• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ শ্রী সুতনু হালদার বিরচিত (পর্ব – ৬)

আলাপন

(আত্মজৈবনিক কাব্যোপাখ্যান)

(২৮)
খোলস থেকে বাইরে আসতে যে সময়টা লাগল সেই সময়ে আমি বেশ কিছু অশ্বমেধের ঘোড়া ধরতে পারতাম, ওই সময়ে বড়সড় মেঘেরা আকাশকে ইশারায় নিজের করে ফেলতে পারত; সঙ্গম অবশ্য আরো কিছুটা বেশি সময় প্রত্যাশা করে…
সময় খুব আসলে খুব জেদি আর একরোখা…
আজকাল প্রতিটা সকালবেলার ঘনঘটা একটা ঝিরঝিরে নাতিশীতোষ্ণ অনুভূতি নিয়ে প্রতিদিন আমাকে কিছু কিছু করে মেঘবর্ণে রাঙিয়ে তুলতে চায়। নদীর প্রবাহে আত্মরতি জনিত কার্যকরণ অজানা ইঙ্গিতের জোনাকিদের শামুক ভাবতে দ্বিধা করে না!
সেই কোলাহল মুছে গিয়ে রসকষহীন ঠোঁটের বাহুল্য পুরানো বাড়িটার আগাপাশতলায় সুখটান দিচ্ছে! জানলা থেকে দরজার ভাঙন সরকারকে ফেলে দিতে পারে জেনেও চুপচাপ…
অনাস্থা আনতে গেলে খোলসত্যাগী ময়ূর পেখম তুলে নিজেকেই পণ্য করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমরা প্রত্যেকে পণ্য হয়েই নিজেকে বাহবা দিচ্ছি। এ যেন যথার্থই আয়নায় মুখ দেখা দেখি। যে মৌরিগাছ আমি প্রত্যহ পরিচর্চা করি সেই গাছ আমাকে তার ক্লোরোফিল দান করে, তার ফল দ্যায়। এই লেনদেনটাও অবশ্যই সময় সাপেক্ষ। গতকাল তোমার সঙ্গে ঘন্টা দেড়েক কথা বলে বুঝলাম ময়ুরের আবার পেখম তোলার সময় এসে গেছে। গতবার নীলপুজোতে তোমার মুখেই শুনেছিলাম চণ্ডীমঙ্গলের কিছু অংশ। ওই যে বলেছিলে, কমলেকামিনীর কথা। সেই কমলেকামিনী প্রতিবার রাস উৎসবে আমাদের পাড়ায় পুজো হয়। তোমার কাছে চণ্ডীমঙ্গল শুনলাম আর আমার পাড়ার কমলেকামিনী পুজোর ঘটনাটা আমি স্বচ্ছন্দে গোপন রাখলাম। এই গোপনীয়তার মাঝেই আগামীকাল আবার নীল পুজো হবে,আর মাত্র চারদিন পর পুরনো বছরটার খোলস ছেড়ে নতুন একটা বছর শুরু হবে। কোনো এক লাজুক প্রেমিক ময়ুরের মতো পেখম তুলে গোপনে আবার গেয়ে উঠবে, ‘ আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…’
আর সময়ও আবার গোপনেই তার খোলস ত্যাগ করে পৃথিবীকে আবার স্বাস্থ্যবতী করে তুলবে। শুধু একটা মহামারি তার পরাস্ত অস্ত্রটিকে আত্মগোপন করার সুযোগ দিয়ে বুঝিয়ে দেবে পৃথিবী আজও মানবিকই আছে…
(২৯)
শীতকালটা আগে বেশ ভয়ে ভয়ে কাটাতাম। ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।’ এই কথাটা আমার ক্ষেত্রে আক্ষরিকভাবেই খেটে গ্যাছে। ‘শীতকাল কবে আসবে’ গোছের প্রশ্ন করার মতো কোনও সুপর্ণার সাক্ষাৎ পাওয়া আর হয়ে ওঠেনি!
আসা-যাওয়ার মাঝে অতিসূক্ষ্ম একটা শিহরন থাকে, সেই শিহরনেই ভরে থাকল সমস্ত চর্যা। ইন্দ্রিয়ের রুদ্ধদ্বারে যে সমস্ত ফাটল এত দিনের সঞ্চয়, সেই ফাটলগুলোকে জোড়াতালি লাগানোতেই আমার একাদশ ইন্দ্রিয় আপাতত কুয়াশাকে দুরমুশ করে করে যাচ্ছে…
