কবিতায় পদ্মা-যমুনা তে অমল বিশ্বাস (গুচ্ছ কবিতা)

১| বারুদ সুন্দরী

বারুদের ঝাঁজে
আমি এক সুন্দরীর চুলের গন্ধ পাই,
যেখানে যুদ্ধের মাঠ নেই।
অথচ স্নায়ুযুদ্ধ হয়
বিছিয়ে রাখা একটি চাদরের গন্ধে,
যেখানে দেশলাই হাতে
বারুদ ঝরাতে থাকে তিনটে আঙুল।
যখন ঘুমিয়ে থাকি
শ্বাসপ্রশ্বাসে ঝরাবারুদ জীবন্ত হয়,
আঙুলের স্পর্শ পাই
নিবিড় অন্ধকারে ঘাসের মৃত্তিকায়।
সুন্দরীর গন্ধে
আমি এক দীর্ঘ-অসুখের সুখ পাই,
যেখানে বারুদ কষ্টের রক্ত খায়।

২| কাকপুষ্ট খাদকের চোখ

একটি মৃতদেহ খোলা বারান্দায় রাখতে
সভ্য-অসভ্য অনেকে এগিয়ে এলো
কেউ সহমর্মিতাবোধে, কেউ কৌতুহলে।
কেউ কাঁদছে, কেউ তার বয়স গুনছে,
কেউ সালোয়ার-কামিজে
তখনও কামনার বীজ পুঁতছে অবলীলায়,
চোখের লালায় চলছে ধর্ষণ কার্যক্রম
মৃতার বিভিন্ন স্থির অঙ্গ-উপাঙ্গে।
একটি বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে
মৃতার মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে
ঢেকে দিলো এতোদিনকার রক্ষিত বুক,
অন্তত কিছুটা রক্ষা পাক
যতক্ষণ না সে সাদাকাপড়ে ঢাকতে পারে
সামাজিক কাকপুষ্ট খাদকের চোখ।
ভিক্ষের টাকায় কেনা সাদাকাপড় হাতে
বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটি ফিরে এসে দেখে
সালোয়ার-কামিজ আরও ছিঁড়ে গেছে।

৩| নদী ও নারী

একটি নদী ছুঁয়ে এলাম।
তোমাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে ভাসিয়ে দিলাম
জলের শরীরে,
সেও এক শৈল্পিক সামুদ্রিক রমণে
পরিপূর্ণ নারী।
পিঠ বেয়ে ঝরা চুলে শান্ত-কাজলী
কখনো খরস্রোতে ভাসাচ্ছে আঁচল।
উত্তলবুকে আধছোঁয়া জল
ঝর্ণার সঙ্গমে খুঁজছে সামুদ্রিক সুখ।
তীরভাঙা মাটির গন্ধে সুরামুগ্ধ পৌরুষ
নতজানু তার শরীরে।
বুকের সরুপথে নৌকার চলা,
কখনো বিক্ষুব্ধ বাতাসে ছিঁড়ে ফেলছে
মাছরাঙা পালের পালক।
ছিটকে পড়া মাঝির দূর্দশায়
সাদা হাঁস হাসছে তরঙ্গের দোলায়,
মধ্যনদীর ঘূর্ণিতে ঘোরাচ্ছে তাকে
ডুবে যাচ্ছে সে।
আহা, কি অদ্ভুত
জর্জরিত শক্তিমান পুরুষ-প্রণয়!
যখন বিবস্ত্র জলে জোয়ারের পূর্ণিমা
খঞ্জনি তুলছে মাদল,
ঢেউয়ে-ঢেউয়ে গিরিনিতম্ব জুড়ে
জলের উঠানামা।
ভাসাচুলে চুপচাপ-ফিসফাস
শব্দের মায়া,
জোয়ারের শেষবেলা
খেলাশেষে নেমে আসে ভাটায় শরীর;
তারপর ঘুম।
ভোরের লাজুক জল
নদী ছেড়ে দুইতীরে যেটুক রেখেছে দাগ
সোনামুখি সূর্যের প্রথম প্রভাতে,
স্নানশেষে সেইটুক প্রেম।
রাত্রির জোনাকির গুড়োরঙ
দুইগালে রেখে গেছে প্রণয়-প্রপাত,
তাও জানে সমুদ্রের জল।
যতো উচ্ছ্বল নদী
তার চেয়ে বেশি উচ্ছ্বল নারীর ভুমিকা,
ঝর্ণার জলে নুড়ি পায় প্রেমের আশ্বাস
নদীর আদর।
একটি নদী ছুঁয়ে এলাম।
আর স্মৃতিছুঁয়ে কষ্টের ছাই ভাসালাম
স্নিগ্ধ শরীরে,
ঠিক তক্ষুনি খরস্রোতায় অঙ্কিত হয়
এক পরিপূর্ণ নারী।

৪| সম্পর্ক

বালি সরাতে গিয়ে দেখি
মাটি নেই,
ওরা একসাথে ছিলো
যেমন পাতি-শামুকের গায়ে শ্যাওলা থাকে।
শ্যাওলা সরাতে গিয়ে
কখন যে শামুকের খোলক ভেঙেছি
ওর যুবতী জীবন ধ্বংস করেছি, মনে নেই।
এও মনে নেই
মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসে
তাঁর বুকের দুধ থেকে জল আলাদা করেছি।
তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে দেখি
গায়ে কাপড় নেই,
কখনও ভাবিনি আকাশকে নারী ভাবতে
একচিলতে মেঘের শাড়ি দরকার।

৫| জীবনের পাণ্ডুলিপি

সমাধিক্ষেত্রে যাবো
মৃত পরিচিতদের ভীড়ে যাবো
ওরাও তো ছিলো এই তীরে বহুদিন একসাথে।
এক জোছনায়, এক উঠোনে
অনেক গল্প ছিলো, সুখ ছিলো, কান্না ছিলো,
ঠুনকো বচসা ছিলো,
তারপরেও তারা পরিচিত মানুষ ছিলো
ভালোমন্দ মেশানো মানুষ,
যেহেতু একদিন যেতে হবে
যাই, আপাততঃ এক্ষুনি ঘুরে আসি।
সন্ধ্যায় মোম জ্বেলে
প্রতিটি সমাধি প্রদক্ষিণ শেষে
ফল্গুর জল দিয়ে ধুয়ে দেবো ধুলোবালি সব
সুগন্ধী ছড়াবো সেখানে,
সারারাত ঐখানে
অর্থাৎ লাশ রাখা বুড়োবটের তলায়
তার সহযোগী হয়ে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে
কাটাবো ক’দিন।
দেখি কারা-কারা আসে,
কোন অজুহাতে বৃদ্ধ কিংবা অকাল ভাসন
কেউ কাঁদে নাকি, শোকে বুক ভাঙ্গে নাকি
অথবা নীরবে জল ফেলে,
নাকি যত্নের চোখে সমাধি দেখতে থাকে
যাই দেখে আসি।
যদি ঐখানে মারা যাই
পঁচন ধরার ভয়ে, না-হোক সৎ কাজ
অন্ততঃ মাটির ভেতরে বাস নিশ্চিত হবে,
আর যদি ফিরে আসি ফের
লোকালয়ে দেখা হবে তোমাদের সাথে
জীবনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে।
ভালো থেকো প্রিয়তম মানুষ,
মনের ঝরানো সব ছড়ানো কষ্ট রেখে যাই
তুলে নিও অগোছালো বুকে,
যদি পারো অন্তত ভুল করে ভালোবাসা দিও
যেমন ভালোবাসতে
যখন জীবিত ছিলাম স্বার্থের বুকে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।