সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ৮)

নিশিভোর

পর্ব – ৮

(১২)
সকাল সকাল আজ গৌরীর ঘুম ভাঙল ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন দেখে। কিন্তু জেগে উঠতেই মন থেকে স্বপ্নের বিষয় বস্তু সম্পূর্ণ ভ্যানিস। তবে অদ্ভুত ভাবে একটা চাপা কষ্ট ভেতরে ভার হয়ে রইল।
দাঁত ব্রাশ করে চায়ের কাপটা সবে হাতে নিয়ে সে ব্যালকনিতে বসেছে, হঠাৎ অরিন্দম পালের ফোন।
-হ্যাভ ইউ গন থ্রু টুডেজ নিউজ পেপার? মিডিয়া তো যাচ্ছেতাই লিখেছে অ্যাবাউট দা অপারেশন। ছিঃ। এটা তো আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের চূড়ান্ত লজ্জা!
-কই না, দেখিনি তো! -গৌরী হকচকিয়ে যায়, ‘ওকে স্যার, আই উইল গেট ব্যাক টু ইউ সুন’।
কাগজের হেড লাইনে প্রতিদিন চোখ বোলানোটুকুই হয়, খবরের ভেতরে ঢোকার সময় হয় না। তবে আজ প্রথম পৃষ্ঠাতেই চোখ আটকে রইল। -‘ঝিলমিলপুর অপারেশন চূড়ান্ত অসফলতায় শেষ হল’।
   মানে? চোখ কুঁচকে যায় তার। যদিও মিডিয়ার রিপোর্টিংকে সে কোনদিনই বিশেষ গুরুত্ব দেয় না। সত্য মিথ্যার মিশেল, কিছুটা চমক। কিন্তু এই খবরটা তো নাড়িয়ে দিচ্ছে! কী লিখেছে এত?
   -কিছু পুলিশকর্তার মতে অপারেশন ব্লু হেভেনের সফলতা-বিফলতার হার, পঞ্চাশ পঞ্চাশ। কারণ শিব শম্ভু বাবাজীকে এবারও ধরা গেল না, সে ধরাছোঁয়ার বাইরে। উপরন্তু এক নকল বাবাজীকে সামনে রেখে গুটি সাজিয়েছিল বাবাজী বাহিনী। ছক ছিল পুলিশ, গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিতে গেলেই তারা অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ফোর্সের ওপর। তাই খবর থাকা সত্ত্বেও নির্ধারিত দিনে আশ্রম রেইড করার কোনও চেষ্টাই চালান নি আইপিএস, অনুভব সিনহা, যার কাঁধে এই মিশন পরিচালনার দায়িত্ব ভার বর্তেছে শেষ মুহূর্তে’।
   উফ্‌! আবার সেই মোবাইল।
স্ক্রিনে সুমনা। বিরক্তি চেপেই ফোন ধরল, -হ্যালো।
   -নিউজ শুনছ টিভিতে? ব্লু হেভেন নিয়ে কত কী বলা হচ্ছে! মেনে নিতে পারছি না গৌরী। জাস্ট পারছি না। তোমার বিরুদ্ধ পক্ষ এত স্ট্রং! চ্যানেলগুলোকে তো মনে হচ্ছে পুরোপুরি কিনে নিয়েছে। এনিওয়ে শোন, কয়েকটা কথা বলে রাখি, জানি না পরে সময় পাব কিনা। পদ্মাকে সেদিন দার্জিলিং পার করিয়ে দেওয়ার পর থেকেই আমি হোটেলে স্বেচ্ছা বন্দী। কেউ মনে হচ্ছে সর্বক্ষণ আমায় ফলো করে চলেছে। বুঝতে পারছি দরজার বাইরেই বিপদ। যাক শোন, পদ্মা সেদিন বলছিল, শিব শম্ভুকে ধরাটা খুব টাফ ব্যাপার। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছদ্মবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেরায়। তার আসল চেহারা কেউ বড় একটা দেখে নি। কেবল কাছের কয়েকজন ছাড়া। আর যারা একবার বেবি গুহায় ঢুকেছে তারা দেখেছে বাবাজীর রূপ। অত্যন্ত কদর্য এক পুরুষ।
   -কী নাম বললে? কী গুহা? – গৌরীর ভ্রু কুঁচকে যায়।
   -বেবি গুহা। বাবাজীর দেওয়া নাম। আহ্লাদ করে সে  সন্ন্যাসিনীদের বেবি বলে ডাকত। আশ্রম চত্তরেই একটা সুরঙ্গ পথের শেষে ছিল একটা গুহা। যেখানে বাবাজী কুকর্মে লিপ্ত হত বেবিদের সঙ্গে। তাই ওই গুহার নামও হয়ে উঠেছিল, বেবি গুহা।
   গা ঘিন ঘিন করে ওঠে গৌরীর। হাতে ধরা কাগজটায় আবার চোখ পড়ে যায়। সুমনার ফোন শেষ করেই সে আবার ঝুঁকে পড়ে লাইনগুলোতে।
শেষের কয়েকটা প্যারা যেন বিষাক্ত তীরের ফলা, সবগুলো তাক করে আছে তার দিকে। -পুলিশ মহলের এক অংশের ধারণা, আজ যদি অনুভব সিনহা ঝিলমিলপুরের দায়িত্বে না থাকতেন, বড় একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। কারণ বাবাজী বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিল।
এই মিশনে অনুভব সিনহার আর একটি কৃতিত্ব, সোর্স মারফৎ তিনি যখনই খবর পেয়েছেন ঝিলমিলপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আর একটি অস্ত্র ভান্ডার সেজে উঠেছে, গোপনে রেইড চালিয়ে দিয়ে সেখান থেকে তিনি বহু আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে আনেন। নিঃসন্দেহে এটি রাজ্য পুলিশের তরফে একটি পরম জয়।
কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন, গৌরী সিনহার মতো এমন দুঁদে পুলিশ অফিসার কীভাবে এই ব্লু হেভেন মিশনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিলেন, যাতে এই সম্ভাব্য বিরূপ পরিস্থিতির কথা একবারও গুরুত্ব পায় নি? অনেকে আশঙ্কিত, এমন অযোগ্য অফিসার দিয়ে যদি এই সমস্ত অপারেশনের ছক তৈরী হয়, ভবিষ্যতে এই ভন্ড সাধকদের রমরমা আরও বেড়ে চলবে!
শোনা যাচ্ছে, ওপর মহল এখনই চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছেন, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য গৌরী সিনহাকে এ ধরনের মিশন থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া যায় কিনা। দেখা যাক, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।
   কাগজটা হাতে নিয়েই অনেকক্ষণ বসে রইল গৌরী। বহুবার এর মধ্যে মোবাইল বেজেছে, থেমেছে, আবার বেজেছে, আবার থেমেছে। ধরে নি সে ফোন, এমন কী, ওপাশের কলার কে, তাও দেখতে ইচ্ছে হয় নি। বটুকদা ঘরে এসে দু চারবার তাড়া দিয়ে গেছে, ‘বলি অফিস টফিস আজ বন্ধ কি? তাহলে তো স্নান খাওয়ার সময় হয়ে গেল’।
   এক সময় ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়ায়। ওপাশ থেকে একটা অচেনা নম্বর বার বার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। হয়তো কোনও রিপোর্টার। এ কদিন এমনই চলবে। সাংবাদিকদের অত্যাচার লেগেই থাকবে। কিছু না ভেবেই সে এই ফোনটা ধরে ফেলল।
   ওপাশটা নীরব।
   -হ্যালো, কে বলছেন? –গৌরীর গলাটা কর্কশ শোনায়।
   এবার কাঁপা কাঁপা একটা কন্ঠস্বর বেজে ওঠে। ‘চিনতে পারছ আমায় ঘুঙুর?’
অবাক ভাবটা সামলাতে একটু সময় নিল গৌরী। শিরদাঁড়া টান করে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। বলুন’।
-কেমন আছো ঘুঙুর মা?
সামান্য দুর্বল হল কি গৌরী? ঘুঙুর নামটার ওপর তার বরাবরের দুর্বলতা। একমাত্র ওর বাবা ডাকতেন ঘুঙুর বলে। বিয়ের পর, সে নামে ভাগ বসালেন জ্যোতিপ্রিয়। অপছন্দ হলেও মেনে নিয়েছে। আসলে নিজের বাবার সঙ্গে জ্যোতিপ্রিয়কে একাসনে, অসম্ভব!
–আমি দেখেছি ঘুঙুর, অনু দার্জিলিং পোস্টিং পাওয়ার পর তুমি নিয়ম করে আমায় ফোন করেছ সকাল বিকেল। হয়তো আমার ছেলেরই নির্দেশে। তবু আমিই কোনদিনই ফোন তুলি নি। প্রথম কারণ লজ্জা, দ্বিতীয়, আমার অহং। সে পাহাড়ের মতো প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে তোমার আর আমার মাঝে।
-আজ সে সব কাটিয়ে উঠলেন কীভাবে?
একটু বিরতি নিলেন জ্যোতিপ্রিয়। গলায় ঢক ঢক জল ঢাললেন। – বিশ্বাস করবে না হয়তো, তবু বলছি, আজকের কাগজ পড়ে বড় আঘাত পেলাম। তোমার মতো একজন কমপিটেন্ট অফিসারকে এভাবে … ছি, ছি, ছি। জানো, কখনও কখনও মনে হয়েছে, অনু যা পারে না, তুমি তা পারো। তুমি আমার ছেলের চাইতেও অনেক বেশি স্টেডি। এবং কথাটা মনে হলেই, একটা জ্বালা হত ভেতরে ভেতরে। অনু তো আমারই অংশ। ওর কোথাও পরাজয় মানে তো আমিও পরাজিত।
দারুণ অবাক হচ্ছে গৌরী। ওপাশে কি সত্যিই জ্যোতিপ্রিয়? নাকি অন্য কেউ? তবে কথাগুলোয় কী যে জাদু, একেবারে ঘোর লাগা।
-মা রে, তোর এই বাবাটা আজ ভিখিরি। বিশ্বাস কর। সব খুইয়ে বসে আছি । মাই ডেজ আর নাম্বারড। যে কোনদিন ওপরওলা ডেকে নেবেন। চলে যাওয়ার আগে তাই সব ঋণ চুকিয়ে দিতে চাই। ঘুঙুর, আমি তোমার সঙ্গে অনেক দুর্ব্যবহার করেছি। কিন্ত সেই দুর্ব্যবহারের আড়ালে ছিল ভয়। মনে হত তুমি একদিন আমাদের সবাইকে ছাপিয়ে অনেক ওপরে উঠে যাবে। একজন মেয়ের এত ওপরে ওঠাটা আমি সহ্য করতে পারতাম না।
একনাগাড়ে অনেক কথা বলেছেন। জ্যোতিপ্রিয়  হাঁপাচ্ছেন এবার অল্প অল্প। মোবাইলের ভেতর দিয়েও একটা সাঁই সাঁই শ্বাসের শব্দ কানে আসছে। গৌরী সতর্ক হয়। ধীরে বলে, -‘এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, বাবা? আস্তে আস্তে কথা বলুন। আর পুরনো সিন্দুক খুলে নাই বা ঘাঁটাঘাঁটি করলেন! ওই সময়টাকে তো আমরা দুজনেই পেরিয়ে এসেছি।
জ্যোতিপ্রিয় আবার কিছু বলতে চাইছিলেন, কাশির দমকে কথা তলিয়ে গেল। গৌরী ফোনটা ধরেই রয়েছে। তার অ্যান্টিনা কিছু সিগন্যাল পাওয়ার অপেক্ষা করছে।
-আমি অনেক দোষ করেছি মা। যদি বলি, তোর কাছে হাত জোড় করে  ক্ষমা চাইছি, দিবি ক্ষমা?
গৌরীর অস্বস্তি বাড়ছে, কিন্তু ওই বৃদ্ধকে চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
-একটা ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই মা। – বলেই তিনি চুপ। -ধরে নাও আমার শেষ ইচ্ছা।
একটা হিসেব নিকেশ চলতে থাকে গৌরীর মনে। বিত্ত বা ক্ষমতা কোনটাই ওঁর কম নেই। তারপরেও গৌরীর সাহায্য প্রার্থনা! তবু জ্যোতিপ্রিয়কে আর একটু বলতে দেওয়ার জন্যই সে নিজে মুখ খোলে, ‘বলুন, শুনছি। আমার সাধ্যের মধ্যে যদি কিছু থাকে, নিশ্চয়ই করব’।
আবার খানিকক্ষণের স্তব্ধতা। জ্যোতিপ্রিয় কি নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন?
-বলুন বাবা, আমি অপেক্ষা করছি। অফিস বেরোতে হবে।
-এবার একটা বড় করে দুর্গাপুজা করতে চাই বাড়িতে। হা হা হা । – জ্যোতিপ্রিয় নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠলেন। – বুড়ো বয়সের ভীমরতি ভাবছ তো! কী জানি, হয়তো তাই। তবে ইদানিং আমি স্বপ্নে দেখছি, মা দুর্গা আমার ঘরে এসেছেন। আমার বাগানের পদ্ম ওঁর পায়ে। জানো, পদ্ম আর শিউলি, দুটো বড় প্রিয় আমার। সামনের শরতে যখন শিউলি ফুটবে, আমার ফটোর সামনে এক মুঠো শিউলি দিও, কেমন।
গৌরী ঠোঁটের কোণ দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে, -বাবা প্লিজ। এখন ভাল ভাল মেডিসিন বেরিয়ে গেছে। এত ভাবছেন কেন?
-যাক, বাদ দাও। ইমোশনাল হয়ে পড়ছি। তবে কী জানো,  আমি বুঝতে পারছি আমার ষ্টেশন সামনে চলে এসেছে। এবার যাত্রা শেষ করতে হবে। তাই হাতে সময় যতই কম থাকুক, এ বছরই আমি দুর্গা পুজো করে যাব। দেখো খুব জাঁকজমক হবে।
গৌরী ঘড়ি দেখে। এবার ওঠা দরকার। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে খেয়াল করেছে, একবার রোহিত আর একবার অরিন্দম পালের নম্বর ব্লিংক করেছে। কল ওয়েটিং।
-জানো ঘুঙুর, অনুর মা খুব চাইতেন বাড়িতে পুজো পালি হোক। একবার মাথায় বাঁই চাপল, দুর্গা পুজো করবে। তখন বলে আমার পয়সার জোর নেই। ধমকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। এখন মনে পড়লে কষ্ট হয়। ওর ছোট ছোট সাধও পূরণ করতে পারি নি। অথচ ওর মৃত্যুর পর, আমার ব্যবসা বাড়ল। আর সে মানুষটা শুধু দারিদ্রের সঙ্গে ঘর করে গেল।
আবার অরিন্দম পাল ফোন করছে। না, এবার জ্যোতিপ্রিয়কে থামাতেই হবে।
-বাবা, আমি এখন ফোন ছাড়ছি। রাতে কথা হবে।
-তাহলে আজ্ঞাটা দিয়ে দাও, পুজো হবে কি হবে না।
হাসি চাপে গৌরী। হয়েছে কী আজ জ্যোতিপ্রিয়র! ব্লু হেভেন মিশনে তার পরাজয়ের সেলিব্রেশন! হা হা হা। ছিঃ! মানুষকে এতখানি অবিশ্বাস করা কি উচিত?
