• Uncategorized
  • 0

নিবন্ধে নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত

অপহার (১৭৫৭-১৭৭২)- ভারতীয় অর্থনৈতিক দুর্ভোগ।

ডিম ফেটে গেলে ভেতরের অংশ যেমন বিন বিন করে বেড়িয়ে আসে তাকে ঠেকানো সম্ভব হয় না। যেমন আমাদের সরকারী কল থেকে মহার্ঘ ক্রমাগত জল বার হয়ে যায় ফেরানো যায় না। সেই রকম ভারতবর্ষ (নাকি বাংলা বলব) থেকে প্রভুত পরিমাণ সম্পদ, ইংল্যান্ডে চলে গেছে। (আমার আলোচনার সময়কাল ১৭৫৭-১৭৭২  )সেখান থেকে কিছু ফেরৎ আসে নি। এই “প্রতিদান হীন চালান” কে সংক্ষেপে –বলা হয় ‘অপহার’। ইংরেজি তে এই শব্দ টা drain বলে ব্যাবহার হয়। অম্লান দত্ত   তাঁর “ শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের আর্থিক বিকাশ” গ্রন্থে এই ‘drain’ এর ভয়াবহতা বুঝেই সম্ভবত ‘অপহার’ শব্দটি গ্রহণ করেছিলেন।বানিজ্য প্রতিষ্ঠান যদি শাসনে আসে একটি সুজলা সুফলা দেশের সাধারণ মানুষের জীবন কতটা ভয়াবহ হতে পারে- সেটা এই সময়ের পরিস্থিতি দেখে কিছু আন্দাজ করা যেতে পারে।একটি বানিজ্য শক্তি ধীরে ধীরে কিন্তু তীব্র ভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠলো।১৬৯০ সালে কলকাতার যখন পত্তন হচ্ছে, তখন ও গুটিয়ে আসা, টুকরো হয়ে যাওয়া মুঘল শাসকের গ্ল্যামার মজুত ভারতবর্ষে। কেক কাটার সময়, যেমন আলতো করে কাটা শুরু হয়। তেমনি আলতো করে ব্রিটিশ বনিকের লকলকে জিহবা বাংলা তথা ভারতের সম্পদের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। সে জিহবার ধার এতো, যা আমাদের এখনো ভোগাচ্ছে।
বাংলার কলকাতা, করমন্ডল উপকূলে মাদ্রাজ আর আর আরব সাগরের  তীরে বোম্বাই কে কেন্দ্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন জিনিস (রেশম বস্ত্র) ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। (এই ব্যাপার গুলো অবাই জানে। কিন্তু তবু লিখতে হচ্ছে)এই যে কেনাকাটা তাকে বলা হত ‘investment’। কি অসাধারণ শব্দবন্ধ এই ‘investment’। এই ‘investment’ তাদের জন্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যে আবহাওয়া তৈরি করছিল।কোম্পানি চেষ্টা করতে থাকে বিনাশুল্কে কি ভাবে ব্যাবসা করা যায়। বছরে তিন হাজার টাকা এককালীন অর্থ দিয়ে সারা বছর  বিনাশুল্কে  ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে। “The Magnacarta of the East India company”পাওয়া গেল ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে। এই ম্যাগনাকার্টা পাওয়া নিয়ে একটা গল্প আছে। ইংরাজ ডাক্তার ডঃ উইলিয়াম হ্যামিলটন নিজের জাতির প্রতি ভালবাসার গল্প। তিনি ফারুকশিয়ারের দীর্ঘ দিনের ব্যাধি সারিয়ে তোলেন।যার পরিবর্তে ‘বিনাশুল্কে’ বানিজ্যের অধিকারটি তিনি সম্রাটের কাছ থেকে চেয়ে নেন। মুঘল শাসকের গ্ল্যামার কথা তখন ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অক্ষত যেমন, ফারুকশিয়ারের বিরাট নাম টা দেখে আন্দাজ করা যায়, আবুল মুজাফ্‌ফর মইনুদ্দিন মহম্মদ শা ফারুকশিয়ার আলিম আকবর সানিওয়ালা শান পাদশাহ -ই-বাহর-উ-বার । হ্যামিলটনের মৃত্যু হয়েছিল কলকাতায়। তাঁর কবর আছে কলকাতার সেন্ট জন্স চার্চে।
বণিক জাতি একাধারে বুদ্ধিমান, নিষ্ঠুর, অন্যদিকে আর্থিক শক্তিতে বলিয়ান। ক্রমাগত তার বাণিজ্যিক ক্ষমতা বৃদ্ধি আর শাসন ক্ষমতা বৃদ্ধি বাংলার আলিবর্দি খাঁ কে যথেষ্ট চিন্তায় ফেললেও সমস্যাটির সমাধান করার সাহস রাখেননি। নাটক, কবিতা, গল্পে বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হবার যে ইতিহাস টা প্রায় সকল শিক্ষিত লোকের জানা। পলাশীর যুদ্ধ শেষ। ক্লাইভ বাংলার উন্মুত কোষাগার হাতের মুঠোয় পেয়ে কিন্তু একটু আশাহত হন।তাঁর ধারনা ছিল মুর্শিদাবাদের কোষাগারে চল্লিশ লক্ষ স্টারলিং অর্থ আছে যার অর্থমূল্য ভারতীয় মুদ্রায় 4,03,90,11,295.88 টাকা। কিন্তু ছিল দেড় কোটি টাকা। ক্লাইভ মীরজাফর কে মসনদে বসিয়ে প্রায় দু লক্ষ পাউন্ডের  নজরানা আদায় করেন।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতায় আসার আগে সাধারন উঁচুপদের কর্মচারীরা সাধারন মানুষ যেমন কৃষক,ছোট দোকানি, তাঁতি,দালাল প্রভৃতির কাছ থেকে নজরানা আদায় করত। কোম্পানির শাসন শুরু হলে তাদের সাধারন কর্মচারীরাও সেটা আদায় করতে থাকে।এই অবাধ লুণ্ঠন নিয়ে , Garrat and Thompson এর লেখা “The rise and fulfilment of the British Empire in India.” বই তে  একটা শব্দবন্ধ  আছে  “Shaking of the pagoda tree”। প্যগোডা  দক্ষিন ভারতীয় স্বর্ণমুদ্রা।মানে একটি স্বর্ণমুদ্রার গাছ ঝাঁকিয়ে সম্পদ আহরণ করছিল কোম্পানি।
কোম্পানিতে কাজ করা সাধারন কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদের পরিমাণ সাংঘাতিক রকম বেড়ে যায়। যেমন বারওয়েল বলে একজন, উপঢৌকন আর নানা পথে উপার্জন করে সে প্রায় আশি লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল।তাঁর লেখা চিঠি থেকে পাওয়া যায়। দুভাবে এই টাকা সে সময় পাঠানো হত। সে সময় ফরাসি ও ওলন্দাজ কোম্পানি গুলি খুব আগ্রহের সাথে সেই টাকা ইংল্যান্ডে পাঠানোর ব্যাবস্থা করত।ভেবে দেখলে দেখা যাবে… ইয়োরোপীয় দের মধ্যে যতই বানিজ্যিক প্রতিযোগিতা থাকুক সম্পদ আহরণের (অপহারের) সময়,একে অপরের পাশে থাকত। আর অন্য পদ্ধতি টি জানলে বেশ রাগ হবে। সেটি হল, কোম্পানির বেশ কিছু বড় মাপের কর্মচারী আর সাধারণ রাও,তাদের অর্থ গুলি দিয়ে দামি রত্ন, বিশেষ করে হীরে কিনে নিয়ে সেগুলি দেশে পাঠাতেন। মুসলমান শাসক এবং বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ীদের তৈরি করা রত্নসম্পদ তারা এই সুযোগে নিজের দেশে পাঠাতেন। ইংরেজ সংস্কৃতির উজ্বল ঝলমলানো আলো অনেকটায় আমাদের দেশের কেড়ে নিয়ে যাওয়া সম্পদ দ্বারা তৈরি।
অধ্যাপক সমর কুমার মল্লিক – “আধুনিক ভারতের দেড়শো বছর” এ লিখছেন, “১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে এইভাবে কত টাকা ভারত থেকে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল তার সঠিক হিসাব দেওয়া খুব দুরহ। ১৭৭৩ সালে পার্লামেন্টে পেশ করা একটা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, যে পরিমাণ ছিল ১৩,০৬৬,৭৬১ পাউন্ড। কোম্পানির খরচের পরিমাণ ছিল ৯,০২৭,৬০৯ পাউন্ড। অর্থাৎ মোট ৪,০৩৯,১৫২ পাউন্ড ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়ে ছিল। এই থেকে বোঝা যাচ্ছে কোম্পানির মোট রাজস্বের এক তৃতীয়াংশ ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়েছিল”। এ ভাবে কোন দিন দেশ থেকে এই ভাবে সম্পদ অন্য কোথাও চলে যেত না।মোঘল শাসন কালে বাংলাদেশে খাদ্য দ্রব্য সস্তা ছিল।১৭২৯ সালে টাকায় সরুচাল একমন দশ সের পাওয়া যেত।(১ সের = ০.৯৩৩১০ কেজি ,৪০ সের=১ মণ)।    আন্তর্জাতিক স্তরের উন্নত রেশম শিল্প, চিনি, পাট, নীল গন্ধক, কাঁসার বাসন, লোহার যন্ত্র প্রভৃতি নিয়ে বাংলা একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর মোঘল শাসন বিপুল পরিমাণে অর্থ রাজস্ব হিসাবে পেতেন।মুর্শিদকুলি খাঁ প্রায় এক কোটি  টাকা রাজস্ব দিল্লীতে পাঠাতেন। তাঁর আগে শায়েস্তা খাঁ বাইশ বছর ব্যক্তিগত ভাবে প্রায় ৩৮ কোটি ব্যক্তিগত ভাবে লাভ করেন। সহজলভ্য ঐশ্বর্য, আর আরাম দায়ক জীবন সেই জন্যে ধনীদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল বাংলা। শাসক আর ধনীবণিকদের জীবন আরামদায়ক হলেও  সাধারণ মানুষের জীবন ছিল খুব কষ্টকর। খাজনা না দিতে পারলে প্রজাদের স্ত্রী কন্যা দের নিলাম করা হত। মঙ্গল কাব্যে পাওয়া যায়-
                             “ লাঙ্গল বেচায় জোয়াল বেচায়,
