সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে শাশ্বতী নন্দী (পর্ব – ১০)

নিশিভোর

পর্ব – ১০

(১৫)
যতই মেঘ ছড়িয়ে পড়ুক আকাশে, সহজে বৃষ্টি নামে না গৌরীর চোখে। কিন্তু এবার যেন ওর দু চোখ বর্ষার নদী, পার  ভেঙে ভাসিয়ে দেবে সব। বটুকদা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে তার বৌদিমনির পাশে। বহুদিনের মানুষ তো, ভারি মায়া। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একবার বলেই ফেলল, ‘দুঃখু ভাগ করলে দুঃখু কম। কে মারা গেছে গো তোমার? খুব কাছের কেউ?’
চোখ তুলে তাকাল গৌরী, সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে নামল।
বটুকদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোমার ওই পুলিশ ইউনিফর্ম পরা চেহারা দেখলে কে বলবে ভেতরে এমন তুলোর মতো নরম হৃদয় আছে?’
ছেলেমানুষের মতো চেটোর উল্টো পিঠ দিয়ে গৌরী কান্না মোছে, ‘হ্যাঁ বটুকদা, ভীষণ কাছের এক বন্ধু চলে গেল। কদিনের মোটে বন্ধুতা, কিন্তু আমি যে ভুলতেই পারছি না। কেনই বা হল ওর সঙ্গে চেনাচেনি?’
বটুকদা আবার মাথায় হাত বোলাল, ‘ভগবান কখন কারে কার কাছে পাঠাবেন, সে তাঁরই বিচার। ওসব নিয়ে মেলা ভাবতে নেই গো। যাক, এই গরম গরম হরলিক্সটা খেয়ে নাও, এই নিয়ে দুবার গরম হল। এভাবে না খেয়ে পড়ে থাকলে রোগে পড়বে, দাদা তখন এসে আমার মাথাটারে হাতে কাটবে’।
চোখে কান্না নিয়েই এবার গৌরী হেসে ফেলে, ‘সে ভয় নেই তোমার। আমার জন্য অত মায়া দয়া তার শরীরে নেই’।
বটুকদা কাপ ভর্তি হরলিক্স খুব সাবধানে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘এত মানুষ নিয়ে তোমার কারবার, অথচ নিজের মানুষটারেই চিনতে পারলে না। যাক, এক ঢোকে ওটা খেয়ে কাপখানা আমায় ফেরত দাও এবার’।
অগত্যা …
মোবাইলটা ভাইব্রেশনে রাখা। এখন নৈঃশব্দ্য ছাড়া কিছু সহ্য হয় না। দু চারবার কল এসেছে, ভাল লাগে নি কথা বলতে। ধরেও নি। তবে রোহিতের ফোন রিসিভ করল।
-সরি টু ডিস্টার্ব ইউ। আপনার কথা খুব মনে পড়ছিল ম্যাডাম, ফোন করে ফেললাম। ভাল আছেন তো? জানি এ পরিস্থিতিতে ভাল থাকা যায় না।
-আর কিছু বলার ছিল রোহিত? – গৌরী শান্ত।
-না ম্যাডাম। – খানিক চুপ করে থাকে রোহিত, -যেভাবে  আপনাকে কমপালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠিয়ে দিল, সব স্যাবোটেজ ম্যাডাম। আমি কিছুতে মেনে নিতে পারছি না।
-ওই ব্যাপারটা নিয়ে জাস্ট ডিসকাস করার মুড নেই রোহিত।
-সরি ম্যাডাম। আর বলব না। শুধু একটা ছোট্ট জিনিস আপনাকে জানাই। এবার ব্লু হেভেন মিশনে যাওয়ার আগে, জুঁই আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল, অপারেশন থেকে যদি সুস্থ শরীরে ফিরে আসি, এই পুলিশের চাকরি আর নয়, রিজাইন করব। বি সি এস বা অন্য কিছুতে ট্রাই করব। বয়স এখনও আছে। কিন্তু অবাক কান্ড, অপারেশনটা আনসাকসেসফুল হয়ে যখন ফিরে এলাম, জুঁই একদম আলাদা মানুষ। বলে, না এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোমাদের লড়াইটা জারি রাখতে হবে। এই চাকরি তুমি ছেড়ো না।
-বাহ্‌, ভাল লাগল শুনে। – গৌরীর এখনও শান্ত স্বর।
-তবে আমি আবার একটা অন্যায় করে ফেলেছি ম্যাডাম, জুঁইয়ের চাপাচাপিতেই আবার পৌঁছে গিয়েছিলাম বাসুবাবার ডেরায়।
গৌরী হেসে ফেলল, ‘তাই নাকি! আবার!’
