলল — জয় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জয়।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *