সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৯)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ৯

২০শে অগাস্ট
পরদিন ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে আর আমার সামনে লেবু চা এগিয়ে দিল যে লােকটা তাকে এর আগে দু’বার মাত্র দেখেছি। একবার শৌনকের বন্ধুদের পার্টিতে আধঘন্টার জন্য, আর একবার আমার বৌভাতে, মিনিট দশেকের জন্য। রণজয় গুহ, আবৃত্তি করে, সঙ্গে আরও কী সব ব্যবসা ট্যবসা আছে || আমার বিয়েতে নিজের নতুন সিডি দিয়েছিল রণজয়দা । আমি রণজয়দার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি? – তুমি কী ভেবেছিলে, অমিতাভ বচ্চন তােমাকে উদ্ধার করবে? – আমায় কেউ উদ্ধার করুক, আমি চাইছিলাম না । – তুমি কি পুরাে পাগল হয়ে গেছ সুলগ্না? – আমি যে কিছুটা হলেও পাগল এটা আপনি জানলেন কী করে? – এটা সারা কলকাতা শহর, শুধু কলকাতা কেন, পৃথিবী জানে । লােক ডেকে ডেকে শৌনক বলে বেড়াচ্ছে। তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। কিন্তু তুমি একটা ভাঙা কাঁচ নিয়ে রাত্রি দেড়টার সময় পার্কস্ট্রিটে…. – তারপরও আমাকে নিয়ে এলেন কেন? – আনলাম কারণ পাগলদের সঙ্গ আমি পছন্দ করি। সারাদিন যারা চাল-ডাল-তেল-নুনের হিসেব করছে, কাজের লােক কামাই করলে মাইনে কাটছে, তাদের সঙ্গে থাকা সম্ভব? – আপনাকে যখন আমি ফোন করেছিলাম রণজয়দা, তখন কিন্তু আপনি পরে ফোন করব বলে আর করেননি। – করা হয়নি কারণ আমি আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলনে গিয়েছিলাম, তারপর ওখান থেকে কানাডাতেও ঢু মারলাম। ফিরেছি দিন দশেক হল । আর এসেই শুনলাম… – কী শুনলেন, আমি খুনি? – শৌনক এত কথা কেন বলছে বলাে তাে তােমার সম্বন্ধে? – হয়তাে নিজেকে ক্লিয়ার রাখতে চায়, আর তাছাড়া ও তাে ভুল কিছু বলছে না। আমি সত্যিই ওকে মার্ডার করতে গিয়েছিলাম। তবে তার পিছনে কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না । – তাহলে? – আমি একটা ওষুধ খাই। একটা সাইক্রিয়াটিক ড্রাগ। বেড়াতে গিয়ে সেটা দুদিন না খেতেই… – বুঝতে পারছি । – ওষুধটা কালকে রাতেও খাইনি জানেন। কিন্তু আপনার ভয় নেই আমি আপনাকে মার্ডার করব না।
রণজয়দা হাে হাে করে হেসে উঠল, আচ্ছা তুমি আমাকে ফোন করেছিলে কেন? – আমি শৌনকের কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করেছিলাম আমার ভিউ পযেন্টটা বলবার জন্য। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমি সত্যি সত্যি কথা বলতে চাইছিলাম কারণ আমি আপনাকে সবটা বলতে পারি, আমার মনে হয়েছিল । – ইন্টারেষ্টিং । তুমি চা টা খাও আমি আসছি। আমি চা খেয়ে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলাম রণজয়দা বসে আছে আমার জন্য টোস্ট আর ওমলেট সাজিয়ে। – আপনি তাে বেশ গিন্নি! – ভুলে যেও না আমার একবার বিয়ে হয়েছিল; আমি সংসারের অনেক কাজ জানি। কিন্তু সে প্রসঙ্গ থাক, তুমি বলাে তুমি কেন আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলে? – আপনি আমাকে একটা সিডি দিয়েছিলেন আমার বৌভাতের দিন । মনে আছে? – হ্যাঁ। আমার লেটেস্টটা । একদিকে রবীন্দ্রনাথ, আর অন্যদিকে আধুনিক কবিরা। – আমি ওই সিডিটা নিয়ে গিয়েছিলাম কেরালায় । আমাদের ফার্স্ট হানিমুনে । দুর্ঘটনা বা ঘটনা যাই বলুন, সেকেন্ডটায় ঘটেছিল। – আই সি। তা সিডিটা ওখানে গিয়ে শুনলে? – ওখানে সবকিছু খুব নেচার ওরিয়েন্টেড বলে ঘরে টিভি সাধারণত থাকে না । কিন্তু আমাদের ঘরে ছিল। আমি টিভি দেখতাম না । কিন্তু আপনার সিডিটা শুনেছিলাম ডিভিডিটায় লাগিয়ে । আর তারপরই আমার সব কিছু পাল্টে গেল । – একটু খুলে বলবে? – বলছি। আপনি জানেন তাে লােকে বলে আমি সুন্দর দেখতে? – শুধু লােকে বলে না, আমিও বলি । কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছ? – প্রশংসা শােনার জন্য না । আমি আসলে বােঝাতে চাইছি ছেলেদের সঙ্গে আমার ডিপ কোনও ইন্টারঅ্যাকশন কখনাে ঘটেনি । তাই যখন আপনার বন্ধুর সঙ্গে হানিমুনে গেলাম, তখন আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম, কিন্তু একইসঙ্গে কোনাে এক্সপিরিয়েন্স ছিল না বলেই আসল সময় কীরকম ফ্রিজিড হয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথম রাত্রে ও কাছে আসার চেষ্টা করল, আমি সাড়া দিতে পারলাম না। দ্বিতীয় দিনও একই ব্যাপার হল । শৌনক খুব রেগে যাচ্ছিল। এত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে অথচ…. – টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে বলছিল?
– হুম! কিন্তু সেটা তাে সত্যিই খরচ হচ্ছিল । দিনে বারাে-তেরাে হাজার টাকা। শুনে আমার খুব খারাপ লাগছিল । কিন্তু আমি ওর ছোঁয়ায় গুটিযে যাচ্ছিলাম । কী করতাম বলুন? – তারপর? – একদিন ভােরে ও ভীষণ রাগ করে বেরিয়ে গেল জানেন । আর ও বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি খুব কাঁদলাম, হাত থেকে বিয়ের আংটিটা খুলে দেখলাম হাতটা একদম ন্যাড়া। ভাবলাম যা এত বিশাল তা কি আবার এতটাই তুচ্ছ? আংটিটা খুলে নিলেই, শরীরে শরীর না মিললেই কিছু নেই? এবার কাঁদা আর কাঁহাতক যায়, সঙ্গে আনা জিনিসগুলােই ঘাঁটছিলাম । আপনার সিডিটা হাতে আসতে কী মনে হল, ডিভিডিতে ভরে দিয়ে শুনতে লাগলাম । আপনি একটা একটা করে কবিতা বলতে থাকলেন আর আমার কান-মাথা ঝাঁঝাঁ করতে শুরু করল, শরীরে তােলপাড় আরম্ভ হল । আমি আপনাকে বােঝাতে পারব না । – আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, তুমি কী বলছ! – সত্যি বলছি রণজয়দা। প্রত্যেকটা শব্দ, আমি আলাদা করে এখন কবিতাগুলাের কথা মনে করতে পারছি না কিন্তু প্রত্যেকটা শব্দ, আমার ভেতরে এমনভাবে আসছিল যে মনে হচ্ছিল আপনার গলা থেকে বেরিযে শব্দগুলাে আমাকে আদর করছে । – আমাকে কেউ কখনাে এভাবে বলেনি । – আমি এভাবেই ফিল করেছি । শব্দগুলাে এত কাঁপিয়ে দিল, এত জাগিয়ে দিল আমাকে সেদিন, শৌনক ঘরে ফিরে আমার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে । ও আমার দিকে এগিয়ে এল, আমি ওর দিকে তাকালাম । আমার মাথায় তখন ওই শব্দগুলাে ঘুরপাক খাচ্ছে | শৌনক আমাকে গভীরভাবে চুমু খেল। অ্যান্ড আফটার দ্যাট, সাবওয়ে দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করল । একটা ঘূর্ণি শুরু হল রণজয়দা। সেই ঘূর্ণিটা পৃথিবী উড়িয়ে নিয়ে গেল । শুধু মধ্যিখানে আমরা দুজন একদম স্থির হয়ে থাকলাম । আর আমাদের সেই প্রথম ইন্টারকোর্সের সময়ে আমি সারাক্ষণ বিড় বিড় করে আপনার আবৃত্তি করা কবিতাগুলাে বলছিলাম জানেন । আপনার বলা শব্দগুলাে আমি রিপিট করছিলাম । শৌনক কিছু বুঝতে পারেনি। ও অসম্ভব আনন্দ পাচ্ছিল । আনন্দ তাে আমিও পাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার মাথায় সারাটা সময় আপনার গলার আওয়াজটা ঘুরছিল । – তােমার হানিমুনটা কি শৌনকের সঙ্গে হযেছিল, না আমার সঙ্গে? – সে বিচার আপনি করুন । কিন্তু শৌনকের সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ওই কথাটা মনে পড়তে আমি ভাবলাম যে একবার আপনাকে ফোন করতে পারি । তাই… রণজয়দা আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, এত বড় কমপ্লিমেন্ট, এতাে বড় পুরস্কার, আমার জীবনে কখনাে পাইনি। আমি একটা চুমু খেতে পারি তােমাকে সুলগ্না? – এখন থাক রণজয়দা । এখন সেই মুড নেই আমার ।
রণজয়দা সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে বসল । জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন যাবে কোথায়? – আমি জানি না। হয়তাে ওই বন্ধুর বাড়িতেই, যেখানে এখন আছি। কিন্তু সে একটি ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। আর তাদের শয্যাদৃশ্যের সাক্ষী হতে আমার ভালাে লাগে না। একাকীত্বটা আরাে বেশি করে গলা চেপে ধরে । – তুমি এখানে থেকে যেতে পারাে না, সুলগ্না? – থাকতে পারলে খুব ভালােই হত। কিন্তু কোন অধিকারে থাকি বলুন তাে? – শব্দের অধিকারে । রণজয়দা আমার দিকে তাকাল । – মানে? – আমি তােমাকে ফোর্স করছি না । কিন্তু ভাবাে, এই যে আমরা বিয়ে করি, মন্ত্র পড়ি, ‘যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম’, এগুলাে কী সুলগ্না? শব্দই তাে । শব্দের বন্ধনেই একটা মানুষ আর একটা মানুষের হয়ে যায়।তুমি তাে শব্দের বাঁধনে অনেক আগেই আমাকে অনুভব করেছ। তুমি থাকতে পারাে
আমার সঙ্গে? – আপনি তাে শব্দের বাঁধনে আগে একবার একজনের হয়েছিলেন। – হযেছিলাম। কিন্তু থাকতে পারিনি । প্রকৃতি মেয়ে খারাপ ছিল না কিন্তু প্রত্যেকটা ব্যাপারে অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইত আমাকে । ওর অনেক ভালাে গুণ ছিল, ভীষণ ডিসিপ্লিনড ছিল । কিন্তু আমার সবকিছুতেই ও খুঁত ধরতে শুরু করল । কীভাবে খাব সেটা ও ঠিক করে দেবে, আমি আগে তরকারি নিয়ে পরে রুটি নিলে, কোথায় ভুল হচ্ছে বলবে; আমি যদি ওয়াশিং মেশিনে শাড়ির ওপরে প্যান্টগুলাে রাখি তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলবে । আমি না ওই ক্লাসরুমের মধ্যে থাকতে পারছিলাম না জানাে। ও মিলিটারি কায়দায় সংসার করতে চাইছিল, আর আমি চাইছিলাম এমন একটা কিছু যেখানে আকাশটাকে আর একটু ফিল করা যায় । ঘড়িটাকে চাইলে বন্ধ রাখা যায় । কিন্তু প্রকৃতি সেটা মানতে পারত না বলে অশান্তির পারদ চড়তে লাগল। আমি অশান্তি নিতে পারলাম – কিন্তু আমি তাে একজন মেন্টাল পেশেন্ট । – মেন্টাল পেশেন্ট