দেখতে দেখতে ৩৬৫ পাতার আরেকটা ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা সমাপ্ত করে উঠলাম। ২০১৯ সালটা বিদায় নিল, ভাল মন্দ মিশিয়ে অনেক কিছুই দিয়ে গেল। সৃষ্টির দুনিয়ায় বহু নতুন চারা জন্মালো, কিছু চারা বৃক্ষে পরিণত হল আবার বেশ কিছু বৃক্ষের আয়ু শেষ হল। এ বছরই techtouchtalk এর মতো একটি উন্নততম প্রযুক্তিগত সাহিত্য ‘মঞ্চ’ এর বিকাশ ঘটল, যেখানে একইসঙ্গে সৃষ্টিপ্রিয় মানুষ ও সাহিত্য প্রেমিকরা পেয়ে যাচ্ছেন কবিতার মেহফিল আবার গল্পের ব্যাগ, কোনদিন পাচ্ছেন সাহিত্য ক্যাফে আবার কখনো সিলভারস্ক্রীনে নতুন নতুন ছবির মূল্যায়ণ, এরকম অনলাইন সাহিত্য ঠেক যে আগে কখনো তৈরি হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ২০১৯ এ বেশ কিছু সিনেমার আমরা মূল্যায়ণ করেছিলাম এই techtouchtalk এই, এখন ফিরে দেখে নেওয়া যাক ২০১৯ এর বেশ কিছু সিনেমা যা সিনেপ্রেমিকরা বহু বছর নিজেদের স্মৃতিতে ধরে রাখবেন। আমরা এক ঝলকে দেখে নেব গত বছরের মনে রাখার মতো ১০ টি ভারতীয় সিনেমা।
১০.
PASSWORD- আমি বারবার বলে থাকি দেব বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য বা ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনেক কিছু করতে চায় অন্তত তার কাজের ধরন দেখে তেমনটাই মনে হয়। দেব ভেনচার এর প্রযোজনায় এই পাসওয়ার্ড ছবিটিও তার একটা উদাহরণ। খুব বড় সাফল্য না পেলেও এই ছবিকে আমি সারা ১০ এর মধ্যে রাখছি কেবলমাত্র এই টীম এর প্রচেষ্টার জন্য। কমলেশ্বর মুখার্জির চেষ্টায় তৈরি প্রথমবার বাংলা সিনেমা জগতে একটা আদ্যপ্রন্ত টেকনিকাল সিনেমা। চিত্রগ্রহণ থেকে শুরু করে অ্যাকশন সমস্ত কিছু এত উন্নতমানের আগে বাংলা সিনেমায় দেখিনি। বলিউড এর অ্যাকশন সিনেমাকে যে বাংলা সিনেমা খুব তাড়াতাড়ি টেক্কা দিতে পারবে তার একটা উদাহরণ দেব, রুক্মিণী, পরমব্রত পাওলি অভিনীত পাসওয়ার্ড।
০৯.
KIA AND COSMOS- একটি অন্য ধরার ছবি। মা আর মেয়ের সম্পর্কের গল্প, মানুষ করার গল্প বলার সিনেমা। সুদীপ্ত রায় পরিচালিত আরেকটি ভালো লাগার মতো ছবি। স্বস্তিকা ও ঋতিকার একা মা ও মেয়ে সেজে নিবিড় থেকে আরো নিবিড় যাওয়ার যে রসায়ন তৈরি করেছে এ সিনেমায় ত শেষ দেখেছিলাম take one নামের এক সিনেমায়। আর এদের সাথে তৃতীয় অভিনেতা এক বেড়াল, তার পারফরম্যান্সই এ সিনেমাকে যেন অন্য মাত্রা দেয়। এই সিনেমাকে এই লিস্টে রাখার অন্যতম কারণ হল এর চিত্রগ্রহণে দক্ষতা, এমন এমন জায়গায় এত প্রাসঙ্গিকভাবে চিত্রগ্রহণ করা হয়েছে যা ভোলা যায়না। আরেকটি কারণ হল এই সিনেমার গতি যা খুব দ্রুত নয় আবার একেবারে ধীর নয়। কিন্তু খুব সামলে সামলে হেঁটে গেছে এ গল্প আমাদের মস্তিষ্ক থেকে মনের পথে।
০৮.
SHANKAR MUDI- এ বছর বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সবচেয়ে উল্লোখযোগ্যভাবে দাগ কেটে যাওয়ার মতো ছবি হল শঙ্কর মুদি। অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বড় বড় শপিং মল কে কেন্দ্র করে আসলে ক্যাপিটালিজম কে আঘাত হেনেছে এই সিনেমা। পর্দা জুড়ে আমাদের সমাজের ছবি, আর কৌশিক গাঙ্গুলির মতো একজন দক্ষ অভিনেতা যেন এই সমাজের খেটে খাওয়া দিন মজদুর শ্রেণীর প্রতিনিধি যে সমাজে আসা নতুন নতুন পরিবর্তনের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টায় বারবার পা পিছলে পড়ছে মুখ থুবড়ে।
০৭.
