স্মরণ ২০০: গদ্যে দুর্গাদাস মিদ্যা

বিদ্যাসাগর – একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখা

সমাজ জীবন বহমান স্রোতধারা। শুরু আছে, শেষ নেই, গত আছে স্তব্ধতা নেই। পরিণাম আছে, পরিণতি আছে কিন্তু ছেদ নেই। চলতে চলতে এগিয়ে চলে। বর্তমান অতীত হয়, আর ভবিষ্যৎ হয়ে উঠে বর্তমান এই বহমান স্রোতধারায়। তবু কিছু উপল খন্ড স্থায়ীত্ব অর্জন করে ভাবীকালের কাছে রেখে যায় প্রশ্নচিহ্ন। সেই রকম একটি প্রশ্নচিহ্ন মাননীয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শূণ্য ভাবালুতা নয় একেবারে। কারণ বিদ্যাসাগরের জীবনী পর্যালোচনান্তে এই স্ত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে তিনি কোনো এককালের নন, বা বিশেষ কোনো সময়ের নন। স্রোতস্বিনীর স্রোতধারা যত দীর্ঘ হয়, যত বিস্তারিত হয় তত বোঝান হয় এবং পুষ্ঠতা প্রাপ্ত হয়। সময় সেখানে একটা ক্রিয়াশীল সত্বা মাত্র।
যত সময় অতিক্রম করছি ততই উপলব্ধ হচ্ছে এই যে বিদ্যাসাগীয় আদর্শের স্রোতধারাও প্রতিনিয়তই পুষ্ট ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে সময়ের প্রেক্ষাপটে। আজ আমরা যেখানে উপনীত। আমরা অর্থাৎ আমাদের সমাজ তার জন্য তাঁর অর্থাৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যবান যোগদান আছে বলেই তিনি আজও এই দুই শত বৎসরের পরও স্মরণীয় এবং বরণীয় ব্যক্তিত্ব।
প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি – সত্যিই কি তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং আলোচ্য ব্যক্তিত্ব? এই প্রশ্নের নিরসনে আমাদের অন্বেষণ। তাঁর নিজের উদৃতি দিয়েই আমাদের ভাবনার পথ চলা শুরু করি। তিনি বলছেন – এ দেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ঠ মানুষদের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাতপুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে তবে এদেশের ভাল হয়’।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে কী কারণে তিনি বলেছিলেন – নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে … ভাল হয়। তার মানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরাতনের মধ্যে এমন কিছু গলদ ছিল যা একেবারেই সমাজ কল্যাণ মূলক ছিল না। ছিল না তো বটেই – নারী শিক্ষা অচল ছিল। বাল বিধবাদের আকাশ ছোঁয়া হৃদয় বিদারক জীবনযাপন যন্ত্রনা এসব তো ছিলই সঙ্গে ছিল নারী জাতির অশিক্ষা আর মিথ্যে আচার এবং অনাচার। সব মিলিয়ে একটা দুর্বিষহ দমবন্ধ অবস্থান যার প্রতিকার একান্তভাবেই প্রয়োজন ছিল। আর সেই প্রয়োজনের কথা তিনিই প্রথম উপলব্ধি করলেন। এই বিষয়ে বিদ্যাসাগর কতটা দূরদর্শি ছিলেন তা বোঝা যাবে তাঁর শিক্ষাসংক্রান্ত ভাবনা থেকে। তথ্য থেকে জানতে পারা যাচ্ছে যে নতুন মানুষ চাষ করতে হলে পুরাতন বস্তাপচা ধ্যানধারণার মূলে কুঠারাঘাত করা এবং সেই সমস্ত ধ্যান ধারণাকে অপাংক্তেও করে তোলা। শিক্ষাকে তিনি হাতিয়ার করলেন।
১৮৫২ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে একটি খসড়া প্রস্তুত করেন। সেই খসড়ার মধ্যে যেমন প্রাচীন হিন্দুদর্শ্নের সাথে বর্তমান কালের অর্থাৎ সেই সময়ের প্রগতিশীল ভাবধারার পাঠ্যপত্রের বিষয় হিসেবে অঙ্গীভূত করেন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন তুলনামূলক পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে গ্রহণ বর্জনের পথে প্রস্তুত হবে।
‘    ’ র ধারণা কতটা যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞান মনস্কতা তা নিশ্চয়ই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি বা পারি। সেই সময়ে বসে এই ভাবনা করা ততটা সহজ ছিল না। এই ভাবনা যে কতটা আধুনিক ভাবতে গেলে আশ্চর্য হতে হয়। এখানেই বিদ্যাসাগর সমসাময়িক এবং আধুনিক হয়ে উঠেন তাঁর চিন্তার অগ্রগতিতে।