-তোমার কোনও দায়িত্ব নিতে হবে না মা। – জ্যোতিপ্রিয় আবার কথা শুরু করলেন। – কাজের সব দায় দায়িত্ব অন্য লোকের মধ্যে ভাগ করে দেব। শুধু পুজোর কাজটায় তুমি থাকবে। ওপর থেকে অনুর মা দেখুক, এ বাড়ির বউয়ের হাত দিয়েই … – জ্যোতিপ্রিয়র নাক টানার শব্দ। -ও শান্তি পাবে। প্লিজ ঘুঙুর, না কর না। পুজোয় তুমি থেকো। তুমিও তো সিনহা বাড়ির বউ। পরিবারে একমাত্র পুত্রবধূ।
না, কথাগুলোয় দম আছে। ক্রমশ একটা মোহ বিস্তার করে চলেছে তার ওপর।  সকালের মন খারাপটাও যেন কোন ফুৎকারে হাওয়া। আরে, কর্ম জগতে এটাই তো নিয়ম। সাপ লুডো খেলা। কখনও মই চড়ে ওপরে উঠবে কখনও আবার সাপের মুখে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড।
-আমি বলছি ঘুঙুর, সব কুগ্রহ কেটে যাবে। আমাদের কুল পুরোহিত আগেই বলেছিলেন, এই বছরের শেষ দিক থেকেই আমার পরিবারে একটা ঝড় উঠবে। বিশেষ করে অনুর ওপর দিয়েই নাকি ঝড়টা যাবে। ও আমার একমাত্র সন্তান, বুক দিয়ে আগলে রেখেছি সব সময়। সবাই ওকে ক্ষ্যাপাত,  প্যাম্পারড চাইল্ড। হা হা হা। তাই আমি বেঁচে থাকতে থাকতে, ওই ধ্বংসের বীজটাকে উপড়ে ফেলে দিয়ে যেতে চাই। মায়ের চরণ যে ভিটেয় পড়ে, সেখানকার সব দোষ কেটে যায়। জানি তোমার চাকরির দায় দায়িত্ব অন্য ধরনের, তবু ওই তো কটাদিনের উৎসব। চারটে দিন তুমি অন-ডিউটি থেকো না।  ছুটি নিও। ছেলেকে ভালবাসতে ভালবাসতে কখন একসময় তোমাকেও ভালবেসে ফেলেছি। আর ওই যে বাবা ডাকটা! পুরুষ মাত্রই জানে, কী আছে ওই ধ্বনিতে।
জ্যোতিপ্রিয়র কথায় গলতে থাকে সে ভেতরে ভেতরে।  পাক্কা আধ ঘন্টা কথা বলে তারপর উনি ফোন ছাড়লেন।
   তড়িঘড়ি অরিন্দম পালকে ফোন লাগায় গৌরী, ‘হ্যাঁ স্যার, বলুন’।
-দেখেছ নিউজ পেপার। হোয়াট ইজ ইওর রি অ্যাকশন?
-নো রি অ্যাকশন, স্যার। যারা রিপোর্ট লিখেছে, তারা খবর বেচে, অ্যাকশন ফিল্ডে নামে না। সুতরাং ওই সব নিউজ কভারকে আমি পাত্তা দিই না। তাছাড়া আমি তো অপারেশনে ছিলাম না। যখন ব্লু হেভেনের প্ল্যান তৈরি করেছিলাম, তখন একরকম পরিস্থিতি ছিল, এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। আমরা সবাই জানি সিচুয়েশন বুঝে ছক পাল্টে ফেলতে হয়। অনুভব সিনহা সে কাজটাই করেছে অ্যান্ড হি ইজ সাকসেসফুল। আর এখানে আমার না কোনও জয়, না কোনও পরাজয় আছে।
   অরিন্দম মন দিয়ে শুনল তার পুরো কথা। শেষ হতেই বলে, -গৌরী, আই মাস্ট সে, তোমার উইটস আছে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। এখনও সময় আছে, নিজেকে রেক্টিফাই কর। সংশোধিত হওয়ার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই।  তুমি নিজেকে ব্লু হেভেনের ঈশ্বর ভেবে রেখেছিলে। দেখলে তো, তার ফলটা কী?
-স্যার, ফোনটা রাখছি এখন। আজ অফিস যাব না। কয়েকটা জরুরি কাজ সারতে হবে।
-কী কাজ? বলা যাবে? আমাকেও সঙ্গে নাও না। অ্যাকমপ্যানি করতাম একটু। হা হা হা।
-ইজ ইট! – গৌরীও হাসে। – জানা রইল। তবে আজকের কাজটা ব্যক্তিগত। সঙ্গে নেওয়া যাবে না। তবে ইভিনিং এ ফ্রি আছি।
-দেন ফিক্স আ টাইম।
নির্ধারিত সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে অরিন্দম পাল। সেই একই কফি শপ। সুমনার সঙ্গে গৌরীর প্রথম পরিচয় এখানেই।
গৌরী নিঃশব্দে হেসে চেয়ার দেখিয়ে বলে, ‘বসুন স্যার’।
টুকটাক কথা চলল খানিকক্ষণ। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার অরিন্দমের মোবাইলে ফোন আসছে, যাচ্ছে। একসময় অর্ডার মাফিক ওয়েটার স্যান্ডউইচ আর কফি, টেবিলে সাজিয়ে গেল।
-আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি, কখন তোমার কথা শুনব। – কফিতে চুমুক দিতে দিতে অরিন্দম হাসে।
-আমার তো কোনও কথা নেই স্যার, বরং আপনি বলুন, আমি শুনছি। কী সব সংশোধন টোন বলছিলেন তখন ফোনে?
অরিন্দমের পলকহীন দৃষ্টি ওকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলল। হেসে বলে, ‘ওকে লেট আস স্টার্ট।
এর মধ্যেই অনুভবের ফোন ঢুকল, ‘কোথায় আছো?
-এই তো একটা কাজে। ডোন্ট ওরি, কাজ শেষ করেই বাড়ি যাব। হ্যাঁ, সঙ্গে আমার গাড়ি আছে।
অরিন্দম হাসে, ‘কী ব্যাপার, বর কি আজকাল একটু বেশিই ভালবাসছে?’
জবাবে মাপ মতো হাসি ফোটায় গৌরী, ‘বলুন স্যার। কী যেন বলবেন, বলছিলেন’।
ওয়েটার আর একবার সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘ফ্রেস কোনও অর্ডার হবে?’
-হ্যাঁ আরও দু কাপ কফি।
-সে কী! আবার? – গৌরী নিজের কাপ দেখায়। – এটা তো এখনও শেষ হয় নি।
-ওটা জুড়িয়ে গেছে, ফেলে দাও। নতুন করে আর একবার শুরু কর।
-কী?
অরিন্দম হাসে, ‘কফি এবং যা হারিয়ে গেছে সব। ফর ইওর ইনফরমেশন, বাবাজী পাকড়াও মিশন আবার শুরু হচ্ছে। তবে কিছুটা সময় পড়ে। আমি চাই এই মিশনেও তুমি থাকো। তবে মিশনের নাম আমি পাল্টে রেখেছি, পিস ইন হেভেন। ওই নীল স্বর্গ টর্গ নয়।
-বাহ্‌, আপনার দেওয়া নাম! বেশ একটা শান্তি শান্তি ভাব  আছে নামে। তাহলে নিশ্চয়ই এই মিশনে আপনিই হেড।
অরিন্দম হো হো করে হেসে উঠল, ‘এই জন্যই তোমায় এত ভালবাসি গৌরী। না বলতেই কত কিছু বুঝে যাও। শুধু আমাকেই বুঝলে না, পাত্তাও দিলে না। কেন গো? আমি কালো বলে? কালো কিন্তু জগতের আলো’।
গৌরী লোকটাকে নিরীক্ষণ করতে থাকে। কুৎসিত লাগল ওর চোখের দৃষ্টি, হাসির ভঙ্গি। কথা বলতে বলতে বার বার ওর আঙুল স্পর্শ করে যাচ্ছে। -শোন, একটা কথা খুব মন দিয়ে শুনে রাখো। – অরিন্দম বলতে শুরু করে, – শিবশম্ভু কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না।  পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে আর পাহাড়, জঙ্গল ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ও এখন অসুস্থ। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারছে না।
-তাই! শুনছি কেউ কেউ বলছে, বাবাজী আরও দূরে বিদেশে কোথাও উড়ান দিয়েছে।
অরিন্দম হাসে, ‘সব কথাকে কেন মাথায় ঢোকাও? নিজের সেন্স কী বলে? শিবশম্ভুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা, পুলিশ লুক আউট নোটিস ঝুলিয়েছে। এ অবস্থায় ও কোনভাবে বিদেশে যেতে পারে? শোন, আমি তোমার নাম প্রোপোজ করব অ্যাজ মাই অ্যাসিসটেন্ট।
-নো, সরি। আমি বাবাজীর কোনও মিশনে আর থাকব না।
-কাম অন গৌরী। এটা কাজের জায়গা, মান অভিমানের জায়গা নয়।
-ভেরি ট্রু। মান অভিমান আমার ঘরের সঙ্গে, বরের সঙ্গে। যে মিশনটা একটা আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছুই নয়, আমি সে মিশনে থাকব না।
-প্লিজ ক্ল্যারিফাই। কী বলতে চাইছ তুমি?
-যদি বলি, ইচ্ছে করে বাবাজীকে ধরা হচ্ছে না। তাকে শেল্টার দিয়ে রাখা হয়েছে একটি সুরক্ষিত জায়গায়।
-হোয়াট! তুমি জানো তুমি কী বলছ?
-সজ্ঞানে বলছি যখন, সবটা জানি। বাবাজী ধরা পড়লে, তার সঙ্গে যুক্ত অনেক নামী দামী মানুষও ধরা পড়ে যাবে। তবে একটা কথা, ব্লু হেভেন অপারেশনকে চূড়ান্ত অসফল দেখাতে গিয়ে যারা শিব শম্ভুর মতো একজন ভন্ড, প্রতারক, ধর্ষককে বাঁচিয়ে যাচ্ছে বার বার, রাতে ঘুমোতে পারে তারা শান্তিতে? বিবেক কখনও জবাবদিহি চায় না।
অরিন্দম চুপ। তার স্পর্ধা দেখে হয়তো বাকরুদ্ধ।
গৌরী হঠাৎ দু হাত জড়ো করে তার চোখের দিকে তাকায়, ‘মাফ করবেন স্যার, এক্তিয়ার ছাড়িয়ে কথা বললাম হয়তো। কিন্তু বিশ্বাস করুন, খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আপনার কাজে। যে স্পিরিট, যে শক্তি আপনার মধ্যে ছিল, তার একটা বড় অংশ অপচয় করে ফেলেছেন আমার হার দেখতে চেয়ে। – গৌরী চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়। তারপর যেন খুব জরুরি কিছু মনে পড়েছে এইভাবে হাত নেড়ে বলে, -বাই দা ওয়ে, আপনার কাছে সেই বহু মূল্য ফাইলটি, যেটি আমি সেন্ট্রাল স্টোর থেকে জোগাড় করে এনেছিলাম, তারপর আপনি আবার উধাও করে দিয়েছিলেন, মনে পড়ছে স্যার? সাত বছর আগের পুরনো কেস এবং পরিবার রিলেটেড, এই বলে ইন্টারভেন করতে নিষেধ করেছিলেন! – গৌরী হেসে হেসে কথা বললেও মুখ কঠিন। – ওটার আর দরকার হবে না স্যার। আজ ন্যাশানাল লাইব্রেরি ঘুরে সেই সাত বছর আগের নিউজটার তারিখ বার করে নিলাম। ডিরেক্টর সাহেব খুব সাহায্য করলেন ব্যাপারটায়। দেখা গেছে, পর পর বেশ কয়েকদিন ধরে বড় বড় নিউজ পেপার ওই খবরটাকে কভার করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলাম কাগজের অফিসগুলোয়, যে কাজটা হতে দশ দিন তো মিনিমাম লাগত, ডিরেক্টর সাহেবের এক ফোনেই আজকের মধ্যে সেই সাত বছর আগের পুরনো খবরগুলোর কপি এখন আমার হাতের মুঠোয়। তা খবরে দেখা যাচ্ছে, এই পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরই বেশ কয়েকজন পদস্থ অফিসার তদন্ত করতে গিয়ে কেসটাকে রীতিমত চেপে দিয়েছিল। কারণটা কী? একটা সহজ উত্তর আমাদের সবারই জানা, আন্ডার টেবিল ডিল। প্রচুর টাকা পয়সার লেন দেন।
-শাট আপ, গৌরী। তুমি জানো না, তুমি নিজের কত বড় ক্ষতি করে ফেললে।
– সরি স্যার। আমি এসব কথায় ভয় পাই না। আসলে আমার মধ্যে এমন একটি গৌরী ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সময়ে সময়ে যে আমার বশে থাকে না। যেটা সে ভেবে নেয় করবে, করবেই।
কয়েকদিন বাদে সত্যিই দেখা গেল, গৌরীর জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে দুটো। ওর জীবনের খুব কাছের বন্ধু, সুমনা মার্ডারড্‌। দ্বিতীয় দুঃসংবাদটি হল, গৌরীকে কমপালসারি ওয়েটিং এ পাঠিয়ে দেওয়া হল হেড কোয়ার্টাসের এক অর্ডারে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।