আমরা কে নই সুলগ্না? তুমি চলাে তাে আমার সঙ্গে । অনেক ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়েছে। আবার পরে এসে খাবে । – আমাকে টোস্টগুলাে শেষ করতে দিন অন্তত । – পরে শেষ করবে । চলাে এখন আমার সঙ্গে। রণজয়দা আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল । গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গিযে, কী ভেবে, রাস্তায় বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল। ট্যাক্সিতে মিনিট পনেরাের মধ্যে আমরা একটা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছলাম । ভেতরে ঢুকে দেখলাম নানা বয়সী অজস্র নারী-পুরুষ, একসঙ্গে একটা মন্ত্র বলে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ কান পেতে শুনেও আমি মন্ত্রটা ধরতে পারলাম না । রণজয়দার দিকে তাকালাম । রণজয়দা জিভটা এমন করে কথাগুলাে বলতে লাগল যে পরিষ্কার হয়ে গেল । নাম মে হাে রেঙ্গে কিযে … নাম মে হাে রেঙ্গে কিয়াে । – এটা কি রণজয়দা? আমি জিজ্ঞেস করলাম । – এটা বুদ্ধের মন্ত্র । বসাে আমার পাশে । মন্ত্রটা উচ্চারণ করাে। রণজয়দা শান্ত গলায় বলল । আমি বসলাম কিন্তু কিচ্ছু উচ্চারণ করতে পারলাম না । ঈশ্বরে আমার তেমন কিছু বিশ্বাস ছিল না । আবার অবিশ্বাসও নয় । আসলে ঈশ্বর আদৌ আছেন কি না, থাকলে কী করছেন, সেই প্রশ্ন বহুদিনই তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না আমার কাছে । হঠাৎ করে এই মন্ত্রগুলাে কেন আমাকে দিয়ে বলাতে চাইল রণজয়দা আমি জানি না। কিছুক্ষণ পর ক্লাস শেষ হয়ে গেলে যে যার মতাে বেরিয়ে গেল । রণজ্যদা দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে আবার আমাকে নিয়ে ট্যাক্সি চাপল – এখানে কেন নিয়ে এলেন আমাকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম । – তােমার মনটা এখন একটু শান্ত লাগছে না? রণজয়দা পাল্টা প্রশ্ন করল । – মন্ত্রে কি মন শান্ত হয়? রণজযদা হাসল, হাজার বছর কিংবা আরাে বেশি সময় ধরে, এই একই মন্ত্র, একভাবে, কত লােক বলে যাচ্ছে। কোথাও কিছু পরিবর্তন হচ্ছে না । – কিন্তু মানুষের জীবন তাে প্রতি মুহুর্তে পাল্টাচ্ছে । – তার জন্যই তাে যা একেবারে পাল্টাচ্ছে না, তার একটা সাপাের্ট আমাদের চাই সুলগ্না । – আপনি কি খুব আস্তিক? – আস্তিক না নাস্তিক জানি না । কিন্তু আমি কোথাও কিছু একটা ধরতে চাই সুলগ্না । তুমি চাও না? ট্যাক্সির জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম সূর্যটা গনগনে হয়ে উঠেছে । সেই কুমারাকোম, সেই সকাল, সেইসব কবিতা, সেই সিডি, সেই শব্দগুলাে, আমার পাশে পাশে ঘুরছে। বললাম, আমি বন্ধ ঘরের মধ্যে খুব ভয় পাই রণজয়দা, আবার একটা সংসার … আবার হয়তাে আমার হাতে কিছু উঠে আসবে । – তােমার শুধু ঘরেই ভয়? রণজয়দা আমার দিকে তাকাল। – ঘরে ভয়। সম্পর্কে ভয় । আমি গলা নামিয়ে বললাম। – তােমাকে আমি কোনাে সম্পর্কে বাঁধতে চাই না। আর তােমার ঘরে ভীষণ ভয় বলছ, আচ্ছা আমি যদি তােমাকে একটা জানলা দিই সুলগ্না? তুমি নেবে?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।