বিদ্যাসাগর অত্যন্ত জন্মসূত্রে একজন ব্রাহ্মণ বংশীয় সন্তান তা সত্ত্বেও দেব দ্বিজে তাঁর অচঞ্চলা ভক্তি ছিল না। তিনি ভাবের আবেগে চলা মানুষ ছিলেন না। যুক্তি,তর্ক যা প্রকৃত জ্ঞানের প্রকাশ ঘটায় তাই বিশ্বাস করতেন তিনি। মানুষের বেশ কিছু দুঃখ, কষ্ট যে স্বার্থানবেষী মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট সে কথা তিনি স্পষ্টরূপে বুঝেছিলেন তাঁর মত করে। জানি রাম মোহন রায়ের নামও মনঃশ্চক্ষে ভেসে উঠবেই। তাঁকে যত্থার্থ সম্মান দিয়েই বলা যায় যে ঈশ্বরচন্দ্র একটু অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ ছিলেন। সে কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অকপটে স্বীকার করেছেন তাঁর রচিত ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ প্রবন্ধে এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরো কিছু ঘটনার কথা বলে নিলে মানুষ ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্র বুঝতে সুবিধে হবে।
১৮৭৬ সাল, দেশজোড়া দুর্ভিক্ষ। তিনি ভীষণভাবে বিচলিত। নিজের গ্রামে গিয়ে অন্নসত্র খুললেন। এবং এই কাজে সাধারণ স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় তিনি অবর্তীণ হলেন, যা এই সময়ে দাঁড়িয়ে একেবারেই দুর্লভ এবং অভাবনীয়। মানুষের জন্য কতটা প্রাণ কাঁদলে নিজস্ব ঐ রকম পদমর্য্যাদা ভুলে একেবারে সাধারণের কাছে নেমে আসা? আর একটা ঘটনা ১৮৬৮-৬৯ সাল ম্যালেরিয়ার প্রকোপে বিধ্বস্ত প্রায় বর্ধমানে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। স্বেচ্ছাসেবকের ঐকান্তিকায়। এসব ঘটনা কোনো কষ্টকল্পিত বিষয় নয়। সবই ইতিহাস স্বীকৃত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় স্মরণীয় এই কারণে যে তিনি সেই সময়ে বুঝতে পেরেছিলেন প্রাচ্য এবং প্রতীষ্যের একত্র সমাবেশ খুব প্রয়োজন। এই ধারনাই তাঁকে ঐ সময়ের একজন প্রধান ব্যক্তিত্বরূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলছেন – প্রাচ্য, প্রতীষ্যের একত্র স্মাবেশের গুনেই তিনি বর্তমান সময়ের শিক্ষিত স্মাজের মুখপাত্র স্বরূপ হইতে পারিয়াছিলেন। এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। তাই বিদ্যাসাগর শিক্ষা বিস্তারে এতটা জীর দিয়েছিলেন। কারণ তিনি সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন আধুনিক শিক্ষা ছাড়া হাজার আচার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব ছিল না। সারা জীবন বাধা তো তিনি কম পান নি। এইসব কাজ করতে গিয়ে। যখনই বাধা পেয়েছেন তখনি তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে জ্বলে উঠেছেন সেই সব বাধা অতিক্রম করতে।
এই কথার যথার্থ, প্রমানিত হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিরচিত ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ পাঠ প্রাক্কালে।
তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন – বাঙালি জীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগ প্রাবল্যে কঠিন প্রতিকুলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া হিন্দুত্বের দিকে নহে। সাম্প্রদায়িক্তার দিকে নহে। করুণার অশ্রুজল পূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে অস্থির ভারতের প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের জীবন চরিত আলোচনা এবং পর্য্যালোচনা খুব বেশী প্রাসঙ্গিক বলে কি মনে হয় নে?
