রম্য রচনায় অমৃতা ভট্টাচার্য

চোদ্দ শাকের গপ্পো। চোদ্দ প্রদীপেরও

সক্কাল সক্কাল মাঠের ধারে দাঁড়ালে টের পাই ধানের গোছা কেমন শিশিরে জবুথবু হয়ে নুয়ে পড়েছে। শিশিরে গোড়ালি ডুবিয়ে মাঠে মাঠে মানুষ দেখে নিচ্ছে ধানের আগা। আর কদিনেই তো ধান কাটা হবে, তখন সে আরেক রকম। সেই বিরান মাঠের তুলনায় এই শিশিরে জবুথবু মাঠখানা দেখতেই বরং বেশ লাগে। ঠাণ্ডা হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দেয় এমন সক্কালে। গাঁয়ে গঞ্জের মানুষ জানেন এমন কার্তিকের ভোরে যমের আটখানা দরজা খুলে যায় সটান। মানুষের জন্য সে তখন দরজার পাশটিতে অপেক্ষা করে বসে থাকে সারা বেলা। জ্বর, কাশি আর হাঁপানির টান উঠলে এ সময়ে ভোগান্তির শেষ নেই। দীপাবলির উৎসবে এ সব টের পাওয়া যায় না বটে কিন্তু মানুষের ঘরে ঘরে এ সময়ে জ্বর ব্যাধির হৈহৈরৈরৈ। ভূত চতুর্দশীর দিনে এই যে মানুষের আলো জ্বলানোর এত আয়োজন সে তো এই মৃত্যু ভয়, রোগ আর মারীকেই কাটিয়ে তুলতে! চোদ্দশাকের বিধান দিয়েছিলেন যাঁরা তারা কি জানতেন, এমন করে টুনি আলো আর ফানুসে রাতের অন্ধকার ফিকে করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে মানুষ! জানতেন না। জানা সম্ভবও ছিল না। তবে তাঁরা জানতেন , এই হলো শাকান্ন ভোজীর প্ররম্ভিক কাল। আজ থেকে শাকমহোৎসবের শুরুও বলা যেতে পারে। ঋতু উদযাপনের কী চমৎকার আয়োজন! বর্ষার শেষে মাঠে ঘাটের জল থিতিয়ে গেলে গাছেদের জেগে ওঠার মরশুমে মানুষের পাতে পাতে শাক জুটে যায় ভরপুর। অন্তত গাঁয়ের মানুষ এমন সময়ে শাকে ভাতে পেট ভরিয়ে নিতে জানতেন। তাঁরা এও জানতেন, এমন শাকের মুঠি ভরে যমের অষ্ট প্রহরীর সঙ্গে লড়াইও চালানো যায় ভরপুর। মা মাসি দিদিমাদের মুখে মুখে সেসব শাকের ফর্দ শোনা যেত হামেশাই। এখনও যায় হয়তো বা। বাজারে বাজারে এখন কুচো শাকের রমরমা। সে শাকে নিয়ম রক্ষার তাগিদ আছে বটে, নেই কোনো নরম কাঁথার ছোঁয়া। মায়ের আঁচলের ওমে মানুষ আশ্রয় খোঁজে বলেই না এত সব মাতৃ পূজার আয়োজন! ইস্‌ মানুষ যদি জানতো , এমন মাঠে ঘাটে ওই দূর জাহ্নবীর প্রান্তে তাঁর আঁচলখানা মেলে দিয়ে যে মাতৃমূর্তি বসে আছেন কার্তিকের রৌদ্রে, তাঁর আঁচল ভরে আছে শস্য আর শাকের গন্ধে। সেসব শাকের গল্পে কত শত পূর্বদেশীয় শাকাহারী আর্যদের জীবন ইতিহাস মিশে আছে। সেসব না জানলেও অবশ্য ক্ষতি নেই কোনো। মানুষের জানা না জানায় কারই বা যায় আসে কবে! তবুও মানুষী ইচ্ছে হয় একেকদিন। সেদিন মুখ ফিরিয়ে বসলে পরে টের পাই খাবারের গল্পেও কত সব উপকথা আর কিস্‌সার ভিড়ে মিশে আছে এই আদুরে জীবনেরই গল্প। সে গল্পে শাক আছে, লতা পাতা ফুল আছে। থাকবে নাই বা কেন! মাটির পৃথিবী তো কেবল মানুষের নয়!
কার্তিকের মাঠে মাঠে যে মা মাসিরা শাক তুলতেন তাঁরা জানতেন সেই চোদ্দ প্রদীপবৎ শাকদের নাম। তাঁরা মুখে মুখে বলতেনও তো! ওল ,কেঁউ, বেতো, কালকাসুন্দে, সর্ষে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, গুলঞ্চ, পটল, শেলূকা, হিঞ্চে, ঘেঁটু, শুষনি। তাঁরা এও জানতেন শাকেদের জীবনও কত সব গল্পে পরিপূর্ণ। তাই না তাঁরা পুকুরের মাটি তুলে প্রদীপ গড়তেন ভারী যত্নে! সে প্রদীপ শুকোলে সলতে পাকানোর পালা। প্রেতলোক থেকে দূরে থাকার কত না প্রকৌশল বলুন! ভূত( অতীত) হতে কেই বা চায়! তাই তো এমন করে জীবনের কাছে সে ফিরে আসে জীবনের দাবি নিয়ে। সুস্থতার দাবী নিয়ে। এই মারী আর মহামারীর মিছিল পেরিয়ে আসুন না আমরাও আলের পাশটিতে বসে খানিক দেখি! মাঠে মাঠে ওই যে সেজে উঠেছেন তিনি। মাতৃ পূজার প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকাতে হয় বৈকি! এই মাঠ ঘাট আর প্রান্তরের কুয়াশায় মিশে আছেন যে দেবী, তাঁর গল্প শুনবেন? শোনাবো বৈকি। তার আগে খানিক সলতে পাকালাম আর কী। শাক পাতা আর কত শত বীজ আর কন্দের শিখা জ্বলুক তাহলে! জ্বলুক জ্বলুক।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।