কথা সাগরে মৎসাপুরুষ (ধারাবাহিক) কৌশিক চক্রবর্ত্তী পর্ব – ৮

বাংলার ভূঁইয়াতন্ত্র

এ এক সফল রাজার কাহিনী। এক দোর্দন্ডপ্রতাপ অথচ প্রজাবৎসল শাসকের গল্প। তাঁর গল্প যত বলা যায় ততই কম হয়ে যায়। অথচ এই বীর রাজাকে আজও কতজন বাঙালি ঠিকমতো চিনে উঠতে পেরেছেন! ঘুরতে ঘুরতেও দেখেছি বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ ভ্রমণপ্রিয় বাঙালিই মন্দির দেখেন, বালুচরি কেনেন। কিন্তু বাংলার গর্ব রাজা বীর হাম্বীরের নাম পর্যন্ত জানেননা অনেকেই।
বিষ্ণুপুর বাংলার এমন এক অংশ যার কোনো অঞ্চলই মুসলিম শাসনে কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি। অরণ্য ও মালভূমি আবৃত মল্লভূমকে কোনো সুবেদারই কখনো পুরোপুরি হস্তগত করতে পারেনি। তবে মুর্শিদাবাদকে মল্লরাজারা রাজস্ব দিয়ে দিত বলেই জানা যায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ শাসনে এঁরা ছিলেন স্বাধীন। চিরাচরিত হিন্দু প্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে বাংলার মল্লভূমি, বীরভূম ও বর্ধমান বেশ উল্লেখ্য। যদিও বর্ধমান রাজবংশের শক্তি বাড়তে শুরু করলে বিষ্ণুপুরের রাজাদের নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করে। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে অনেকটা মল্ল প্রশাসিত অঞ্চল নিজের জমিদারির আওতায় আনেন। পরের দিকে বাংলায় মুহুর্মুহু বর্গী আক্রমণের ফলে মল্ল রাজারা বড় বেকায়দায় পড়ে যান ও বিষ্ণুপুর মল্লরাজত্বের পতন শুরু হয়। যদিও সেসব অনেক পরের কথা। ততদিনে এই অঞ্চলের রাজাদের বহু কীর্তি বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। ৬৯৪ খীষ্টাব্দে যখন আদি মল্লরাজের হাতে প্রতিষ্ঠা পায় এই রাজবংশের তখন এদেশের মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের নামও শোনেনি। এর অনেককাল পরে (প্রায় ৫০০ বছর পরে) বকতিয়ার খিলজী বাংলার হিন্দু শাসকদের থেকে বাংলা হস্তগত করেন। তবে মল্ল সাম্রাজ্যের কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায় রাজা হাম্বীর মল্ল দেবের কথা ছাড়া। তাঁর সুশাসন ও প্রজাবৎসল রাজত্বের সময়কাল আজও বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এই বারো ভুঁইয়াদের ক্ষমতার সেযুগে সর্বজনবিদিত। বলে রাখি বাংলার অসীম ক্ষমতাধর এই শাসকদের ভাবগতিক মুঘল শাসকদেরও কখনোই শান্তি দেয়নি। সম্রাট শাহজাহানের আগে কোনো বাদশাই বাংলা থেকে সম্পূর্ণ রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হন নি শুধুমাত্র এঁদের কারণে। এমনকি প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বিব্রত হয়ে বাবরনামায় লিখছেন “…এই বাঙালিদের আমি দেখে নেব”। রাজা বীর হাম্বীরও সেই তালিকায় অন্যতম এক শাসক। তাঁর বীরত্ব ও শৌর্য বোঝাতে হয়ত আর কোনো উপমারই প্রয়োজন পড়বে না। শৈব বংশজাত হয়েও রাজার বৈষ্ণব জীবনযাপনের কথা না বললেই নয়। এই বিষয়ে একটি কাহিনী ঘোরে লোকের মুখে মুখে। চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্য ও অন্যান্য ভক্তরা বৃন্দাবন থেকে ফিরছিলেন বাংলায়। তখন পথে বিষ্ণুপুরের সৈন্যরা তাঁদের লুঠ করেন এবং বন্দী করেন। পরে আচার্যের ভাগবত পাঠ শুনে মল্লরাজ হাম্বীর বৈষ্ণব মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন ও দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম মল্লরাজ যাঁর পর থেকে বিষ্ণুপুরে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের ব্যাপক প্রচার ঘটে। এরপর বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত রাসমঞ্চ তাঁর হাতেই তৈরি হয়। রোদে পোড়ানো ইটের ওপর টেরাকোটার কারুকাজ করা এই মন্দিরটি আজ ইউনেস্কো সুরক্ষাবলয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি জাতীয় স্থাপত্য।
বলা হয় দীক্ষা গ্রহণের পর রাজা হাম্বীর বৃন্দাবন যাওয়া মনস্থির করেন। এরপর বৃন্দাবন থেকে একটি যুগলমূর্তিও নিয়ে আসেন। ভাবা হয়, আজও বিষ্ণুপুর মদনমোহন মন্দিরে সেই মূর্তিই পূজিত হয়ে আসছে। মতান্তরে বলা হয় প্রাচীন মূর্তিটি বর্তমানে কলকাতায় আছে। যদিও বিশ্ববন্দিত টেরাকোটা শিল্পের এই মন্দিরটি রাজা বীর হাম্বীরের মৃত্যুর প্রায় ৭৪ বছর পরে মল্লরাজ দুর্জন সিংহের হাতে নির্মিত হয়। পরে
রাজা বীর হাম্বীরের মধ্যে আমরা এক উচ্চমানের বৈষ্ণব পদকর্তাকেও দেখতে পাই। গৌরপ্রেমে মাতোয়ারা কবি বীর হাম্বীরের লিখিত পদ আজও গবেষকদের কাছে এক সম্পদ।
আজ তাঁর একটি বৈষ্ণব পদ দিয়ে বিষ্ণুপুরের পর্ব শেষ করব। ঘুরতে ঘুরতে এই পদটি রাসমঞ্চের পাশে রাজার গোশালার পাঁচিলের গায়ে চোখে পড়লো। এই পদ থেকে আমরা রাজধর্মের পাশাপাশি তাঁর বৈষ্ণব সত্ত্বায় নিজেকে সমর্পণ ও সাদামাটা জীবন সহজেই লক্ষ্য করতে পারব।

প্রভু মোর শ্রীনিবাস পুরাইলা মনে আশ
তুয়া পদে কি বলিব আর।।
আছিলুঁ বিষয়-কীট বড়ই লাগিত মীঠ
ঘুচাইলা রাজ অহংকার।।
করিথু গরল পান রহিল ডাহিন বাম
দেখাইলা অমিয়ার ধার।।
পিব পিব করে মন সব লাগে উচাটন
গোরা পদে বান্ধি দিলা চিত।।
শ্রীরাধা রমন সহ দেখাইলা কুঞ্জ গেহ
জানাইলা দুহুঁ-প্রেম-রীত।।
কালিন্দীর কূলে যাই সখীগণে ধাওয়া ধাই
রাই কানু বিহরই সুখে।।
এ বীর হাম্বীর হিয়া ব্রজ ভূমি সদা ধেয়া
যাহাঁ অলি উড়ে লাখে লাখে।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *