আর্ষ অনার্য দ্রাবিড় শক হুন পাঠান মোগল ‘র সমন্বয়ে ভারত নামক দেশের পৃথিবীতে বসবাস । মানুষের এই মহামিলন ক্ষেত্রের সম্ভবত এক মহামন্ত্র রবীন্দ্রনাথ ছবি এঁকেছিলেন ‘জনগনমন অধিনায়ক’ মহামন্ত্রের মাধ্যমে । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এক পারস্পরিক সহাস্তানের নাম সাড়া পৃথিবী জুড়েই একমাত্র ভারতবর্ষ । বেশভূষা, খাদ্য, ভাষা, সংস্কৃতির এতবড় মিলনক্ষেত্র সত্যি আর নেই পৃথিবী জুড়েই । কত জাতের সংমিশ্রণ যে ঘটে গিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে হিসেব গবেষকদের দৃষ্টির বাইরে নয় । আর এই ঐক্যই ভারতবর্ষকে ‘বৃহৎ পৃথিবীর ছোট্ট সংস্করণ’ হিসেবে তুলে ধরেছে পৃথিবীব্যাপী । ভারতবাসী সততই গ্রহণ করেছে সমস্ত কিছু সহস্রাব্দ ধরে – ও ভারতের সনাতন ধর্মের মূল সত্যও তাই – সে শুধু নতুনকে গ্রহণ করতেই শিখিয়েছে, বিচ্ছেদ নয় । নেগ্রিটো, প্রটো-অস্ট্রোলয়েড, মঙ্গোলয়েড বা মঙ্গোলীয়, মেডিটেরানিয়ান, পাশ্চাত্য গোলমুন্ড বা ওয়েস্টার্ন ব্র্যাকিসিফেলস এই সমস্ত জাতি গোষ্ঠীর মানুষের ছাঁচ বা গঠনের গড়নের মানুষ ভারতবর্ষে বসবাস করছেন । ক্রমশ মানুষের এই আগমনের ধারাতে ভারতে আর্য জাতি সমূহের আগমনের ইতিহাসও স্বল্প অনুসন্ধানের প্রয়োজন বৈকি । তবে ভারতীয় সনাতনের ইতিহাসের মূল ভিত্তি যদি ঋগ্বেদ হয় তবে অবশ্যই ধরে নেওয়া যায়, আর্যদের ভারতে আগমন ঘটেছে ঋগ্বেদের পূর্বেই । কারণ সেখানে আর্য নামটি বারেবারেই এসেছে ঘুরেফিরে । উদাহরণ – “আর্যা ব্রতা বিসৃজন্তো অধি ক্ষমি।” (ঋগ্বেদ ১০/৬৫/১১) – অর্থাৎ, সকল মানুষকে আর্য করার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে যার ক্ষমা ধর্মই প্রধান । ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ বলছে – “সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসর্বসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬) অর্থাৎ, নদী সমূহের মিলন ক্ষেত্র সমুদ্র, আর্যরাও তেমনই সমদর্শী ও সকলের প্রিয়ভাজন । মহাভারতের অংশবিশেষ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, “কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন।।” (ভগবদ্গীতা ২/২) অর্থাৎ অর্জুনের ভীরুতা-প্রাপ্তিকে অনার্য বলা হচ্ছে, পক্ষান্তরে আর্যকে শ্রেষ্ঠ বলা হচ্ছে । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বলছে “ব্যবস্থিতার্যমর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।” – অর্থাৎ, আর্য ব্যবস্থাকে যিনি ব্যবস্থিত করতে সমর্থ তিনিই রাজা বা রাজ্যাধিকারী ।
