বিঠঠল কালের কথা তোমাকে বলছিলাম।ওর সঙ্গে এক গ্রীষ্মের দুপুরে কিকউয়ী গ্রামের পশ্চিমদিকের জঙ্গলে আমার পরিচয়।বিঠঠল তখন খরগোশ ধরার ফাঁদ পাততে ব্যস্ত।আমিও ওই খর দুপুরে বহু পথ হেঁটে এসে আমার প্রিয় অমলতাস গাছটার নীচে একটু বসে জিরিয়ে নেব ভাবছি।এমন সময় ওকে চোখে পড়ল।এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কায় করাইসে?” মানে কি করছ? ও ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে একটুও অবাক না হয়ে বলেছিল “জেওনলা যুগার।” মানে খাবারের ব্যবস্থা।
তারপর কথায় কথা বাড়লো, দিনের শেষে দেখলাম আমি ওর ওই ছোট্ট পাতার ঘরে।ও একটু জোয়ারের আটা মুখিয়ার বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে এনেছিল, তাই দিয়ে বাইরে আগুন জ্বালিয়ে রুটি বানাচ্ছে, আর আমার কাছে জানতে চাইছে আমার কথা।বাড়িতে কে কে আছে? কেন এই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরি? বউ কিছু বলে না কেন? এইসব।আর আমিও সাধ্যমতো ওর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি।
মুন সেই গ্রীষ্ম বনের ভেতর, এক আকাশ তারার নীচে, ওই বন পাহাড়ের গভীরে আমি আর বিঠঠল যে বন্ধুত্বে বাঁধা পড়ে গেছিলাম, আমার প্রবাস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা অটুট ছিল।এ বন্ধুত্ব কোন সাধারণ বন্ধুত্বের মত না।ওই মাইলের পর মাইল বিস্তৃত বনের গভীরে যখন হঠাৎ মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়ে, তখন এই বন্ধুত্ব নিজের জীবনপন করে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ায়।এ বন্ধুত্ব যুদ্ধক্ষেত্রের বন্ধুত্বের মতো, নিরুচ্চার, কিন্তু অতলান্ত গভীর।
যখন কলকাতা ফেরার সময় হয়ে এল, ওর সঙ্গে দেখা করতে কিকউয়ী গ্রামে গেছিলাম।বিঠঠল সব শুনে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে চলে গেছিল গভীর বনের ভেতর, ওর সেই প্রিয় জায়গায়, যেখানে হরিণের দল আমলকী খেতে পাহাড় থেকে নীচে নেমে আসে।অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে একটা হীরের মতো দেখতে, পাথর বসানো আঁচলে লাগানোর পিন এনে দিয়ে বলেছিল, জানিনা এটা দিয়ে কি করে? আমার তো বউ চলে গেছে।তুমি বৈনিকে এটা দিও।ওরা বৌদিকে বৈনি বলে ডাকে।ওকে বলিনি, তার কদিন আগেই নম্রতাও চলে গেছে।আমি একা ফিরে যাচ্ছি কলকাতায়, এই বন পাহাড়, ওই বসন্তপূর্নিমা রাতের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সহ্যাদ্রী, ওই দিগন্ত বিস্তৃত রাধাচূড়া বনকে পেছনে ফেলে, যেখানে অনেক দুপুর, অনেকগুলো রাত আমি আর বিঠঠল বসে থেকেছি।
তবু নিয়েছিলাম।জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় পেলে? বলেছিল রুক্মিণী পুনে থেকে কিনে এনেছিল।রুক্মিণী, ওর বউ, সে এখন অন্য কারো ঘরে।