-হ্যাঁ আবার। কী করব? কিছু ব্যাপারে জুঁই এমন একগুয়ে!  তবে এবার ও  মরিয়া  হয়ে কেন ছুটেছিল জানেন?
-কেন?
-বাসুবাবার থেকে জানতে চাইবে, গৌরী ম্যাডামের জীবনে এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে? এবং যুদ্ধ শেষে জয়ের মুকুট ম্যাডামই পরবেন কিনা?
তাই! গৌরী রীতিমত অবাক! না দেখা, না চেনা একটা মানুষের প্রতি জুঁইয়ের এত শ্রদ্ধা।
-তা কী বলল বাসুবাবা? গৌরী ম্যাডামের জীবনে যুদ্ধ কখনও থামবে না, এই তো?
-কে বলেছে ম্যাডাম? যুদ্ধ থামতেই হবে এবং যুদ্ধ জয়ীও আপনিই হবেন। এ কথা বাসুবাবার নয়, আমাদের সকলের। যারা কাছ থেকে আপনাকে দেখেছি, চিনেছি।
-আরে বাসুবাবার প্রেডিকশনটা বলো?
-সে ব্যাটাকে পেলে তো। ছাউনি ছেড়ে চম্পট, কোথায় গেছে, গ্রামের কেউ বলতে পারল না।
রোহিতের ফোনের পরে আর কারো ফোন ধরে নি গৌরী। তবে অনুভব দিনে তিন চারবার কল করে গেছে। প্রতিবারই সে কেটে দেয়। সুমনার খুনের ব্যাপারে অনুভবের ওই উদাসীনতা, মোটেই  ভাল লাগে নি।
এরই মধ্যে আর একটা কল, আনসেভড নাম্বার। ট্রু কলারে নাম, বিকাশ গুপ্ত। চেনা চেনা নাম। ধরতেই ওপাশ থেকে একটা চিকণ কন্ঠস্বর ‘আন্টি?’
সঙ্গে সঙ্গে মুখে চিলতে হাসি ফোটে গৌরীর, ‘কে? আশা না ঊষা?’
-আমি আশা, ঊষার দিদি। – চিকণ স্বরে গাম্ভীর্যর ছোঁয়া।  – শোন, তুমি সেবার যে দুটো আলাদা আলাদা রঙ বাক্স কিনে দিয়ে গেছিলে না, মনে পড়ছে? আমারটা ঠিকঠাক আছে। কিন্তু ঊষারটা শুনবে কী হয়েছে?
-কী হয়েছে? – গৌরীর মুখে হাসি।
বটুকদা কী করতে ঘরে ঢুকেছিল, হঠাৎ বৌদিমনির হাসিমুখ দেখে অবাক অবাক চাইল, সামান্য আশ্বস্তও বোধহয়, ফিক করে হেসে উঠল কিছু না বুঝে। মেঘলা আকাশে দু ফোঁটা রোদ্দুরও যে বড় দামী।
-আন্টি শোন, ঊষা ওর সব মোম রঙগুলো চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। বোঝ! কী দস্যি মেয়ে। তারপর আরও শোন, আমার বাক্সটাও কেড়ে নিল। আমি এবার আঁকব কেমন করে? আর ও কী  আঁকছে জানো? কালো সূর্য, লাল নদী, সবুজ বৃষ্টি।
বাহ্‌, বেশ বেশ। ছোট্ট ঊষা এরকমই তো আঁকবে। তবে মুখে বলল, -সত্যিই তো, খুব অন্যায়। কই ডাকো দেখি ঊষাকে। খুব করে বকে দিই।
সামান্য থমকালো এবার আশা। বলে, ‘খুব বকো না’। –
-না, না, বকতে তো হবেই। -গৌরীর মজা লাগছে। – রঙ চিবিয়ে কেউ খায়?’
আশার গলায় সমঝোতার সুর, ‘আন্টি, বোন ছোট তো। খুব বকলে ভয় পাবে, কাঁদবে’।
হাসিটা ধরাই থাকে গৌরীর ঠোঁটে। প্রতিটি মেয়ের মধ্যেই বুঝি এমনি করে একটা মা বাস করে।
গৌরী কপট রাগের ভাব দেখাল, ‘ঠিক আছে, তাহলে অল্প করেই বকব। তুমি ডাকো ঊষাকে’।
সময় নিচ্ছে ঊষা, দু বোনের ফিসফিসানির শব্দ কানে এল। একসময় ভয়ে ভয়ে ফোন ধরল ঊষা, ‘হ্যালো-ও-ও-ও। আমি আর পেন্সিল খাব না আন্টি। মা সেদিন কানমূলেও দিয়েছিল।
-কিন্তু তুমি কালো সূর্য আঁকো কেন? লাল নদী হয় নাকি, বৃষ্টিও তো সবুজ হয় না। শোন, তুমি ভাল করে দিদির থেকে আঁকা শিখবে, তারপর একটা খুব ভাল ছবি এঁকে আমায় দেবে। তাহলে তোমাকে আমি এত বড় একটা প্রাইজ দেবো?’
-দিদির চেয়েও বড় তো?
-হু, – গৌরী একটু চিন্তার করার ভান করল, -যদি দেখি দিদির চাইতেও তোমার ছবিটা বেশি সুন্দর, তাহলে তোমাকে দুটো বড় বড় প্রাইজ দেবো।
-আর দিদিকে?
-একটা।
কী মজা, কী মজা। ঊষা ফোন ছেড়ে দিল। ওদিকে আরও কিছুক্ষণ বকবক চলল আশার। ফাঁকা ঘরে ওদের মন নাকি টিকছে না। মা বাবা বাইরে, দোকান সামলাচ্ছে। সেই কখন আসবে!
ফুটপাথের সংসার তুলে ওরা এখন একটা ভাড়া বাড়ির বাসিন্দা। কিন্তু এভাবে আট আর পাঁচ বছরের দুটো মেয়ে, একা একা থাকবে! চিন্তা হয় গৌরীর।
সাত কাজের ভিড়ে, ভুলেই গিয়েছিল ওদের স্কুল অ্যাডমিশনের কথা। অপরাধী মনে হল নিজেকে। যাক, নতুন সেসন পড়ুক, দুই বোনকেই ভাল কোনও স্কুলে বোর্ডিং হাউজে ভর্তি করিয়ে দেবে।
আশার বকবকানি, এখনও চলছে চলবে গতি। ফুল স্টপ পড়ার কোনও লক্ষ্মণ নেই। বলে, ‘বাবা আজ ভাগ্যিস ফোন ফেলে গেল,তাই তোমার সঙ্গে কত গল্প হল আন্টি। তুমি আবার কবে আসবে?’
-আসব, খুব শিগগিরি। তোমরা  সাবধানে থেকো। না দেখে কারোকে দরজা খুলবে না, কেমন?
ফোন ছেড়ে দিল আশা। আনন্দের রেশটা গৌরীর মনে রয়ে গেল অনেকক্ষণ। মিষ্টি মেয়ে দুটো।
একটা মেসেজ ঢুকছে পিক পিক করে। স্ক্রিনে উঁকি দিতেই অনুভবের নাম, অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেসেজ ইন বক্স খুলল।
-অনেক অভিমান হয়েছে, এবার ফোনটা তোল ম্যাডাম। ইম্পর্টেন্ট কথা আছে। -মোবাইলটা বেজেও উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
গৌরী ফোন তুলেও চুপ।
অনুভব হাসছে, ‘কে বলবে তুমি ডি সি অফ পুলিশ! এখনও এত ছেলেমানুষি মন। আরে বাবা, আমার ওপর শুধু শুধু রাগ করে লাভ আছে? সিরিজ অফ কেসেস দাঁড়িয়ে আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা সামলাই।
গৌরী অনুভবের জরুরি কথা শোনার অপেক্ষায়।
– জানো আমার হাতে এখন গীতবিতান। প্রেম পর্যায়ের গানের বাছা বাছা লাইনগুলো খুঁজছিলাম। হা হা হা। – অনুভবকে যেন আজ হেঁয়ালিতে পেয়েছে। – ভাবলাম দু এক লাইন কোট করে এবার মেসেজ পাঠাতেই হবে আমার ম্যাডামকে। মান ভাঙবে না মানে?
কপালের কাছে নেমে আসা ঝুরো চুলগুলো সাপটে ওপর দিকে তোলে গৌরী। মুখ একই রকম গম্ভীর। ফ্যাস ফ্যাসে স্বরে বলে, ‘আমার মন ভাল নেই অনুভব। প্লিজ, কাম টু দি পয়েন্ট’।
-ওকে, ওকে। কামিং টু দা টপিক। সেদিন তোমার অবজারভেশনই ঠিক। হিল কুইন হোটেলের মধ্যেই সুমনার খুনের ছক তৈরি হয়েছিল। তবে মার্ডারের বরাত পেয়েছিল এক পেশাদার খুনি। যদিও তাকে ধরা যায় নি, আপাতত পলাতক, তবে কান টানলে মাথা আসে। খুনি আজ না হয় কাল ধরা পড়বেই। তবে একটা কথা গৌরী, তোমার বন্ধুটি নিজের কবর নিজেই খুঁড়েছিল। বাবাজীর ডেরা থেকে এক আশ্রম কন্যাকে পালাতে সাহায্য করে। সো, ওর মৃত্যু  অবধারিত ছিল। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক, শিব শম্ভুর টার্গেট কখনও মিস হয় না। তাই তো তোমাকে সব সময় আগলে রাখি। – শেষের কথাগুলো যেন অনুভবের স্বগতোক্তি।
-হোটেলের যে ছেলেটি যুক্ত ছিল এই চক্রে, এখন কোথায়?’
-পুলিশ কাস্টডিতে। ও-ই তো টাইম টু টাইম সুমনা সম্বন্ধে খবর চালাচালি করত। যাক, এবার অন্য একটা প্রসঙ্গে যাই। আমাদের বাইরে যাওয়ার প্রোগ্রাম কিন্তু ফিক্স হয়ে গেছে। ষষ্ঠীর দিন রওনা হচ্ছি।
-হোয়াট? ষষ্ঠীর দিন! পাগল নাকি! অসম্ভব! বাড়ির পুজোয় এবার আমায় থাকতেই হবে। তোমার বাবাকে কথা দিয়ে ফেলেছি, আমার দেওয়া কথা নড়চড় হয় না।
হঠাৎ অদ্ভুত এক আচরণ করল অনুভব, যা সচরাচর  ওর মধ্যে দেখা যায় না। রীতিমত চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘এবার পুজোয় আমরা দেশে থাকব না, দ্যাটস ফাইনাল’।
-তাহলে পুজোর কী হবে? তোমার বাবা সমস্ত আয়োজন কমপ্লিট। এখন না বলা যায়? তাহলে তুমি দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে যা বলার আর বা করার কর।
-ফিরে আসার জন্য কি আমিও কম ছটফট করছি? স্পেশলি এখন, যখন তোমার পাশে কেউ নেই। আমি জানি কী টাফ টাইমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ!  – অনুভব একটু থামল। – একটা কথা বলছি, বিশ্বাস করবে? চাইলে আমি তোমার কমপালসারি ওয়েটিংটা আটকাতে পারতাম, কিন্তু আটকাই নি। কারণ …
-জানি। – গৌরী হাসে, -প্লিজ ডোন্ট এক্সপ্লেইন।
-জানো! তাই! কী জানো? আমিও একটু শুনি। -অনুভবের হাসি হাসি গলা।
-আমার মানসিক জোরটা ভেঙে দেওয়া আর আমার কেরিয়ার গ্রাফটাকে একেবারে খাদে নামিয়ে আনা, এই দুটোই ছিল তোমাদের উদ্দেশ্য।
-ইউ মিন আমারও? যা বলছ ভেবে বলছ?
