সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৮)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ৮

১৪ই অগাস্ট

এই সময় আবিরার সঙ্গে ‘স্বয়ম’ বলে একটা সংস্থায় গিয়েছিলাম; আবিরাই নিয়ে গেল । ওর দুঃসময়ে ওরা খুব হেল্প করেছিল । মেয়েদের ওপর হওয়া হিংসা প্রতিরােধের লক্ষ্যে ‘স্বয়ম’ কাজ করে । ওখানে গিয়ে দেখলাম কত মহিলা বসে আছেন, কারাে গলায় কাটা দাগ, কারাে হাত ভাঙা, পারিবারিক কত অত্যাচারের শিকার সবাই; কিন্তু আমি এখানে কী করব, আমি তাে নিজেই হিংসা নামিয়ে এনেছি পরিবারে। তাহলে আমি হিংসার শিকার কীভাবে? ওখানকার কাউন্সিলররা আমাকে ভরসা দিলেন, বললেন, আপনার সঙ্গে যা হচ্ছে তা তাে একরকম ভাবে হিংসাই । আপনি তাে নিজের ইচ্ছেয় এইসব করেননি। আফটার অল, আপনি একজন পেশেন্ট। পাগলের সাতখুন মাপ । আমিও তাে আধপাগল। আমি মার্ডার চার্জ থেকে রেহাই পাব না কেন? আমি ‘স্বয়ম’-এ মাঝেমাঝেই যেতাম, গিয়ে দেখতাম নরক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে মেয়েরা আবার বাঁচার চেষ্টা করছে। আমার নিজের জীবনটা তাে আমি হারিয়ে ফেলেছি । তাহলে এখন আবার কোথেকে ফিরে পাই? শুনেছি সমুদ্র পিছিয়ে গেলে নাকি জমি জেগে ওঠে । এই নােনা জল সরে গিয়ে আবার একটা জমি জেগে উঠবে? যেখানে আবাদ করা সম্ভব? কে জানে! দিন কাটছিল দিনের মতাে। এর মধ্যেই ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেলাম একটা বাচ্চাদের স্কুলে । ওরা আমার ইতিহাস জানত না। মাইনে বেশি না হলেও কাজের স্যাটিসফেকশন ছিল। একদিন আমার ক্লাসে একটা মেয়ে, আর একটা মেয়েকে পেনসিল উঁচিয়ে মারতে গেল। আমি চুপ করে বসে রইলাম, মনে হল ওই মেয়েটাই তাে আমি; আমার বসে থাকার সুযােগ নিয়ে মেযেটা অন্য মেয়েটার ঘাড়ে পেনসিল ফুটিয়ে দিল। আমি তখন ছুটে গেলাম । পরে হেড মিসট্রেস আমায় ডেকে বললেন, আপনি দেখেননি? আমি বললাম, বাের্ডে কাজ করাচ্ছিলাম ।খেয়াল করিনি। ওঁর ঘর থেকে বেরিযে মনে হচ্ছিল, ইচ্ছে করেই ওই মেয়েটাকে বাধা দিইনি । নিজের একটা আয়না দেখছিলাম হয়তাে ওর মধ্যে । যে কোনাে আয়নায় পিছনের ছবি ফিরে ফিরে আসত । যখন গায়ে গা দিয়ে বসে থাকতাম শৌনকের সঙ্গে, ওর সঙ্গে বাজার করতে যেতাম, যখন আকাশটাকে আরও নীল, সূর্যটাকে আরও উজ্জ্বল লাগত, সেইসব ছবি চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠত। -আবারও জীবনটাকে পাল্টাতে হবে, আবিরা আমাকে বলত । ওর কথাতেই শৌনকের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার একটা উদ্যোগ নিলাম যাতে সবাই একতরফা কথা না শােনে । এই সব বন্ধুদের চোখগুলাে আমি আগে দেখেছি, দেখে মজা পেয়েছি। সবার চোখে কী তীব্র বাসনা আমার প্রতি। কিন্তু এখন যার ফোন নম্বর যােগাড় করে ফোন করি সেইই ব্যস্ততা দেখাতে শুরু করে । আমি দু-একজনের বাড়ি অবধি চলে গিয়েছিলাম; একজন দরজা খুলল না, আর একজন বসার ঘরে আমায় আধঘন্টা বসিয়ে রেখে বলল, এখন কথা বলার একটু অসুবিধে আছে, পরে একদিন আসবেন । বুঝে গেলাম, পৃথিবীটা আমার জন্য পুরােপুরি বন্ধ হয়ে গেছে । আর কোনাে দরজা আমার জন্য খুলবে না ।