এ হেন পুরাতন ভারতবর্ষের জীবনযাত্রা এগিয়ে চলেছিল মিশ্র সংস্কৃতির এক আঁতুড়ঘর হিসেবেই । ক্রমশ বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ভারতে বিভিন্ন শতাব্দীতে । সূর্যোদয় সূর্যাস্ত যেমন একটি দিনের বৈশিষ্ট্য, ঠিক তেমনই উত্থান পতনও সমাজের সামাজিক শিক্ষা বোধের একটি বৈশিষ্ট্য । এই ভাবেই এগিয়ে এসেছে ভারতীয় ইতিহাস আজকে পর্যন্ত । ক্রমশ সংস্কৃত সাহিত্য যত বিলুপ্তির পথে ততই আমরা বিভিন্ন ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ পড়তে পড়তে হয়ত অনেক সত্যকে অস্বীকার করেই এগিয়ে চলেছি । হয়ত এর একটিমাত্র কারণ, পৃথিবীতে যে দুটি ধর্মের মানুষকে যথেষ্ট আগ্রাসী ভূমিকায় দেখা গেছে গত ৪০০/৫০০ বছরের ইতিহাসে তার মধ্যে খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইসলাম ধর্মই প্রথমত ও প্রধানত পৃথিবীকে এক সর্বগ্রাসী ‘হা’ দিয়ে গিলে ফেলতে চাইছে । তাই স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই ঔপনিবেশিক আবহাওয়ায় গড়ে ওঠা নতুন ভারতবর্ষ ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ থেকে ভারতীয় ইতিহাসকে জানতে গিয়ে হয়ত ইতিহাসের অনেক অধ্যায় সযত্নে সরিয়ে রেখেই জানছেন পড়ছেন ও সমৃদ্ধ হচ্ছেন । হয়ত এই না জানা ও অজানা ইতিহাস ভারতবর্ষের নতুন ও আগামী ইতিহাসকে নতুন এক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে, যেটা গ্রহণীয় না বর্জনীয় সেই বিচারের ভার সময়ের হাতে ।
( ২ )
কোনো এক সামাজিক শিক্ষা আজকের ভারতবর্ষের পূর্বোক্ত অধ্যায়ে বর্ণিত সমস্ত ধারণাকে কেমন করে যেন ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিতে চাইছে, যে কর্মকাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে আগামীর ইতিহাস । দীর্ঘ দুই শতাব্দী-ব্যাপী ইংরেজ শাসনের পরে, প্রচুর রক্তক্ষরণ, স্বীয় আহুতির পরে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল ১৯৪৭ সালে । সকল রক্তক্ষরণ ও আহুতিকে বিদ্রূপ করেই অপরদিকে ভারতীয়দের একটি বড়ো অংশ প্রকাশ করলেন তাঁদের মতবাদ এই যে, আপোষকামী-তোষামোদপ্রিয় জিন্না সাহেব ও নেহেরুর ক্ষমতার শীর্ষে থাকার দ্বন্দ্বই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসের শেষার্ধ । আসলে ভারতের স্বাধীনতা কখনোই কাম্য ছিল না, কাম্য ছিল ক্ষমতার শীর্ষে কে থাকবেন ? নেহেরু না কি জিন্না সাহেব ? আসলে ভারত পাকিস্তান ভাগ হয় নি কখনই, ভাগ হয়েছে শুধু ক্ষমতা-লোভীদের নিজস্ব ইচ্ছা, যে ইচ্ছার উপর দাঁড়িয়ে ১৯২৫ সালের পরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভারত বিভক্ত হোল দ্বিজাতি তত্বের ভিত্তিতে । তাহলে দেশের স্বাধীনতা লক্ষ্য ছিল না, লক্ষ্য ছিল নিজেকে মসনদে প্রতিষ্ঠিত করা । আর তাই প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভারত মাতাকে ছিঁড়ে ফেলা হোল দুইভাগে – ভারত ও পাকিস্তান । হয়ত বীজ বপন করা হোল নতুন করে নতুন ভারতবর্ষকে আগামীতে আরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা যায় কিনা । হিন্দু ( ?? ) ( সিন্ধুর অপভ্রংশ এক শব্দ – কোনো জাতিগত পরিচয় অন্তত এই শব্দে ছিল না আর্য জাতির বিচরণের সময় – তারা যেহেতু সিন্ধুর অববাহিকায় বসবাস করতেন আর যেহেতু তারা সিন্ধু বলতে পারতেন না ‘হিন্দু’ বলতেন ) কখন যে এক ধর্মীয় নামকরণ হয়ে উঠলো এ এক পরমাশ্চর্যের বিষয় বৈকি ।