‘নারী স্বাধীনতা’ এখন একটি বিষয়। এই বিষয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু আলোচনা হয়। সেই আলোচনার প্রারম্ভে নান্দীমুখের কাজটি করে ছিলেন বিদ্যাসাগর।
তিনিই প্রথম এবং প্রধান ব্যক্তি ছিলেন যিনি নারীসমাজের বন্দিত্ব জীবনের দুঃখ দুর্দশা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন আযার আর বিচারের মরুবালিরাশি নারী জীবনের স্রোত কীভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। তাই তিনিই পথিককে ‘নারী স্বাধীনতা’ আন্দোলনের।
তাছাড়াও তিনি স্মরণীয় বাঙালীদের কাছে এবং বিশেষ করে বাংলাভাষার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে কারণ তিনিই- ‘বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ ছিলেন একথা আমার নয় একথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের’। ইহা অত্যুক্তি নয় যথার্থ সত্য বলিয়াই মনে হয়।
আলোচিত সত্ত্বা না থাকিলে অন্ধকার দূরীভূত হয় না। ‘ভালো’ সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান না থাকিলে খারাপের ধারণা স্পষ্ট হয় না। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। তিনি প্রাচ্য ও প্রতীক্যের মিলিত স্রোত ধারার ফলে বুঝতে পেরেছিলেন সামাজিক অন্ধকার কোথায় এবং কতটা লুকিয়ে আছে। তাই তিনি সমাজ সংস্কারের সম্মাজর্নী হাতে নিয়ে যুগনায়ক হিসেবে অবতীর্ণ হলেন এবং নারী শিক্ষার মত গুরুতপূর্ণ একটি দিকে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করলেন যা সমগ্র জাতীয় জীবনে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।
জন্মগ্রহণের দ্বিশততম বর্ষে প্রবেশ করে আমাদের অবশ্যই মানতে হবে যে বিদ্যাসাগর যদি না জন্মগ্রহণ করতেন তবে আমাদের এই সামাজিন জীবনের অন্ধকারময় দিকগুলি হয়ত এত সত্ত্বর চিহ্নিত হত না এবং দূর করার যে অনিবার প্রয়াস আজ চোখে পড়ছে তাও সম্ভব হত না এত শীর্ঘ। কারণ হিন্দুধর্মের গঁড়ামি যে কোন পর্য্যায়ে পৌঁছেছিল তা সহজেই বোঝা যায় সতীদাহ প্রথা।
বহু বিবাহ প্রথা, বালবিবাহ প্রথা এবং সর্বোপরি নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার স্নগকীর্ণ প্রয়াসকে প্রাধান্য দেওয়া। এর বিরুদ্ধে রামমোহন রায় সোচ্চার ছিলেন তেমনি সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁদের অবদান ভুলে যাওয়া মানে চূড়ান্ত অবিমৃষ্যকাবীতার পরিচয় দেওয়া।
যে কথাটি বলে এই প্রবন্ধটি শেষ করব তা হল ‘আশুতোষ ভট্টাচার্য’ মহাশয় রচিত প্রবন্ধে বিদ্যাদাগর সর্ম্পকিত মূল্যায়ন প্রসঙ্গে যে কথা তিনি বলেছেন তা দিয়ে। বাংলা ভাষায় সার্থক প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। তাঁর কথাতেই বলি – রামমোহন রায়ের প্রবন্ধের মধ্যে যে সব গুনের অভাব ছিল, এই দুজনের রচনায় সে অভাব পূর্ণ হয়ে গেল…. দেবেন্দ্রনাথ এবং ঈশ্বরচন্দ্র তাঁদের রচনাকে যথার্থই প্রবন্ধ রূপে প্রথম সার্থক্তা দান করলেন। এই হলেন বিদ্যাদাগ্র। তাঁকে প্রণাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।