|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় আবীর ভট্টাচার্য্য

ভয় হতে তবে অভয়মাঝে…


সারাদিন টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না বেরিলী শহরের বাসিন্দারা।সারা দেশ আজ তোলপাড় একটি খবরে,গুরু তমোনাশ গ্রেপ্তার হয়েছেন অসংখ্য নাবালিকার যৌনহেনস্থা ও ধর্ষনের অভিযোগে, জরুরী ভিত্তিতে বিচার হবে, তদন্তের দায়িত্বে তরুনী আই.পি.এস.অফিসার কমলিকা চতুর্বেদী,যে কিনা বহুদিন ধরে নিখোঁজ ছিলো, এবং সে এই শহরেরই মেয়ে।
অফিসে বসে মেয়েটিরও চোখ ছিলো হয়তো টিভির পর্দায়,সারা শহর জুড়ে আলোর উৎসব কিন্তু মন চলে গিয়েছিল অনেক,অনেক দূরে এক অন্ধকার অধ্যায়ে,আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগের দিনগুলিতে। সেদিনও ছিলো এমনি এক হৈমন্তী অমাবস্যার রাত,তার জীবনে ঘটে গিয়েছিলো এক চরম বিপর্যয়।
সেদিনের কমলিকা ছিলো বেরিলি শহরের এক উচ্চবিত্ত,ধর্মভীরু ব্রাহ্মণবাড়ির মেয়ে। ছোট থেকেই মেধাবী মেয়েটি স্কুলের পড়া শেষ করে স্হানীয় কলেজে ভর্তি হয় বাবা-জেঠু-ঠাকুরদাদার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও।যে বাড়ির মেয়েরা পনেরো পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়, সেখানে সতের বছরে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে কলেজ যাওয়ার স্বপ্ন দেখা হয়তো খানিকটা ধৃষ্টতার নামান্তর মনে করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সবকিছুই হয়েছিল মেয়েটির নানীমার সমর্থনে।প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী সেই নারী একমাথা ঘোমটার আড়ালে দাঁড়িয়ে ঋজুকন্ঠে জানিয়েছিলেন,
-কমলিবেটি পড়বে,ওর নানী,মা বা দিদিদের মতো শুধুমাত্র শ্বশুরবাড়ির বৌ হবেনা।
তাই অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ঠাকুরদাদা। কিন্তু গোল বাঁধলো অন্য জায়গায়। কলেজের প্রথম বছরেই ওখানকার এক তরুণ অধ্যাপকের সঙ্গে গড়ে উঠলো তার এক মধুর সখ্য,ক্লাশ চলাকালীন তাঁর সুপুরুষ চেহারা,সুললিত কন্ঠধ্বনি কমলিকাকে যেন কোন অন্য জগতে নিয়ে চলে যেত।অন্যদিকে তরুনী ছাত্রীটির আয়তচোখের মুগ্ধ-মগ্নতায় তিনিও ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছিলেন,টের পেতে শুরু করেছিলেন অধ্যাপক।তবে এসব কথা তো আর চাপা থাকে না, বরং যা ঘটে,রটে তার দ্বিগুণ। এবং এক্ষেত্রে অধ্যাপক ছিলেন মুসলিম।
ফলস্বরূপ, নানা ধমক,চমক,অত্যাচার,পীড়ন, এবং অবশ্যম্ভাবী পড়াবন্ধ করে ঘরে আটকে রাখা। কিন্তু তবুও যখন কোনভাবেই মেয়েকে বশ করা গেল না,তখন পরিবার বাধ্য হয়েছিলো গুরুদেবের স্মরণ নিতে,দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের পরামর্শে একদিন মেয়েটিকে মা-বাবার সঙ্গে যেতে হলো ঐ গুরুর আশ্রমে, এমনই এক কালীপূজার রাতে। নানীর কথা এবার আর গ্রাহ্য করা হোল না। শুধু কমলিকাকে গাড়িতে ওঠার সময়ে নানী বলেছিলেন,
-বাঁচতে হবে, বাঁচতেই হবে বেটি,মরবি না।
ও লুকিয়ে ওর এক বন্ধুর ফোননং দিয়ে এসেছিলো নানীকে,যদি ওর কিছু হয়,যেন খবরটা কলেজ পর্যন্ত যায়…..
যাহোক, এখনও মনে পড়ে,বেশ কয়েকঘন্টা গ্রামের রাস্তায় যাওয়ার পরে সন্ধ্যার মুখে পৌঁছে ছিলো গুরুজীর আশ্রমে,নদীতীরে এক সুন্দর আশ্রম। সন্ধ্যারতির আয়োজন চলছে,ধুপ-ধুনো, প্রদীপের আলো,শঙ্খধ্বনি…..সব মিলিয়ে কি অপরূপ পরিবেশ।বেশ কয়েকদিনের মানসিক ঝড়ঝাপটার পরে শান্ত লাগছিলো বেশ।আরতির পরে গুরুজীর দর্শন,আগে থেকেই অ্যপয়েন্টমেন্ট করা ছিলো। মা-বাবার সাথে সেও প্রণাম করেছিলো, মা-বাবা অতঃপর বললেন সমস্যার কথা,আত্মজাকে নিয়ে তাঁদের লজ্জার কথা…. পবিত্র হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যার মুসলিম প্রণয় এবং আর যা যা কিছু….মন দিয়ে শুনলেন,মা, বাবা এবং ওর হাত দেখলেন, শেষে গম্ভীর গলায় বিধান দিলেন,
-আজ রাতেই এক যজ্ঞ করবেন, এখনি না গ্রহদোষ ছাড়ালে নয়, অনেক, অনেক দেরি হয়ে গেছে….
মা-বাবাকে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো ,বলা হোল কাল সকালে সব ভালো হয়ে যাবে, ওনারা মেয়ে নিয়ে ফিরে যেতে পারবেন,অন্যত্র বিয়ে দিতেও কোন সমস্যা হবে না। মা-বাবা কৃতার্থ হয়ে গেলেন,দ্রুত সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, অন্য সন্ন্যাসিনীরা ওকে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে পট্টবস্ত্র পরিয়ে পুজায় বসালো,কি যেন একটা খাওয়ালো……ওর যেন কেমন ঘোর লাগছিলো,কেমন যেন নেশা নেশা, ধোঁয়া ধোঁয়া… অনেক রাতে তখন ঘোর ভাঙলো,ও নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো সম্পুর্ণ নগ্ন অবস্থায় গুরুজীর বিছানায়, সারাদেহে ক্ষত,দাহ, যৌনাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রনা…ওর বুঝতে বাকি রইলো না,কি হয়ে গেছে…..যেমন করে হোক,পোষাক জড়িয়ে বাইরে এলো, চারিদিক নিস্তব্ধ, সবাই এখনও ঘুমচ্ছে,আস্তে আস্তে ভোর হচ্ছে, এগিয়ে গেল নদীর দিকে, অশুচি এই দেহ,বিড়ম্বিত এ জীবন রেখে লাভ কি!
এক পা এক পা করে জলের দিকে এগোচ্ছে, একটা বাচ্চা এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো,