তার মধ্যেই টের পেলাম আবিরা নিজের জীবনে রাজুকে একটা জায়গা দিতে চাইছে । কিন্তু রাজু তাে বিবাহিত, একটা মেয়ের বাবা। – তাতে কী হয়েছে? ওর সঙ্গে ওর বউয়ের বনছে না। তাই রাজু আর আমি একটা প্যারালাল জীবন শুরু করতে চাই। তার জন্য যে বিয়ে করতে হবে এমন তাে নয় । আমরা আমাদের দুজনের সুবিধে মতাে লিভ ইন করব । কী অসুবিধে তাতে? আবিরার কথায় অবাক হয়ে গেলাম । কিন্তু একটা সংসার ভাঙা, না ভাঙা, একসাথে দুটো সম্পর্ক রাখা, এটা নিয়ে আমি কি কিছু বলতে পারি? আমি তাে একজন ডেঞ্জারাস মহিলা অ্যাটেম্পট টু মার্ডার’এর জন্য যাকে জেলও খাটতে হতে পারে। আমার কোনাে ব্যাপারেই কিছু বলার এক্তিয়ার নেই । রাজু একদিন রাতে এল । আমার সঙ্গে একটু কথাও বলল । কিন্তু বুঝতে পারছিলাম রাজুর মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে। সেটা কি ও নিজের আর আবিরার সম্পর্কটাকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে বলে নাকি আমার ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন বলে? আমি পাশের কামরায় গিয়ে ছিটকিনি লাগিযে গান চালিয়ে দিলাম যাতে ওদের কথা আমার কানে না আসে; তবু ওই জেগে থাকা রাত্রে আবিরা আর রাজুর ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তগুলাে শব্দ হযে আমার কানে আছড়ে পড়তে থাকল । যে শব্দ আমার জীবনেও ছিল, কিন্তু এখন নৈঃশব্দে বদলে গেছে, সেই শব্দগুলাে যখন আবিরার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল আমি তার পিছনের আদরগুলাে বােঝার চেষ্টা করছিলাম । | আমি শৌনককে ছাড়া রাতের খাবার খেতে পারতাম না, ওকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমােতে পারতাম না । শৌনকের থেকে দূরে আছি বলেই কি ওদের ঘনিষ্ঠতায় কষ্ট হচ্ছিল আমার? না কি পাশাপাশি ঘরে থাকা দুটো মেয়ের মধ্যে একজন যা পাচ্ছে আর একজনেরও তা অনুভব করার ইচ্ছের মতাে স্বাভাবিক আর কিছু হতে পারে না? জানি না। শুধু বুঝছিলাম যে আবিরা আর রাজুর শরীর একে অপরের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। ওদের আনন্দ দরজা ভেদ করে আসছিল আমার কাছে। একদম একা আমার কাছে। রাজু তারপর থেকে আসতে থাকল । আমি একদিন বললাম আমার একটা নেমন্তন্ন আছে, আজকে আমি থাকব না । আবিরা আমাকে অত ভালবাসলেও আমি ওর আর রাজুর সঙ্গমের শব্দ, আদরের আওয়াজ থেকে একটা রাত অন্তত পালাতে চাইছিলাম। সেদিন সারা সন্ধে একা একা হাঁটলাম । বারবার মনে হচ্ছিল, এত কিছু কাগজে পড়ি, টিভিতে দেখি । মেয়েদের সঙ্গে এত অত্যাচার হয়, আমি তাে এখনাে এত সুন্দর দেখতে, আমাকে কেউ রেপ করতে আসবে না, হাত ধরে টানবে না, জিপে তুলে নেবে না কেউ? কই কিচ্ছু হচ্ছে না তাে। আমাকে দেখেই কি লােকে ভয় পাচ্ছে! ভাবতে ভাবতে জীবনে প্রথমবার আমি একটা নাইটক্লাবে ঢুকলাম । – আর ইউ অ্যালােন লেডি? – ইয়েস, আই অ্যাম অ্যালােন । আমি মিষ্টি করে হাসলাম। – ওকে, ইউ উইল গেট ইওর পার্টনার ইনসাইড। কাউন্টারের সামনের লােকটা বলল ।