JERSEY- তেলুগু ভাষায় নির্মিত এই জার্সি সিনেমা আবারও নাকি নির্মিত হতে চলেছে হিন্দি ভাষায় (সত্যতার ব্যাপারে জানা নেই, তবে গুজব তাই বলে)। গৌতম তিন্নানুরি এর পরিচালনায় তৈরি এই সিনেমা মূলত ক্রিকেট খেলা ও তার সাথে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। এই সিনেমাকে এত ভালো লাগার কারণ এর সংলাপ আর আত্র সাথে যুক্ত থাকা চেহারায় অভিব্যক্তি। দারুন অভিনয়, দারুন চিত্রনাট্য এই সিনেমাকে মনে রাখার মতো করে দিয়েছে।
০৬.
GUMNAAMI- বছরের সেরা ছবির লিস্ট তৈরি হবে আর সৃজিত মুখার্জির সৃষ্টির উল্লেখ হবে না তা কি করে হয়। অনুজ ধর ও চদ্রচুর ঘোষের লেখা conundrum নামক বই কে কেন্দ্র করে সৃজিত মুখার্জি দেশের সবচেয়ে বড় রহস্যের ওপর আঙ্গুল তুলেছেন। নেতাজি মৃত্যু রহস্য নিয়ে তৈরি এই সিনেমা আসলে আমার দেখা এখনও পর্যন্ত নেতাজি সম্বন্ধিত সবচেয়ে উন্নত ও সেরা কাজ। সৃজিত মুখার্জির পরিচালনা নিয়ে ত আর কিছু বলার নেই, অনেকদিন পর সৃজিত ম্যাজিক বাংলার দর্শক ফিরে পেল ২০১৯ এই, আর এই সিনেমাতেই আমরা জুটি বাঁধতে দেখলাম বর্তমান সময়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুজন সেরা অভিনেতা প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য।
০৫.
HAMID- উর্দু ভাষায় নির্মিত এই ছবিকে লিস্টে না রেখে পারা যায় না। লেখক ও পরিচালক আইজাজ খানের পরিচালনায় এই ছবিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হল এর সরলতা। কাশ্মীরের জনজাতির প্রতিনিধি হিসেবে হামিদ নামক বালক যেন আমাদের কাছে বারবার একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে আসে। না, এই সিনেমায় আপনি পাবেননা কোন উচ্চপ্রসংশিত ক্যামেরার কাজ, আপনি পাবেন না কোন অ্যাকশন, তবে আপনি পেতে পারেন এক নিষ্পাপ গল্প, একটি শিশুর মধ্যে দিয়ে নিজেদের জন্য মানবতাবাদ সম্বন্ধিত ভারী ভারী প্রশ্ন, একটি ছোট্ট বাচ্চার দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে দেখার আঙ্গিক যা আপনার বা আমার চেয়ে অনেক নিষ্পাপ। এই সিনেমাটি ইতিমধ্যে সেরা উর্দু সিনেমার জন্য রাষ্ট্রিয় পুরস্কার গুছিয়ে নিয়েছে।
০৪.
CHICHHORE- ২০১৯ এর নুতেশ তিওয়ারির এই সিনেমা হয়ত কখনোই ভুলতে পারবো না। দেশের সমস্ত দর্শক যারা হোস্টেলে কোন না কোন সময় থেকেছে তাদের গল্পকে তুলে ধরা হযেছে। যে কোন মানুষই এই সিনেমায় নিজের ছাত্রাবস্থা খুঁজে পাবে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলার নেই এই সিনেমাকে নিয়ে। দেখতে দেখতে আমরা যেন অতীতে হোস্টেলের দিনে বারবার ফিরে ফিরে যাই।
০৩.
VINCIDA- লিস্টে আবারো সৃজিত। আর এবার তার বছরের সবচেয়ে সেরা সৃষ্টি ভিঞ্চিদা। এই সিনেমার গল্পের মধ্যে রয়েছে সেই পুরনো চেনা ২২শে শ্রাবণের গন্ধ, চতুষ্কোণ এর মতো টানটান উত্তেজনা আর সবার প্রিয় সৃজিত ম্যাজিক। কিভাবে এই প্রজন্মের দুই লড়াকু অভিনেতাকে এক পর্দায় রেখে পরস্পর পরস্পরের সাথে যুদ্ধ লাগাতে হয় তা এই সিনেমায় সৃজিত দেখিয়ে দিয়েছেন। পুরো সময়টা জুড়ে ঋত্বিক ও রুদ্রনীল একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছেন। এমন সিনেমার জুড়ি মেলা ভার।
০২.