দিদি, দিদি!
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো, সাত-আট বছরের একটা দুধের বাচ্চা,ওর দিকে তাকিয়ে বলছে, – আমার দিদিকে কদিন আগে এই আশ্রমে এনেছিলো ওরা, দিদি পরদিন সকালে জলে ডুবে মরেছে,মা কেঁদে কেঁদে সারা,আর আমি এখানেই বসে আছি, তুইও কি মরবি, দিদি? মরিস না রে….
ওর মধ্যে থেকে কে যেন জেগে উঠলো নানীর মতো,নানীও বলেছিলো না মরার কথা,লড়ার কথা…. কিন্তু ও তো আর ঐ ঘরে ফিরবে না,ফিরতে পারবেই না। তবে যাবে কোথায়? মুহুর্তে সিদ্ধান্ত বদলে নিলো,ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলো,
-তোর বাড়ি কোথায়?আমায় নিয়ে যাবি? আমার তো বাড়ি নেই!
-আমার বাড়িতে চল
সেই থেকে, দীর্ঘ এতগুলি বছর কমলিকা নতুন মা আর ভাইয়ের সাথে কাটিয়েছেন, সেই দুঃসময়ে প্রকৃত মায়ের মত সেই দরদী মহিলা পরমযত্নে ওর শরীর মনের ক্ষত ভুলিয়েছেন,চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও কায়ক্লেশে খাবারটুকু এনে খাইয়েছেন, এতটুকু অযত্ন করেননি,বুঝতেই দেননি ও ওনার নিজের মেয়ে নয়।
কয়েকদিন যাওয়ার পরে,নতুন মায়ের পরামর্শেই সেই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলো,শুনেছিলো,স্যরকে চাকরী ছাড়তে বাধ্য করেছিল তার পরিবার,ওনার নামে তাদের বাড়ির মেয়েকে অপহরণের দোষ দিয়ে স্হানীয় থানায় অভিযোগ দায়েরও করা হয়েছিল।উনি সব ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই এসেছিলো স্যরের ফোন। সেই বন্ধুর কাছে খবর পেয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। মহৎ-হৃদয় মানুষটির সাহায্যে আবার ভাইবোনে পড়া শুরু করেছিলো, ক্রমে পড়াশেষে ইউ.পি.এস.সি.কোচিং, পরীক্ষা, সাফল্য, ট্রেনিং এবং জয়েনিং…..কিন্তু নতুনমা বা স্যরের হাজার জোরাজুরি সত্ত্বেও নিজের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, এবং বিয়েও করেনি…. কিভাবে ঐ দেবতুল্য মানুষটিকে নিবেদন করবে, এই অসুর-ছোঁয়া অশুচি দেহ! মনেমনে যত আধুনিক হোক না কেন, জন্মসুত্রে পাওয়া সংস্কার অস্বীকার করা যায় কি!
ভাইও আজ মানুষ হওয়ার পথে,ওরও লক্ষ্য দিদি, নিজের মেধা ও অদম্য জেদ সঙ্গী করে হতে চায় আই.পি.এস.অফিসার….আরও অনেক দিদি বোন যে ওর অপেক্ষায়…..যা হোক,আজ সে ভীষন খুশী, তার কর্মজীবনের প্রথম সাফল্য গুরুজীর ভন্ডমুখোশ ছিঁড়ে ফেলা….. ভীষন ধন্য মনে হচ্ছে আজ…,নারী যখন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে,দূরাত্মা-দমন অসাধ্য হয়না।
তবু এই শুভ মুহূর্তেও মেয়েটির মনে পড়ছে নানীর কথা, নতুন মায়ের কথা, এবং অবশ্যই স্যরের কথা…..যাঁরা সবাই মিলে তৈরি করেছে তাঁকে….এক অনন্য নারীকে; ‘পরিত্রানায় সাধুনাং…’

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।