বিঠঠল কালের সেই পাতার ছোট্ট একটা বাড়ি আর আমরা দুজন, মাঝে মাঝেই ঘরের চাল ফুটো হয়ে জল পড়ত।তখন ওখানে একটা বালতি বসিয়ে আমরা দুজন সারারাত বসে থাকতাম।আমার পুনের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাট, কলকাতার বাড়ির কথা মনেই পড়ত না কখনও।মনে হত ওখানেই আছি আমি আবহমানকাল।ওখানেই থেকে যাব।
পুনেতে আমার সঙ্গে যিনি থাকতেন, যাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল, তুমি জানো তিনি আমার হননি কখনও।আর সেটা নিয়ে আমার কোন খেদও নেই।মহারাষ্ট্রে ওই বর্ষা আসার আগে তাঁকে আমি পাঠিয়ে দিতাম কলকাতায় তাঁর বাড়িতে।তারপর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বৃষ্টিভেজা সহ্যাদ্রীর পথে পাড়ি দিতাম।
বিঠঠল কালে এক অদ্ভুত দার্শনিক।কালো, ছিপছিপে চেহারা, কাঁধ ওবধি নেমে এসেছে অবিন্যস্ত চুল।একটা ধুতির মতো কাপড় কোমরে জড়ানো।বনের পথে বেরোনোর আগে হাতে একটা বল্লম নিয়ে নিত।একদিন বৃষ্টিটা একটু ধরেছে।আমি আর ও চলেছি সিংহগড় দূর্গের নীচের উপত্যকায় কাঁঠালের খোঁজে।তখন পুনে থেকে নিয়ে আসা শুকনো খাবারে টান পড়েছে।ঘরে সেরকম কিছুই নেই।কদিন পরে হয়তো ঘাসের বীজ খেয়ে থাকতে হবে।বর্ষার জন্য জঙ্গলে পেতে রাখা ওর সজারু আর খরগোশ ধরার ফাঁদও ডুবে গেছে জলে।ওই সবুজ অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে, ওই নির্জন উপত্যকার গভীরে ও হঠাৎ আমাকে বলেছিল, তোমরা যে এত শহর বানাও, এত টাকা জমাও, এসব আর কোন কাজে আসবেনা একদিন দেখে নিও।মানুষকে প্রকৃতির কাছে ফিরতেই হবে, প্রকৃতির নিজের মত করে।আমি স্তব্ধবাক হয়ে গেছিলাম।
এইসব নিরক্ষর বন পাহাড়ের মানুষ, ভাল করে খেতে পায় না, চরম দারিদ্র্য, যাদের প্রতিনিয়ত প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়, এই গভীর শিক্ষা এরা পায় কোথা থেকে?
আরেকজনের কথাও মনে পড়ে যায়, টমাস।নীলগিরী হিলসের এক নির্জন গ্রামে ওর বাড়ি, আদ্যন্ত মাতাল, ওও একা লোক।চন্দন বনের গভীরে ও আমাকে বলেছিল, একা লোক কল্লাগাল মধুমালাই রেঞ্জের বিরাট বাঘেরই মত।স্বাধীন, স্বরাট, কারো কাছে জবাবদিহী করার তার কোন দায় নেই।তোমরা টাকা জমাও, টাকা কি জমানোর জিনিস? ভালোবাসা জমিও যদি পার।
টমাস বলত আমি মারা গেলে, এই চন্দনবনের গভীরে কোথাও আমাকে শুইয়ে দিয়ে এস।আমার শরীরের ওপর এসে পড়বে রোদ, বৃষ্টি আসবে, সুগন্ধী চন্দন পাতায় ঢেকে যাবে আমার শরীর।আর মনে রেখোনা আমার কথা।মানুষ তো দাগের মতোই।মুছে যেতে সময় লাগেনা।
মুন, এইসব বন পাহাড়ের মানুষ, এঁদের গভীর জীবনবোধ, আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে।আমি সব কাজ শেষে একদিন ফিরে যাব ওখানেই।যদি হঠাৎ কখনও দেখ আমি নেই।জেনো চলে গেছি।