SKY IS PINK- একেবারে সত্য ঘটনা ও চরিত্র অবলম্বনে নির্মিত সিনেমা স্কাই ইস পিঙ্ক পছন্দের সিনেমার লিস্টে রাখতেই হবে। প্রিয়ঙ্কা কে অনেকদিন পর স্ক্রীন এ দেখে বেশ অবাক লাগল। যতদিন যাচ্ছে এই অভিনেত্রী নিজেকে আরো ভালোভাবে ঘষে মেজে নিচ্ছেন তা এই ছবিতে তার come back থেকে বোঝা গেল। কি অনবদ্য অভিনয়, কি সাবলীল দুঃখপ্রকাশ, কি সুন্দর অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা, স্ক্রীন থেকে চোখ ফেরানো যায় না। তেমন সুন্দর সঙ্গত দিয়েছেন আরেক দক্ষ অভিনেতা ফারহান আখতার। আর সবচেয়ে অবাক করেছে দাঙাল গার্ল খ্যাত জাইরা ওয়াসিম, এই ছোট্ট বয়সে এত পক্ক অভিনয় ভাবা যায় না। এই সিনেমা মূলত আয়েশা কে কেন্দ্র করে যে জন্মের পর থেকেই জটিল মারণ রোগের শিকার, কিন্তু তার বাবা মা অনবরত মেয়ের জন্য মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লডছেন কিন্তু তারা সবাই জানে যে এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত জয়ী তো মহাকাল ই হবেন আর তাই হলও। দীর্ঘ ১৮ বছর লড়াই এর পর তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এমন কথা নয় যে এরকম সিনেমা আগে তৈরি হয়নি, আসলে এই সিনেমা অন্যান্য সিনেমার চেয়ে আলাদা হয়েছে কেবলমাত্র এই সিনেমার গতির জন্য। এত ধীর গতিতে মৃত্যুকে দর্শকের মনে বিদ্ধ করেছেন লেখিকা পরিচালক সোনালী বোস যে দর্শকের মনে তা দাগ কাটবেই, ব্যথায় ছটফট করবেই।
০১.
ARTICLE 15- এই বছরের সেরার সেরা হিসেবে আমরা পেয়েছি অনুভব সিনহার আর্টিকেল ১৫। এই সিনেমা নিয়ে কি আর বলব, শুধু একটা পরিসংখ্যান বলছি তাহলেই আপনারা বুঝে যাবেন এ সিনেমা কেমন। সেই সংখ্যাটা হল ৭। হ্যা, সাতবার এই সিনেমাটি আমি নিজে একমাসের মধ্যে দেখেছি। গল্প, অভিনয়,চিত্রগ্রহণ,দৃশ্যায়ন,কলার গ্রেডিং, নির্দেশনা, সংলাপ, গতি, লয়,ছন্দ সব দিক দিয়ে সিনেমাটি একেবারে সিনেমার মতো হতে উঠেছে। আর সবচেয়ে ভাল যে জিনিসটা লেগেছে এই সিনেমার তা হল বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে একটা সিনেমা একসাথে সংবিধান, রাজনৈতিক শক্তিসমূহ, সমাজ ও মনুষ্যত্বকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করেছে।
এই ১০ টি সিনেমা ছাড়াও বেশ কয়েকটি সিনেমার নাম নিতেই হয় যা আমাদের মনে থেকে যাওয়ার মতো।
Anirban Chatterjee – জন্ম তৎকালীন বিহারের অন্তর্গত ‘কয়লার রাজধানী’ নামে পরিচিত ধনবাদ শহরে। প্রাথমিক শিক্ষা ওখানেই হয় পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের লাল মাটির দেশ পুরুলিয়ায় আসায় বাংলা সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে এবং ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণতি পায়। সাথে নানান ভাষার সাহিত্য পড়তে শুরু করে। লেখা শুরু হয় গল্প দিয়ে। ২০০৯ সালে প্রথম লেখা গল্প প্রকাশিত হয় লিটিল ম্যাগাজিনে। ২০১১ সালে আশাবরী প্রকাশনী থেকে প্রথম বই প্রকাশিত হয় “অনির্বাণ”, তারপর “অনুভব”। ২০১৮ সালে অনির্বাণের কয়েকটি কবিতা নিয়ে নতুন ধরার শ্রুটিপাট করার চেষ্টা করেন সতীনাথ ব্যানার্জি ও কয়েকজন আবৃত্তিশিল্পী র দল। সাহিত্যের পাশাপাশি অনির্বাণের নেশা সিনেমা। নিজে একসময় বাংলা সিনেমায় সহ- পরিচালকের কাজও করেছে এবং কয়েকটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিও করেছে। অভিনয় করে জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত।