সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ২)

গ্যাস চেম্বার

পর্ব – ২

সুলগ্নাদির সঙ্গে মজার একটা স্মৃতি আছে আমার। মীরা মাসিমাদের দোতলার বারান্দা থেকে ও আমায় ডেকেছিল একবার । সেই গরমের দুপুরে সুলগ্নাদির ডাক যে কিরকম একটা হাতছানি হযে আমার কাছে এসেছিল, বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমাদের ওই মহল্লায় একতলা, দোতলা সব বাড়ি, টলটলে সব ঝিল, পরিছন্ন সব রাস্তা দেখে আমরা বড় হয়েছি। কলকাতা থেকে অত কাছে যে এমন একটা মধ্যবিত্ত স্বর্গ আছে, যারা থাকেনি তারা বিশ্বাস করতে পারবে না । কিন্তু সেই স্বর্গটা সল্টলেকের মতাে উন্নাসিক ছিল না । সেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি ঢুকে যেতে পারত কড়া না নেড়েই । আমি মীরা মাসিমাদের বাড়ি ঢুকে ওই আবছা অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে গিয়েছিলাম সুলগ্নাদির ডাকে । ওখান থেকেই সুলগ্নাদি আমায় দেখিয়েছিল পেছনে ঘােষদের বাগানে কী চলছে। ঘােষরা থাকত কলকাতায় আর তাদের বাড়ির পেছনের ওই বাগান বলা যায় সবার সম্পত্তি ছিল। কিন্তু সেদিন ছ’সাতটা হনুমান কোথেকে যেন লাফিয়ে নেমেছিল সেখানে আর একধারসে কলা সাবাড় করছিল। কিন্তু আমাদের চোখ আটকে গিয়েছিল ওদের অদ্ভুত কায়দায়। কলাগুলাে গাছ থেকে উপড়ে নিয়েই যাচ্ছে না, প্রথমে দুটো কলা নিয়ে দু’বগলে চেপে রাখছে আর তারপর একটা কলা নিয়ে খেতে শুরু করছে; সেই কলাটা শেষ হতেই বগল থেকে একটা কলা বের করে খােসা ছাড়িয়ে মুখে দিচ্ছে আর তৎক্ষণাৎ একটা কলা গাছ থেকে ছিড়ে এনে বগলের নীচে রাখছে । সুলগ্নাদি দৃশ্যটা আমায় দেখাবার সময় হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল, কী করছে বুঝতে পারছিস ? বগলে যে দুটো চেপে রাখছে সে দুটো যাতে সবসময় ফ্রেশ থাকে তাই টাটকা কলাটা ছিড়ে এনে বগলে রাখছে। আর বগলের কলাটা নিয়ে মুখে দিচ্ছে । ভেবে দেখ বুদ্ধি, যখনই কেউ তাড়া করবে তখনই তাে পালাতে হবে । পালাবার সময় দুটো কলা অন্তত সঙ্গে থাকে সেটা এনশিওর করে নিচ্ছে।
শুনে হেসে উঠলাম আমিও আর হাসতে হাসতে ভুলে গেলাম বাড়ির কেয়ারটেকারকে ডেকে সতর্ক করে দেয়া উচিত। (কেয়ারটেকার রামলাল পরে কী দুঃখই
করেছিল পুরাে এক কাঁদি পাকা কলা হনুমানে খেয়ে চলে যাওয়াতে ।)।
সেদিন আমার সুলগ্নাদিকে দেখে মনে হয়েছিল জীবনের প্রতিটা মুহুর্তকে ও হজম করে ফেলছে, আবার সৃষ্টি করছে। কোথাও কিছু জমিয়ে রাখছে না । যেন, মুহুর্ত বা স্বাদ যাই হােক না কেন, জমিয়ে রাখাটা হনুমানের কাজ । মানুষের নয়।
মুহুর্ত যে রঙ নিয়ে আসে, সময়ের রংও তাই । বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পড়াশােনায় মােটামুটি ভালাে একটা ছেলেকে যখন চাকরির খোঁজে নেমে পড়তে হয় রাস্তায়, পড়াশােনা সম্পূর্ণ না করেই, সেই মুহুর্তটাকেই বা অস্বীকার করি কী করে? যদিও পুলিশে চাকরি আর পুলিশ নিয়ে ভয় পারিবারিকভাবেই ছিল, তবু চাকরিটা পেয়ে আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ফিরিয়ে দেওয়ার মতাে অবস্থা ছিল না। চাকরিটা নিযে হাড়ে হাড়ে কলকাতাকে যেমন চিনছি, তেমনভাবেই বিকৃত বীভৎস সব পরিস্থিতিকেও, নিজেকে যতটা পারা যায় ঠিক রেখে, চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছি ।
কিন্তু এমন এমন সিচুযেশন আসে যখন সব কিছু চুরমার হয়ে যায় । জন্মদিনে কেকের ওপর বসানাে মােমবাতিটা থেকে আগুন লেগে যায় তখন । আগুন লেগে গিয়েছিল আমার অস্তিত্বে যখন আমি সরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সুলগ্নাদির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু একটা জিনিস দেখে অবাকও হযেছিলাম আর তা হচ্ছে ওই পুড়ে বীভৎস হয়ে যাওয়া সুলগ্নাদি যন্ত্রণার বাইরে নিজের রূপহীনতাকে পাত্তা দিচ্ছে না । রূপটাকে যেন সুলগ্নাদি রক্তে ধারণ করেছিল, বাইরে নয় । আমাকে চিনতে পারেনি সুলগ্নাদি । আমিও তাই পরিচয় দিতে যাইনি । বলিনি, সেই বহুবছর আগে যে ঘরােয়া পত্রিকাটা আমাদের পাড়ার বাচ্চারা প্রকাশ করত সরস্বতী পুজোর দিন, যেখানে ‘ধূমকেতু’ নিযে প্রবন্ধ লিখেছিল সুলগ্নাদি, আমি ছিলাম তার একজন সম্পাদক । শুধু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেছিলাম, কোথেকে কী প্রযােজনে এসেছি ।
ফিরে এসে আমার বসকে অনুরােধ করেছিলাম, যদি এই কেসটা থেকে আমায় সরিয়ে দেওয়া যায়। বস ভেবে দেখবেন বলেছিলেন কিন্তু পরদিন আমায় ডেকে বললেন, তােমাকেই যেতে হবে কারণ ওই ভদ্রমহিলা তােমায় রেকগনাইজ করেছেন । তুমি তাে ওর প্রতিবেশী ছিলে তাই না? বসের কথার উত্তরে কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অথচ মাথার ভিতরে সাইক্লোন চলছিল তখন। সুলগ্নাদি চিনতে পেরেছে আমাকে? ওই অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষটা, যে একবার আমার দিকে ভালাে করে তাকাতেও হয়তাে পারেনি সে কীভাবে চিনল আমাকে? গলার আওয়াজ শুনে? কতদিন তাে তাও শােনেনি? আরাে আশ্চর্য, চিনলই যদি তাে একবার আমার নাম ধরে ডাকল না কেন? একবার কেন কিছু বলল না! আমি সুলগ্নাদিকে চেনা দিইনি। বলেই আমাকেও সুলগ্নাদি এমব্যারাস করতে চায়নি?
আমার বস আমার হাতে সুলগ্নাদির একটা ডায়েরি তুলে দিয়ে বললেন, এটা উদ্ধার হয়েছে। মন দিয়ে পড়াে। ওই ভদ্রমহিলার স্টেটমেন্ট রেকর্ড করতে সুবিধা হবে ।তবে ওনার যা ক্রিটিকাল অবস্থা তাতে খুব কম সময়ে যতটুকু পারবে জবানবন্দি নিয়ে নেবে। ওনাকে বুঝতে না দিযেও করতে পারাে। এখন তাে মােবাইলেই সমস্ত কিছু রেকর্ড হ্য । বুঝেছ? আমি কথা না বলে ঘাড় নাড়লাম। মনে হল, কী রেকর্ড করব, স্টেটমেন্ট? কার? যার কথা আমার বস বলছেন সেই মেযেটাকে যতদূর চিনি সে হয়তাে সারা শরীরে ব্যাণ্ডেজ নিযেই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠবে জোরে। বলবে, ওই যে তাপটা মুখে লাগলে মুখ সুন্দর লাগে বলেছিলাম, সেই তাপটা একটু বেশি মাত্রায় লেগে গেছে বুঝলি? আর লেগে গেছে বলে…
আমি নিজের টেবিলে ফিরে ডায়েরিটা খুললাম…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।