                                  আরো বেচায় ফাল।
                                 খাজনার তাপেতে বেচায়
                                        দুধের ছাওয়াল।”
সে সময় সম্পদ যদি কেবল মাত্র শাসকের কোষাগারে না থেকে সাধারণ মানুষের জীবনের উৎকর্ষতার জন্যে ব্যয় হত। শাসক বড়লোক না হয়ে দেশ ‘বড়লোক’ হত,এতো টা ক্ষতি কোম্পানি করবার ক্ষমতা রাখত না। সাধারণ জীবনে অতি প্রয়োজনীয় তৈসজ পত্র পর্যন্ত ছিল না। ফুল্লরা দেবী চণ্ডী কে বলছেন, “ হের দুঃখ কর অবধান /আমানি খাবার গর্ত দ্যাখো বিদ্যমান”। মুঘল যুগের রচনা থেকে জানা যায় তখন জিনিস পত্রের দাম কম ছিল। কিন্তু অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু “মুদ্রা”র সরবরাহ ছিল কম তাই দাম হয়ত বাড়ত না।কিন্তু সাধারণ উপভোগ্য বাজারের অবস্থা ছিল না।
কোম্পানির শাসনের আগেই মুঘল অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বণিকদের উপস্থিতি ছিল। সে সময়ের ভারতীয় ভূখণ্ডের বণিকদের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যায় তিন ধরণের ভারতীয় বণিক।
–       স্থানীয় ব্যবসায়ী । যারা এলাকায় ছোট দোকান বা ফেরিওয়ালা।এদের ছোট এলাকার মধ্যে ব্যবসার প্রসার ছিল।
–       অন্তরবাণিজ্যে নিযুক্ত বণিক। এরা মুঘল শাসিত ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে জিনিস পত্র নিয়ে ব্যবসা করত। আবার নিজের জায়গা থেকে অন্য জায়গাতেও ব্যবসা করে জাঁকিয়ে বসতো।যেমন , জগৎ শেঠ। মাড়ওয়ারি হয়েও বাংলায় যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।
–       ভারতীয় রপ্তানি বনিক। এরা জলপথে এবং দীর্ঘ স্থলপথেও ব্যবসার প্রসার করেছিল।ইউরোপীয় দের সাথে এদের ব্যবসা ছিল।
ইউরোপীয় বণিকদের সাথে তাঁদের একটা বিশেষ তফাৎ ছিল। এরা মূলধন বিনিয়োগ করা, শিল্পের উদ্যোগী হওয়া, তার শক্তপোক্ত সংগঠন করা সে সব ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। মানে এক সাথে হয়ে আরও প্রসার ঘটানোর কোন ইচ্ছে তখনও গড়ে ওঠেনি।রপ্তানি বণিক রা দাদাল বা বানিয়া দের মাধ্যমে কিনে বিদেশে বিক্রি করত।
ডঃ তপন রায়চৌধুরি লিখছেন, – যদি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষমতা অধিকার না করত তবে এই সকল ভারতীয় বণিকরা হয়ত তাঁদের বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ কে শেষ পর্যন্ত শিল্প উৎপাদন বা শিল্প পুঁজিবাদের কাজে লাগাতে পারত।
প্রচুর সম্পদ ক্ষয় করে দেশটা ধুঁকছিল সেটা বলায় বাহুল্য। সাধারনের জীবন খুব কষ্ট কর হয়ে ওঠে ।
কুটির শিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া হল। যে ‘অপহার’ শুরু করল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেটা ব্রিটিশ রাজ আরো পরিকল্পিত ভাবে শোষনের উপযুক্ত উপনিবেশ করে ভারতবর্ষ কে গড়ে তোলে। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, মুর্শিদাবাদে থাকা কোম্পানির রেসিডেণ্ট কোম্পানিকে একটা চিঠি পাঠাচ্ছেন,
“It must give pain to an Englishman to have reason to think that since the occasion of the company to the Diwani, the condition of the people of this country has been worse than it was before …… this fine country which flourished under the most despotic and arbitrary government is verging towards its ruin.”.চিঠির প্রেরক Bichar. চারটে শব্দে চোখ চলে যাচ্ছে বার বার, ইংলিশ ম্যান, ফাইন কান্ট্রি, despotic  আর arbitrary । এতো অত্যাচারী  শাসনের হাতে এই ফাইন কান্ট্রি এসে পড়েছে যে একজন সভ্য ইংলিশম্যানের পক্ষে পেন ফুল হচ্ছে। ‘অপহার’এর বিপদ জনক প্রভাব এর পরের ভারতবর্ষের মানুষ ভুগে চলেছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।