স্বাধীন ভারতে তৈরি হোল নতুন সংবিধান । পরে সেখানে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষ’ শব্দটি যুক্ত করা হয় ভারতের ইতিহাসের সঙ্গে ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই । স্থিরীকৃত হয় – ভারতীয় ভূখণ্ড যে সরকার পরিচালনা করবে তারা ভারতের কোনো ধর্মকেই গুরুত্ব দেবে না বা ভারত নামক দেশের কোনো ধর্ম থাকবে না – সে হবে ধর্ম নিরপেক্ষ ( ৪২ তম সংবিধান সংশোধনী, ১৯৭৬ ) । মাত্র চার দশকের মধ্যেই ভারতীয় সরকার ভুলে গেলেন ভারতীয় সদ্য ইতিহাসের ধারাকে । প্রযুক্ত করতে চাইছেন মধ্যযুগীয়ও এক শাসন-ধারা যেখানে থাকবে শুধু ‘অমুসলিম’ । নাগরিকতা সংশোধনী আইন প্রণয়ন করে ভারতে নতুন করে দ্বিজাতি-তত্বের নতুন ধারাকে আবার মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে । তাহলে কি ভারতমাতা আবার রক্ত চাইছেন ১৯৪৭ পূর্ববর্তী স্বাধীনতার যুদ্ধের মতো ? প্রশ্ন এই কারণেই আসছে কারণ, ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দুর দেশ ও প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলমানের দেশ । তাহলে কি ৮০ শতাংশের গর্জনে ১৫ শতাংশকে দমিয়ে রাখার এক কূট-কৌশল এই নাগরিকতা সংশোধনী আইন ( ২০১৯ ) ? নাকি দেশকে সেই ১৯৪৭ সালের মতই আবার ক্ষমতার শীর্ষে কে অবস্থান করবেন সেই মতে ভারতীয় জনগণকে নিয়ে এক নতুন ছেলেখেলা ? এই ট্র্যাডিশন কি সমানেই চলবে ?
জানি না, কি পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে আগামী ? অর্থনৈতিক দিক থেকে মনে হয় এই সমীকরণ আর একটা ইঙ্গিত বহন করে । সত্তরের দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপ সোভিয়েত রাশিয়া আজ আর নেই, এখন বেনিয়া ইংরেজ তার প্রভুত্ব বিস্তারে অনেক বেশি আগ্রহী সাড়া পৃথিবী জুড়েই । আর ভারতের ১২১ কোটি ( ২০১১ সেনসাস ) মানুষের বাজার তো সত্যিই লোভনীয় । রাজনীতির নামে ভারতকে নতুন করে বেনিয়া চক্রের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে কি না সেটাও কিন্তু বিচার্যের বিষয় । কারণ ইংরেজ প্রভু আমেরিকা ও ইংল্যান্ড জানে ১৯৩৯ – ১৯৪৫ বিশ্বযুদ্ধে কয়েকটি দ্বীপ সমৃদ্ধ জাপান কি পরিমাণ নাস্তানাবুদ করেছিল ইংরেজদেরকে । তাই ১২১ কোটিকে ভেঙ্গে নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্মদান করিয়ে এই ১২১ কোটির বাজারকে করায়ত্ত করার এক অভিনব কৌশল কি না – সেটাও কিন্তু ভারতীয় বশংবদ আমলা ও অর্থনীতিকদের একবার ভেবে দেখা উচিত ।
এক আপোষকামীতা তোষামোদপ্রিয়তা মাত্রই ৭০ বছর আগে ধর্মের নামেই কিন্তু দেশকে বিভক্ত করেছে । বর্তমান কি সেই ধারাকেই অনুসরণ করছে ? ভাবার সময় অবশ্যই এসেছে এসেছে এসেছে ।