সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৪)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ৪

৯ই মার্চ
কৃষ্ণচূড়া দিয়ে কি প্রােপােজ হয়? ফুল দিয়ে যে প্রোপােজ হয় আমি তাই জানতাম না । অরণ্য আমায় জানিয়েছিল। অরণ্য ছিল আমাদের পাড়ার আইকন । মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছিল । একদম ফাস্ট-সেকেন্ড হয়নি, কিন্তু দশ বা বারাে ওর র্যাঙ্ক যাই হােক না কেন, কাগজের দু নম্বর পাতায় একটা ছবি বেরিয়েছিল। ছবিটা বেরনাের পরেই ও সারা পাড়ার কাছে হিরাে হয়ে যায় । আর সেটা খুব এনজয় করত অরণ্য । ওর একটা ধারণা হয়েছিল যে ও যেহেতু মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করেছে তাই ওর যাকে যা খুশি বলার অধিকার জন্মে গেছে । অরণ্য একবার আমাকে একটা গলির মুখে সাইকেল থেকে নামতে বলেছিল । – নামব কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম । – আমি বলছি বলে । অরণ্য উত্তর দিয়েছিল ।
আমার মনে হয়েছিল কোন মহারাজ এসেছেন রে, বলছে বলেই আমায় নামতে হবে । কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আমি নেমেও গিয়েছিলাম । আর অরণ্য আমার হাতের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল দুটো লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া ফুল। —কৃষ্ণচূড়া দিচ্ছ কেন? আমাদের বাড়ির সামনেই কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে তাে। আমি বলেছিলাম। অরণ্য একটা বিজ্ঞের হাসি হেসে বলেছিল, আর পাঁচজন গােলাপ দিয়ে প্রােপােজ করে কিন্তু আমি পাঁচজনের থেকে সুপিরিয়র তাই আমার প্রোপােজ করার স্টাইলটাও তাে আলাদা হবে। সেজন্যই কৃষ্ণচুড়া দিয়ে প্রোপােজ করলাম। কেন কৃষ্ণচূড়া, কী জন্য প্রােপােজ, আমি কোনাে উত্তর পাইনি । মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল । কিন্তু অরণ্যর সামনে থেকে চলে এলেও কৃষ্ণচূড়া ফুলদুটো হাত থেকে ফেলে দিতে পারিনি ।
অরণ্যের মত ছেলেকে রিজেক্ট করতে পারে কে? মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড করে যে হায়ার সেকেন্ডারিতেও স্ট্যান্ড করবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে? তার ভেতরেই আমাকে প্রােপােজ করল। কিন্তু এইসব চক্করে পড়ে এবার ওর যদি রেজাল্ট খারাপ হয়ে যায়? সারারাত আমি ভাবতে লাগলাম। মনে হল, অরণ্যকে, না বলে দেওয়া উচিত। তা হলেই আবার একবছর পরে কাগজের দু’নম্বর পাতায় ওর ছবি বেরােবে । এইসব মাথায় বুজগুড়ি কাটছিল বলেই দিন চারেক পরে অরণ্যকে রাস্তায় দেখে, আমি ওকে ডাকতে শুরু করি, অরণ্যদা, ও অরণ্যদা ।। অরণ্য একটু পিছিয়ে এসে বলে, এখন থেকে আমায় আর দাদা বলে ডাকবে না তুমি। আমি তােমায় প্রােপােজ করেছি । – কিন্তু আমি তাে তােমায়, না বলার জন্য ডাকছিলাম । – অ্যাাঁ! অরণ্য চমকে উঠল ।। – আমি যদি তােমাকে এখন হ্যাঁ বলে দিই, তাহলে তােমার আমার প্রেম হয়ে যাবে আর প্রেম হলে তােমার রেজাল্ট খারাপ হবে। তােমার রেজাল্ট খারাপ হলে তােমার আর কাগজে ছবি বেরােবে না। তােমার ছবি না বেরােলে আমাদের পাড়ার নাম খারাপ হবে। আমি তাই তােমাকে, না বলতে এসেছি। – কিন্তু আমাকে তাে কেউ রিফিউজ করে না।অরণ্য আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল। আসলে অনেকদিন ‘না’ শব্দটার সঙ্গে কোনাে যােগ ছিল না বলে, ও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল আমার কথায়। ওর মনে হয়েছিল জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই ওর জন্য ‘হ্যাঁ’ হয়ে আসবে। আমি একইভাবে বলেছিলাম, আমি তাে করছি । – তুমি কিচ্ছু বােঝাে না । তােমায় আমি যেরকমভাবে বলছি, তুমি সেরকমভাবেই চলবে তােমার অত কিছু শার্প মাথা নয় যে নিজের ডিসিশন নিজেই নেবে।
– বা রে, নিজের ডিসিশন তাে নিজেকেই নিতে হয়। সে যার মাথা যেমনই হােক। আর তাছাড়া তুমি অন্যের মাথার শার্পনেস মাপতে পারাে নাকি? তুমি কি সাইন্টিস্ট? তুমি আমায় প্রােপােজ করেছিলে কিন্তু আমি অ্যাক্সেপ্ট করতে পারলাম না। সরি। বলেই আমি একছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম ওর সামনে থেকে ।।
অরণ্যর রেজাল্ট হায়ার সেকেন্ডারিতে অত ভালাে হয়নি। কাগজে ছবি ওঠেনি ওর । তবে ইঞ্জিনিয়ারিঙে চান্স পেয়ে গিয়েছিল । মাঝেমধ্যে বাড়িতে ফিরত। সেরকমই একদিন ও আবার আমাকে ধরে । পাড়ায় একটা ফাংশান ছিল সেদিন। আমি প্যান্ডেলের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি সামনে নড়ে উঠতে চমকে উঠি । তারপর খেয়াল করি যে ওটা অরণ্য ।।
– দেখলে তাে, তুমি না বললে বলেই আমার খারাপ হল ।
আমি কিছু না বলে অরণ্যর চোখের দিকে তাকালাম, কী খারাপ হল?
আমি র‍্যাঙ্ক করতে পারলাম না ।
– তার জন্য বুঝি আমি দায়ী?
– অবশ্যই । তুমি যদি রাজি হয়ে যেতে তাহলে আমি বেশি কনসেনট্রেট করতে পারতাম । তুমি ‘না’ বললে বলেই আমি তােমার কথা ভাবতাম আর ভাবতে ভাবতে প্রিপারেশনে ঘাটতি থেকে গেল, রেজাল্ট খারাপ হল ।
কথাটা বলেই অরণ্য আমার সামনে থেকে সরে গেল । আর আমার ভেতর সেই যন্ত্রণাটা ফিরে এল । আমি যে পর্ণার ডায়েরি পড়া ইস্তক জানি, অন্যের সঙ্গে যা হয় তা আসলে নিজের সঙ্গেই হয়। মনে হল যেন আমিই স্ট্যান্ড করতে পারিনি এইচএস পরীক্ষায় । সেই খারাপ লাগাটা নিয়ে অনেকদিন ছিলাম আমি । তারপর একদিন কলকাতায় অরণ্যর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ।
সেটা প্রায় দেড়বছর পরের কথা। আমি গিয়েছিলাম পিসির বাড়ি ক’দিন থাকতে । একদিন বিকেলে তেলেভাজা কেনার জন্য রাস্তায় বেরিয়েছি দেখি আকাশটা ভীষণ কালাে হয়ে এসেছে। যেন এক্ষুনি পৃথিবীর সব বৃষ্টি এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে উত্তর কলকাতায় । আমি একটু থমকে দাঁড়িযেছি হঠাৎ চোখে পড়ল আমার উল্টোদিকের ফুটপাথেই দাঁড়িয়ে রয়েছে অরণ্য। ও আমাকে দেখে রাস্তা ক্রস করে এগিয়ে এল । আর আগের কোনাে প্রসঙ্গ না তুলে আমার হাতটা ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, সুলগ্না আজ আমাকে একটা চুমু খাবে?
অরন্য কি কবিতা লেখে? এটা কি কোনাে কবিতার লাইন? আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, কথাটা শুনে ।
অরণ্য বলল, আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হােস্টেল কাছেই । আমি এখানেই থাকি ।
আমি ওকে একবার জিজ্ঞেস করব ভাবলাম, একটু আগে কী বললে আমাকে? কিন্তু আমার এত লজ্জা করতে লাগল, কিছু বলতে পারলাম না। মনে হল এই বৃষ্টিও কি আমার মতাে বিশ্বাস করে যা অন্যের তাই আসলে নিজের? অরণ্য যেটা চাইল সেটা না পেলে বৃষ্টি নামবে না? অরণ্য আমার দিকে কী চোখে তাকাল, মনে হল, চারদিকে নীল, হলুদ সব ফুল ফুটে উঠছে। বরফের গুঁড়াে ভেসে বেড়াচ্ছে হাওযায় । যেরকম আমি টিভিতে দেখেছি হলিউডের সিনেমায় । আর হঠাৎ করে টের পেলাম, তেষ্টায় আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। সেই অসম্ভব তেষ্টা মেটানাের ক্ষমতা আছে একমাত্র অরণ্যেরই । আমি অরণ্যের মুখের দিকে তাকালাম । একটা বাজ পড়ল একটু দূরে কোথাও। ওই গলির মুখ থেকে একটু ভিতরে ঢুকে অরণ্য দু’হাতে আমার মুখটা ধরে ওর মুখটা নামিয়ে আনল । আমি আমার ঠোঁটের মধ্যে ওর ঠোঁটের, ওর জিভের, ওর তাপের স্পর্শ পেলাম । অসম্ভব ভালাে লাগতে লাগল । আর কে আমাদের দেখছে না দেখছে তাই নিয়ে একটুও ভয় করল না। সেই মুহূর্তে আকাশ ঝমঝমিযে একটা কিছু নেমে এল আমাদের দুজনের মধ্যে, আমাদের দুজনের ভেতরে, আমাদের দুজনের চারপাশে। সেটা শুধু বৃষ্টি নয় । ….
সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে আমি বিড়বিড় করছিলাম, তুমি আবার আমার দমবন্ধ করে দাও অরণ্য, আরাে একবার দমবন্ধ করে দাও আমার ।
ঠিক চব্বিশ ঘন্টার মাথায় সত্যি সত্যি যে দমবন্ধ হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি । হল, যখন পরদিন সন্ধ্যায় প্রায় একই সময়ে ওই গলির মুখে গিযেই দেখলাম, অরণ্য দাড়িয়ে আছে আর ওর ঠিক পাশেই একটা মেয়ে । মেযেটা যে দেখতে বিরাট কিছু সুন্দরী তা নয় কিন্তু চেহারায় একটা উদ্ধত স্মার্টনেস । সেই স্মার্টনেসটা তখনও কলকাতার তিরিশ কিলােমিটার দূরে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়নি।
অরণ্য মেয়েটাকে দেখিয়ে আমায় বলল, দিস ইজ অদ্রিজা এন্ড ইউ নাে হু শি ইজ? শি ইজ মাই গার্লফ্রেন্ড । আমি প্রথমে ভাবছিলাম, অরণ্য হঠাৎ করে ইংরেজিতে কথা বলছে কেন? কিন্তু কথাটা শেষ হতেই আকাশটা যেন ভেঙে পড়ল আমার মাথায়। আর আকাশ যখন ভাঙে তখন সে ভাষার তােয়াক্কা করে না। কিন্তু তাহলে কাল বৃষ্টির মধ্যে অরণ্য আমার সঙ্গে যেটা করছিল সেটা কী ছিল?
সমস্ত জিজ্ঞাসাটাই হয়তাে আমার চোখে ফুটে উঠল । অরণ্যর দিকে তাকাতেই অরণ্য বলে উঠল তুমি ভাবছ তাে, তােমার সঙ্গে কাল যা হল তা কেন হল? ওটা পানিশমেন্ট । আমি তােমায় শাস্তি দিলাম । আর কেন দিলাম বলাে তাে?
– আমি কী করে জানব? আমি বােকার মতাে বললাম।
– আমি আগেও একবার তােমায় বলেছিলাম। তােমার জন্যই আমার রেজাল্ট খারাপ হযেছে । আমি যাদবপুরে চান্স পাইনি। আবার ন্যাকা সাজছ, জানাে না। বলে। শােনাে, আমি অরণ্য সেন, আমার সঙ্গে কেউ অন্যায় করলে তাকে আমি ছাড়ি না ।
ওর পাশে দাঁড়ানাে মেয়েটা হেসে উঠল ।
আমি তাকালাম মেয়েটার হাসির দিকে । কী শাস্তি দিয়েছে অরণ্য আমাকে, ও কী জানে? আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমি চিৎকার করে বলি, অরণ্য আমাকে চুমু খেয়েছে কাল। যে চুমু তুমি ভাবাে ও শুধু তােমাকেই খায় সেই চুমু আমাকেও খেয়েছে। আমার জিভের ভেতরে, আমার ঠোঁটে এখনাে সেই চুমুর স্পর্শ লেগে আছে। কিন্তু আমার গলা দিয়ে একটাও আওয়াজ বেরােল না । একবার মনে হল অরণ্যর ওই চুমুটাই আমার গলায় আটকে আছে । আটকে থাকবে সারা জীবন । সেই চুমুটা সঙ্গে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তেও পেছন থেকে ওদের হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম । ওরা হাসছে আমাকে নিয়ে । অরণ্যর প্রেমিকা, অরণ্য অন্য কাউকে চুমু খেয়েছে বলে, গর্বিত হয়তাে বা। দৌড়তে দৌড়তে পিসির বাড়িতে এলাম। নিজের ওপর লজ্জায় বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে দাঁডিযেই রইলাম । কিন্তু কিছুতেই তাপ কমল না গাযের । রাতে খেতে পারলাম না । বিছানায় শুয়ে ঘুমােতে পারলাম না । ছটফট করতে লাগলাম । যে চুমুটা আমার কাছে পৃথিবীর প্রথম অলৌকিক, যে বৃষ্টিটা ওই চুমুটাকে বাঁধিয়ে রাখার জন্যই যেন তৈরি হয়েছিল সেই চুমুটা অরণ্যের কাছে প্রতিশােধ মাত্র? আনন্দ তবে চুমুতে হয় না, বৃষ্টিতে ভিজলে হয় না, আনন্দ তাই যা মানুষের ওপর প্রতিশােধ নিতে পারলেই মানুষের সবথেকে বেশি করে হয়?…

ক্রমশ…

 

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।