আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিশেষ সংখ্যায় মীনাক্ষী লায়েক
by
·
Published
· Updated
বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ
বাংলাভাষা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মেরও মাতৃভাষা। তারা বাংলাভাষা নিয়ে কি ভাবে? স্নাতকোত্তর এক পড়ুয়ার সাথে কথা বলছিলাম। সে বললো, ” বাংলাভাষা নিয়ে সংবেদনশীল হওয়া ভালো, অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর হলে আবার হিতে বিপরীত হয়। বাংলাভাষাকে ভালোবাসার জন্য তোমরা জোর করতে পারো না, বাংলাভাষাকে ভালোবাসবো স্বাভাবিকভাবে, আপন ছন্দে, যেমন পরিবারকে মানুষ ভালোবাসে। আবার পরিবারকে কেউ না-ই ভালোবাসতে পারে, জোর করে কি ভালোবাসা হয়? তোমরা বলো মাতৃভাষা শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। অবশ্যই ‘মাধ্যম’, কিন্তু তা কিছুদিন পর্যন্ত। একজন পড়ুয়া যখনই স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করে বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রে, তখন বাংলাভাষা কোনরকম উপকার করতে পারে না। সায়েন্স ও টেকনোলজির ব্যাপারটাই পুরোপুরি ওয়েস্টার্ন বেসড্। তার শব্দ, তার ভাষা সবটাই প্রায় ইংরেজি। এতোদিন শিক্ষার্থী বাংলা বিষয়ে হয়তো দারুণ ফলাফল করেছে কিন্তু বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে উচ্চশিক্ষায় এখনও বাংলার কোন ভূমিকা নেই। বাংলাভাষায় এই বিষয়গুলির জন্য নির্দিষ্ট বই ও রেফারেন্স বই রচনা হোক আগে, তারপর তোমরা বলো ‘শিক্ষার মাধ্যম’। এখন আমাদের বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে হয় পড়াশোনা ও রিসার্চের ক্ষেত্রে। বাংলা কি কোন কাজে লাগছে এক্ষেত্রে? পড়াশোনা বাদ দিলেও অন্যান্য দিকে যেমন খেলাধুলো, শিল্পকলা প্রভৃতি সমস্তরকম প্রতিযোগিতায় ইংরেজির ওপর নির্ভরশীল হতেই হবে। এমন কি যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেট পর্যন্ত ইংরেজিতেই, সেখানেও দেখো শুধুই ইংরেজি ভাষা নেই, ইংরেজি থেকে কিছুটা হলেও পৃথক একটি গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ। ভাষা তো একটা প্রবাহ, পরস্পরের সাথে কথা বলতে কিছুটা তার রূপ বদলে ব্যবহার করছি, কিন্তু বলছি আমরা বাংলাটাই, সেটা অনেক সহজ করে। বাংলা ভাষাতেই ভাবি, পরিকল্পনা করি ভবিষ্যতের, কারণ মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মজ্জাগত। তাই স্বগতোক্তি মাতৃভাষায়, প্রকাশ যে ভাষাতেই হোক না কেন। কঠিন বাংলা ভাষা সুন্দর করে বলার দিন শেষ। তোমরা বলো, এখনকার বাংলা সাহিত্যিকরা কি বাংলাকে নির্ভর করে একটা মিশ্রভাষার সাহিত্য রচনা করছেন না? এখনকার উপন্যাস, গল্প, কবিতার ল্যাংগুয়েজ দেখেছো? ”
ভেবে দেখলাম সে ভুল বলছে না। ভাষার বিকাশ ও বিনাশ দুই-ই ঘটে মধ্যবিত্তের হাত ধরে। মধ্যবিত্ত সমাজের কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি কিন্তু অর্থোপার্জন, সেটি বাংলা বান্ধব নয়। আর্থিক গুরুত্বের কথা ভেবে তাদের অন্য ভাষার প্রতি আত্মনিবেদন জরুরী হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিশ্ব আর্থনীতির জোয়ারে এখন প্রতিটি জনজাতি সামিল। এখন মানুষ ভাষাপ্রেমী মানুষ নয়, রাজনীতিরও মানুষ নয় – অর্থনীতির মানুষ। তাই ভাষা হতে হবে অর্থোপার্জনের ভাষা, কাজকর্মের ভাষা, চাকরীর ভাষা, সেখানে বাংলা ভাষা কতখানি প্রযোজ্য সেকথাও ভাবতে হবে। আর্থিক প্রয়োজনে আপন ভাষাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে পন্যবিশ্ব, বিজ্ঞাপনের হাতে, সেখানে ভাষা নিয়ে স্পর্শকাতরতা দেখাতে গেলে গালি খেতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে’ পরিস্থিতিতে জাতীয় কিছু বিজ্ঞাপন বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়, আবার বাংলার ‘… লীন’ ‘…প্লাস’ জাতীয় বিজ্ঞাপন হিন্দি ও ইংরেজিতে প্রচার হয়। বাংলা ভাষার সাহিত্য অনুবাদ করা হয়েছে, হচ্ছে, বাংলা গান ইংরেজিতে ডাব করা হচ্ছে, সফলও হচ্ছে।
অনেকেই বাঙালীদের এখনকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সহকারে এক উদ্ভট মিশ্র ভাষার সংমিশ্রণ কে বাংলা ভাষার দূষণ বলে উল্লেখ করছেন। কালের গতিতে আমাদের এসব মেনে নিতেই হবে। আমাদের আলোচনা বরং হওয়া উচিৎ লিখিত বাংলাভাষার কোন উন্নতি হচ্ছে কি না। বাংলাভাষার উৎকর্ষতা বাড়ছে কি না। খটোমটো বাংলাকে পরিত্যাগ করে বাংলা সাহিত্য অনেক গতিশীল এখন। নতুন অসংখ্য লেখক তাদের গ্রহণ যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। বাংলা আধুনিক কবিতাও বিশ্ব কবিতার প্রতিবেশী হয়ে উঠেছে। অতএব বাংলাভাষার সম্পর্কে যারা গেলো গেলো রব তুলছেন এই বাংলায় তাদের জেনে রাখা ভালো কোন ভাষার স্থায়িত্ব নির্ভর করে কতগুলি বিষয়ের উপর, যেমন – কতগুলি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে, কত মানুষের মাতৃভাষা এটি, এ ভাষার নিজস্ব কোন লিপি রয়েছে কি না, সে ভাষার লিখিত সাহিত্যের মান কেমন, কোন দেশের রাষ্ট্রভাষা বা দাপ্তরিক ভাষা কি না, কোন রাজনৈতিক উপনিবেশ বা সংখ্যাগুরু ভাষার প্রভাব রয়েছে কি না, সেই ভাষাভাষি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কিরূপ। শেষোক্ত কারণটি সবল হলে সোনায় সোহাগা। কোন ভাষা বা জাতির স্বকীয়তা বজায় এবং সংরক্ষণ প্রয়োজন। সেটি করতে হলে সে ভাষার চর্চা যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন অন্য ভাষাকে মর্যাদাদান। অবজ্ঞা বা বৈরিতা প্রদর্শনে ভাষার সংরক্ষণ হয় না। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও ইংরেজি বা হিন্দি ভাষার প্রতি অনীহা দেখিয়ে লাভ নেই, কারণ এ দুটিই আমাদের রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক ভাষা। গ্লোবালাইজেশনের যুগে শুধু আমার-তোমার করলে চলবে না, বরং এ দুটিকে সাথে নিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ পথ তৈরী করে এগোতে হবে।
মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষার শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।