-টু হান্ড্রেড পারসেন্ট ভেবে বলছি। কেন আমার মুখ খোলাচ্ছ তুমি অনুভব? একের পর এক চাল খেলে গেছো, দার্জিলিংয়ের পোস্টিংটা পড়িমরি করে নেওয়া, তারপর আমার ব্লু হেভেন মিশন থেকে আমার নাম সরিয়ে দেওয়া, নিজে সেই দায়িত্ব নেওয়া, আবার অপারেশন শেষে মিডিয়াকে জানিয়ে দেওয়া মিশন কতখানি অসফল, এবং অনলি ডিউ টু গৌরী ম্যাডামের ভুল প্রোগ্রামিং। এগুলো কার করা? তুমি এর মধ্যে ছিলে না?
-গো অ্যাহেড। আমি কারোর পথ আটকাই না। তোমার শেষ হলে, আমি শুরু করব, অবশ্য সুযোগ পেলে। – হা হা হা।
অনুভবের হাসিটা সর্বাংগ জ্বলিয়ে দিচ্ছে । আবার গৌরী মুখ খোলে, ‘আমার যোগ্যতার পাশে এমন একটা প্রশ্ন চিহ্ন  ঝুলিয়ে রাখলে, যাতে হেড কোয়ার্টাস সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল,  আগামীতে কোনও বড় অপারেশনে গৌরীর সিনহার নাম আসবে না। – একনাগাড়ে কথা বলে গৌরী হাঁপাচ্ছে। -এরপরও তুমি বোঝাচ্ছে আমার জন্য তুমি কষ্ট পাও? হোয়াট আ জোক।
গৌরীর কথা শেষ। অনুভব বেশ খানিক পর গলা ঝেড়ে বলে, ‘আজকের দিনটা তোমার বলার দিন। আমি শুধু শুনব। তবে দায়িত্ব নিয়ে একটা কথা শুধু বলি, এতক্ষণ আমার সম্বন্ধে যা বলেছ, সব ভুল। যেদিন সব কিছুর মীমাংসা হবে, দ্যাট ডে ইউ উইল রিপেন্ট। আর একটা কথা, আই ফার্মলি বিলিভ, জয় তোমারই হবে। কারণ তোমার যুদ্ধ ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য। যাক, ষষ্ঠীর দিনটা মনে রাখবে। ওই দিন আমরা স্টার্ট করছি ফর আ ফরেন ট্যুর। পুজোয় আমরা এবার দেশে থাকব না।
   আজকাল দিনে কতবার যে জ্যোতিপ্রিয় ফোন করেন গৌরীকে! পুজোর দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে, তিনি যত না চিন্তিত, উত্তেজিত তার চাইতে বেশি। ছেলেমানুষের মতো কত কী প্রশ্ন করেন।
বলব না, বলব না করেও বলেই ফেলে গৌরী, ‘বাবা, আপনার ছেলে তো ষষ্ঠীর দিন বিদেশ সফরে বেরোবে বলে সমস্ত কিছু ফাইনাল করে ফেলেছে। এয়ার টিকিট পর্যন্ত কাটা। কী করব  এবার?’