ওর পাশে দাঁড়িয়ে একটা মস্ত চেহারার লােক আমাকে মাপছিল। ওই লােকগুলােকেই কি বাউন্সার বলে, কেউ কোনাে অসভ্যতা করলে ওরা তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়? আমার সঙ্গে কেউ অসভ্যতা করতে এলে ওরা যদি তাকে কিছু করতে যায়, আমিই বারণ করব । আমি তাে চাইছি কেউ আমার সঙ্গে কিছু করুক, নইলে আমার দাঁড়িপাল্লাটা সমান হচ্ছে না। একটা অদ্ভুত আলােআঁধারির মধ্যে ঢুকে গেলাম। ড্রিঙ্কস অর্ডার করলাম । এক পেগ… দু’পেগ… তিন পেগ… তাও নেশা হচ্ছিল না । আজকে ইচ্ছে করেই রাতে ওষুধ খাইনি । চাইছিলাম আজ আবার একটা ঘটনা ঘটুক | তবে এবার আমার সঙ্গেই।
আমি নিজেকে ডান্স ফ্লোরের দিকে টেনে নিয়ে গেলাম । নাচতে নাচতে টের পাচ্ছিলাম, শরীরের ভেতরে থেমে থাকা সব রক্ত প্রাণপণে ছুটতে চাইছে। ভবিষ্যতের দিকে, একটা কোনাে আশার দিকে। আমার সঙ্গে নাচতে এল একটা ছেলে । হ্যাঁ এই ছেলেটাকেই তাে আমি চাই । কিন্তু ছেলেটা পিছিয়ে গেল । একটা মেয়ে ওর কানে ফিস ফিস করে কীসব বলতে শুরু করল! আমি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাত ধরে টানলাম । মেযেটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শাট আপ! ইউ বিচ। এখানে এই ডান্স ফ্লোরেও কি আমায় চিনে গেছে সবাই? নাকি স্রেফ হিংসা থেকে বলছে মেযেটা? – লিভ মাই বয়ফ্রেন্ড । আই নাে হােয়াট টাইপ অফ গার্ল ইউ আর । বলতে বলতে মেয়েটা আমার থেকে টেনে নিয়ে গেল ছেলেটাকে ।। কী হয়ে গেল সেই মুহুর্তে, আমি একটা মদের বােতল আছড়ে ভাঙলাম । তারপর ওই বােতলের অর্ধেকটা হাতে নিয়ে সামনে তাকালাম | না, আমার একবারও বােতলের কানাটা নিজের পেটে ঢুকিযে সুইসাইড করতে ইচ্ছে হল না । বললাম, ইউ নাে নাথিং । আই অ্যাম এ মার্ডারার। বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম । বােতলের অর্ধেকটা নিযেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল; থেমে গিয়েছিল বাজনা, নাচ গান । বাউন্সার দুটো আমায় ফলাে করছিল, দেখলাম। পাত্তা দিলাম না । আপনমনে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম । কটা বাজে? দেড়টা? দুটো? আমি পার্ক স্ট্রিটের মােড়ে দাঁড়িযে ওই আধভাঙা কাঁচের বােতলটা নিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ইয়েস আই হ্যাভ কাম হিয়ার টু মার্ডার এগেইন। ঠিক তখনই আমার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ির মধ্যে থেকে যে বেরিয়ে এল বােধহয় তাকে আগে কখনাে দেখেছি, কিন্তু তখনই চিনতে পারলাম না । এই লােকটা কি আজকে রাতে আমার হাতে মার্ডার হতে চায়? ভাবনাটা দানা বাঁধার আগেই ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ল আমার গালে । মাথাটা ঘুরে গেল ।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।