সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে হেমন্ত সরখেল (পর্ব – ২)

তাপ – উত্তাপ

পর্ব – ২

হাতে মাত্র সতেরো দিন, অথচ আমার এগিয়ে চলা শূন্য | মন বসাতে পারছি না কিছুতেই | চোখের সামনে ভাসছে কালান্তক বাতাস, নিশ্বাসের হলকা, ঠোঁটে চেপে বসা তার অত্যুগ্রাহী ঠোঁট | অন্ধকারে নির্বসনা, দুটো হাতে আমায় ময়ালের বেষ্ঠনিতে… উফ্ !! এভাবে সম্ভব না, কিছুতেই না। উদভ্রান্তের মতো ছিটকে বেরোলাম ঘর থেকে | মা’কে হতবাক রেখে পেরিয়ে গেলাম উঠোন। শুনলাম পেছন থেকে, ‘অ্যাতো রাতে আবার কোথায় যাস ?’
সিট পড়লো গাঁদিমারা কলেজে | জানতাম, অ্যাতোদিনের সব সুনামের সর্বনাশ আসন্ন | অতি ভয় নীতিহন্তারক | আমার ক্ষেত্রেই বা তার অন্যথা হবে কেন! প্রতিটা সিটিং-এর আগের রাতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শব্দযোজনে তৈরি হল চোতা | পরিচ্ছদের গোপন অংশদের চিনতে শিখলাম নতুন করে, জীবনে প্রথমবার | গুঁজে নিয়ে নামলাম রণাঙ্গনে | জানতাম না, ইনভিজিলেটরেরা অভিজ্ঞতায় হারিয়ে দেবেন অনায়াসেই | প্রথম কমন প্রশ্নের উত্তরটা বাঁ হাতের ফোল্ডে | বের করতে গিয়ে, ধরা পড়ে গেলাম | তখন আর হলে কেউ লিখছে না | প্রতিটা দৃষ্টি নিবদ্ধ দণ্ডায়মান আমি’র গায়ে | আমাকে সেখান থেকে উঠিয়ে বসানো হলো টিচার্স রুমে | ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে অবান্তর শব্দের বোঝ তুলে দিয়ে আসলাম দ্বিতীয় ঘন্টার পর |
নির্ঝর স্বপ্নভঙ্গ করলো আমার | কলেজে খবরটা বাঁশপাতার আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো | বাড়িতে পৌঁছেছিল কিনা জানি না | জানার জন্য অপেক্ষাও করিনি আর। সে রাতের শেষ ট্রেনে আমায় ছাড়তে অজিত এসেছিল | আর যে পরীক্ষায় বসে লাভ হবে না এটা আমার থেকে ভালো আর কে জানতো! পালালাম যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে | স্টেশন ছাড়ার সময় গেটে দাঁড়িয়ে অজিতকে দেখছি। জানি,ও কী ভাবছে। ভাবছে, ‘পালাচ্ছে,ঐ পালাচ্ছে হাতিয়ারা কলেজের দাপুটে জি.এস., এলাকার জনপ্রিয় ওপেনার, ভরসাযোগ্য ডিফেণ্ডার,সফল ছাত্রনেতা,দরদী এক ছটফটে প্রতিবেশী,গরীব দম্পতির শেষ আশ্রয়স্থল,মেধাবী ছাত্রটা তার সর্বস্ব খুইয়ে |

এন.আর.এস. হসপিটালের সামনে প্রথম বাসটা যখন এল তখন পৌনে পাঁচটা | শান্তিপুর লোকালে আসা ফুলের মাসি’দের মধ্যে তিন চার জন সাথেই উঠলো | রিনরিনে ঠাণ্ডা ভোরের বাতাসে | যাত্রামুখী ডাবল সিটে জানলার পাশে চাদর মুড়ে নিদ্রাবিলাসী কোনো এক পুরুষ, পাশেই বসলাম | শিয়ালদা স্টেশনে রাত কাটিয়ে এবার রতন’দার কাছে,পূর্ব পুঁটিয়ারি | এখন বাউণ্ডুলে বখাটে’টাই সঠিক আশ্রয় | অনাথের ফেসিলিটি অনেক,যদি মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকে | চলতি বাসের দুলুনিতে সহযাত্রীর চাদরের তলার কোনো কঠিন বস্তু পাঁজরে ঠোকা মারছে বারবার | ‘স্যরি’- একটা ঘরঘরে কণ্ঠ এবার। তবে মুখ থেকে চাদর সরলো না | মাঝে মধ্যে চোখের সামনের চাদর সরিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে, হয়তো বা গন্তব্যের খোঁজ |
হাজরায় মাসিরা নেমে গেল। সামনের গেট দিয়ে উঠলেন দু’জন সি.পি., সাদা পোশাকেই চেনা যায় তাদের | পেছনের দিকে চলে গেলেন | বাসটা ছাড়তেই, একটু অধীর মনে হলো সহযাত্রীকে | এবার চাদর সরলো মুখ থেকে | বছর ত্রিশের হবেন | পেছনে তাকিয়ে দেখলেন কিছু | ফিরতি দৃষ্টিতে চাঞ্চল্য, নাকি ভয় ! বাসটা বেমক্কা ব্রেক মারতেই এতক্ষণ জাপটে রাখা একটা অ্যাটাচি পিছলে পড়লো পায়ের কাছে | সামনের রড ধরে আমি নিজেকে সামলালেও তিনি মুখ থুবড়ে সপাট হয়ে গেলেন | পেছন থেকে একজন ধমকে উঠতেই, ছিলে টানের মতো তীব্র গতিতে সিট ছেড়ে বাসের সামনের গেটে, চট করে রানিং-এ নেমে গেলেন সহযাত্রী | আরে! অ্যাটাচিটা রয়ে গেল যে!
কুঁদঘাট ডিপোতে বাস থেকে নামার আগে অ্যাটাচিটা নিয়ে নামলাম | ভরা,সেটা ওজনেই বোঝা গেল | পকেটে সাকুল্যে সাতাশ টাকা। পঞ্চাশ পয়সা এক ভাঁড় চা | তা-ই সই! হাঁটতে হাঁটতে রাম’দার দোকান | দেখি, বেঞ্চেই বসা ক্ষ্যাপাটা। হইহই করে উঠলো আমায় দেখে |
‘কী ব্যাপার গুরু? তুমি তো গাধার শিং, ডুমুরের ফুল, নাকচাবির নকশা ! মনে পড়লো আমায়? আরে! তোর পরীক্ষা চলছে না এখন? তুই এখন?’
‘থামবে? না এলেই ভালো হতো মনে হচ্ছে!’
‘আচ্ছা,আচ্ছা | এই রাম, আরেকটা চা বাড়িয়ে দে |’
‘তোর কাছে তিন টাকা আছে?বাড়ি ফিরে দিচ্ছি | আমার তো সেদ্ধ-ভাতে হয়ে যাবে, তুই এলি, দু’টো ডিম নিয়ে নিই |’ – চা খেতে খেতে রতন’দা বললো |
‘ওনার থেকে নেবে কেন? আমিই দিয়ে দিচ্ছি দু’জোড়া, আমায় আড়াই টাকা বিকেলে দিয়ে দিও, তবে, এটা যেন আবার চায়ের দামের মতো বাকি রেখো না!’- বলে উঠলো রাম’দা |
‘অ্যাঃ আড়াই টাকা ! কিনিস তো পোল্ট্রি ! পয়ত্রিশ পয়সা গোটা ! তার দাম সাড়ে বাষট্টি পয়সা ! ডাবল ? বিষ আছে ? বিষ ? দে, খেয়ে মরে যাই |’
‘আর আমার যে পুঁজি ফাঁসিয়ে রাখতে হয়,তার বেলা ? তোমাদের তো কেনা দামের থেকেও কম হলে ভালো হয় ! আমার চলবে কী করে, সেটাও ভাবো একবার !’
‘আচ্ছা,ঠিক আছে, দু’টাকা নিস, দে এখন চারটে |’
জং-ধরা লোহার টাঙানো ঝুড়িটায় হাত ঢুকিয়ে রাম’দা একবারে চারটে বের করে আনলো | কী বড়ো থাবা রে বাবা হাতের, একবারে চারটে এঁটে গেলো !
অ্যাটাচিটা ঘরের একমাত্র তক্তপোষের নিচে রেখে দড়িতে ঝোলানো গামছাটা নিলাম |
‘গামছা আনিসনি?’
‘কিছুই আনিনি | লুঙি দাও |’
‘তাহলে অ্যাটাচিতে কী ?’
‘বলছি, স্নানটা সেরে আসি |’
লুঙি দিল আলনা থেকে | দিয়ে উবু হলো স্টোভের সামনে | ‘কলতলায় বালতি আছে, উঠিয়ে ঢালতে হবে | মগ চুরি হয়ে গ্যাছে |’
আয়নাটা দাগ ধরে একসা | দেওয়ালের নোনা ওর চতুর্পাশে ঘনিয়ে এসেছে যেন | মাঝখানটায় মুখের ঝলক পেলাম | তেলচিটে চিরুণি | বাবুইয়ের বাসা পরিস্কার করতে করতে প্রতি দাঁড়ার মূলে জমাট বেঁধেছে নোংরা | ‘অলক্ষ্মী একটা!’ সহজাত শব্দ উঠলো মনে। পরক্ষণেই ভাবলাম, হোক না, তবুও মানুষ তো ! অন্যদের থেকে বেটার | নইলে নিজে বেকার হয়েও আমায় ঘরে আনে ? যদিও,এনার কর্মস্রোত আমার অজানা,তেমনভাবে আর সম্পর্কই বা গড়ে উঠতে দিয়েছি কোথায় ! প্রতিবেশী সুবলের মামার ছেলে, ওখানে গেলে বেশির ভাগ সময়টা কাটাতো আমার সঙ্গেই | ব্রেখট, রবীন্দ্রনাথ,মাইকেল,গুরু দত্ত,ভানু,সম্বরণ সব বিষয়েই অনর্গল | মন্দ লাগতো না, কোথা দিয়ে যে সময় কাটতো,টেরই পেতাম না | সবটা জানলে আবার লেজ মুটিয়ে ঘুরে বসবে না তো ? আর তো থাকার জায়গা আমার কাছে আপাততঃ নেই !
গতকাল সকালের পর চা ছাড়া কিছু পেটে পড়েনি | গরম একথালা ভাত,আলু-কাঁচকলা-ডিম সেদ্ধ কাঁচা সর্ষের তেল,কাঁচা লঙ্কা দিয়ে অমৃতসমান | খাওয়া শেষ করে নিজের থালাটা ধুয়ে ঘরে এলাম | বিছানাটা টানছে | দেওয়ালের দিকেই বালিশটা | রতন’দা বাসন মাজছে কলে | আর যা ই হোক, কোনোদিন খাওয়ার কষ্ট পেতে হয়নি বুড়ো মানুষটার কল্যানে | মন খারাপ করে লাভ নেই | জমাট আলকাতরার মতো ভবিষ্যত। দূর-দূরান্তে আলোর রেখা নেই | শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখ জড়িয়ে এলো |

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।