জ্যোতিপ্রিয় অনেকক্ষণ চুপ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। -‘ঘুঙুর মা, আমার ছেলেটা বরাবরই জেদি। তবে আমার কথায় নয়, যদি মত পাল্টায় তোমার কথাতেই পাল্টাবে। তুমি ওকে বোঝাও মা। আয়োজন সব কমপ্লিট, এখন কোনভাবেই … তাছাড়া পুজোটা করতেই হবে। আমার মন বলছে, এই পুজোর পরেই সুদিন আসবে। সব অকল্যাণ কেটে যাবে। মৃত্যুর আগে, একটাই তো প্রার্থনা, যদি কোনও ধ্বংস বীজ পোঁতা থাকে আমার ভিটে মাটিতে, আমি তাকে উপড়ে ফেলে দিতে চাই।
গৌরী প্রতিটি কথাই মন দিয়ে শোনে।
-শোন ঘুঙুর, দীক্ষার দিন তুমি কিন্তু আটপৌরে করে একটা গরদের শাড়ি পরে আসবে। মেয়েদের ওভাবে শাড়ি পরতে দেখলে আমার মা-কে মনে পড়ে।
-তাই হবে বাবা। – গৌরী হাসে।
সমস্ত গোছগাছ সমাপ্ত। আজ বাদে কাল গৌরী রওনা দিচ্ছে কুসুমপুর। তবু মনটা কেন যে খচখচ করছে? অনুভবের কথা হঠাৎ করেই খুব মনে পড়ছে। ও সঙ্গে থাকলে ভাল হত।
রোহিত এর মধ্যে আর একদিন ফোন করেছিল। কুসুমপুর যাওয়ার কথা ওকে জানায় গৌরী। রোহিত রীতিমত অবাক, ‘এত দূর একা একা যাবেন?’
-হ্যাঁ, যাচ্ছি। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে মনে হচ্ছে। । শোন এবার পুজোয় চার চারটে দিন তোমারও ওখানে নিমন্ত্রণ, সঙ্গে জুঁইকেও আনবে। আর হ্যাঁ, হরিবাবুকেও।  কুসুমপুরের একটা ম্যাপ এখনই সেট করে রাখো ফোনে, তাহলে চিনে যেতে সুবিধে হবে’।
দুপুরে একটা ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে চোখটা লেগে গিয়েছিল তার। বটুকদা এসে মোটাসোটা একটা খাম দিয়ে গেল।
হাতে নিয়েই ভেতরের রক্ত চলকে ওঠে। সুমনার পাঠানো সেই খাম। গোটা গোটা অক্ষরে গৌরীর নাম, ঠিকানা লেখা। অক্ষরগুলোর ওপর অনেকক্ষণ সে হাত বোলায়। ছুঁতে পারছে কি সুমনার আঙুলগুলো?
খামটা বেশ ওজনদার। কী আছে ভেতরে। খুলে ফেলতেই  বেরিয়ে এল প্রচুর চিঠি, কাগজের কপি আর কিছু কিছু ফটোগ্রাফ। বেশির ভাগই হলদেটে হয়ে যাওয়া ছবি। চোখের সামনে ধরতেই চমকে উঠল। এ কী!
থম মেরে অনেকক্ষণ ওগুলোর মাঝে বসে রইল গৌরী।  বটুকদা এক সময় এসে তাড়া দেয়, ‘কালকের লাগেজ সব গুছিয়ে নাও বৌদিমনি। খুব ভোরে বেরোবে তো’।
গৌরী মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ উঠি’।
ট্রলি ব্যাগটাকে নামাল আলমারির মাথা থেকে। পরিপাটি সাজিয়ে নিল ভেতরটা। গরদের একটা শাড়িও গুছিয়ে সামনে রাখে, কাল পরে বেরোতে হবে। মেয়েদের সতী সাধ্বী পবিত্র লুকটাকে বড় পছন্দ করেন জ্যোতিপ্রিয় সিনহা।
মনে মনে হাসে গৌরী। কীভাবে যেন পরতে বলেছেন? আটপৌরে করে।
কেন যেন মনে হচ্ছে কাল আবার সে একটা নতুন মিশনে বেরোতে যাচ্ছে। মিশন দীক্ষা।
ও হো, একটা জরুরি জিনিসই তো নেওয়া হল নি। তাড়াতাড়ি সে ড্রয়ার খুলে জিনিসটা সযত্নে রেখে দেয় সুটকেসে অন্য জিনিসের ভাঁজে।
তাহলে সামনে কুসুমপুর আর মিশন দীক্ষা।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।