আকাশকে আলখাল্লা পড়িয়ে মরা জ্যোৎস্নার সাদা কালো কিছু ছবি অঙ্গের সঙ্গে নিপুণভাবে সঙ্গ দিতে কখনোই পিছুপা হয়নি! আর এইসবের মাঝেই নদীতে জেগে উঠল নতুন এক দ্বীপ, তার চারপাশ শিমূল- পলাশে আকীর্ণ। অনুরাগের সাতরঙা জোনাকি সেই দ্বীপে আলো ফ্যালে। অনুরাগের কোথাও কোনও বাৎসল্য থাকে কিনা বোঝা হয় নি, কিন্তু প্রতিটা অনুরাগের হৃৎপিণ্ডে থেকে যায় একটা প্রকাণ্ড মাথুর।
মাঘমাসের গায়ে যে লাল-হলুদ আলো লাগানো থাকে সেগুলোও যে আগুনের রূপভেদ এই কথা অনেক পরে যেদিন বুঝলাম, সেইদিন থেকেই শীতকালের ওপর থেকে সমস্ত ভয় কেটে গ্যালো।
এখন নদীর কোনো কোনো বেদেনী স্রোতকেও কখনও কখনও বড়ো ভালোবেসে ফেলি, শেষদিকে বাবা এগারোদিন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন, ফেরাতে পারিনি, মা বাইশদিন। সেই সময় বকুলগাছের পাতাগুলো আমার হয়ে নিশ্বাস নিত।
ড্রয়িংরুমের দেয়ালে সামান্য মুসুরির ডাল দিয়ে অনেক শুশ্রূষাকারী স্বপ্নকে এঁকে রাখার চেষ্টা করেছি, টাটকা ক্ষতস্থানে গাঁদাফুলের পাতা ঘসতে ঘসতে কখন যে নিজেকেই অশ্বমেধের ঘোড়া বানিয়ে ফেললাম, সেটাই আর বোঝা হ’ল না…
(৩০)
সেই বিকেলগুলোর মধ্যে এক একটা নারীত্ব চুপিসারে বসে থাকত। আমি ওর নাভি বরাবর এগিয়ে যেতাম। যে শুভ্রজ্যোতির্ময়তা এতদিন ঢেকে রাখা হত তার অনুষঙ্গেই বিকেল নামত আমার জীবনে। অথচ কাল এবং আজ কতবার কতক্ষণ ধরে জোনাকি হয়ে মিটিমিটি জ্বলতে থাকতাম! আমাজনের গল্পে যখন গহীন বিভোরতা ফুটে উঠল তখন চিরপ্রশান্ত স্রোতগামিতায় কিছু স্বপ্ননীল স্ফটিক আপন ছন্দে সাঁতরাতে সাঁতরাতে সুর তুলেছিল, ‘চিনি তোমায় চিনি নবীন পান্থ’ …
স্প্রীড পোষ্টের মতো নেমে আসা গোধূলিতে গঙ্গার ভিজে পার দেখে আমি জোয়ারের টান অনুভব করতে শিখেছিলাম। ভীষণ উন্মত্ততার মধ্যে আকাশের স্তনবৃন্ত জুড়ে একটা একটা করে ঝরে পড়ছে নক্ষত্রদোষ! গঙ্গার পার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃগনাভির স্বপ্নবন্ধ ঠোঁটের কষ বেয়ে স্তন থেকে কোমর হয়ে যোনি থেকে জঙ্ঘার গোপন প্রদেশে আলোকবর্ষ লিখে রাখে। নির্জন বুনোগন্ধ মাখা বাতাস সারা শরীরে মাখতে মাখতে সহনশীল বনফুলের বীজমন্ত্র গায়ে জড়িয়ে উদিত হ’ল এক মায়াময় ভোর। তার সঙ্গে তোমার অদ্ভুত মিল!
শঙখলাগা সাপের কামিনী কাঞ্চন মাখা কামার্ত মণি দুটো আপনমনে নিজেদের দেখছে, এ যেন অনন্তকালীন এক প্রথা বহির্ভূত সহবাস; পুষ্পরেণুতে প্রস্ফুটিত বৃষ্টির নিটোল দামালপনা সামলাতে সামলাতে আজান সুরের নির্বিকল্প স্বরে বিমুগ্ধ ত্রেত্রিশকোটি ধরণীবক্ষে আলোর তরঙ্গে বিস্ফার। দিকচক্রবালে ধ্বনিত কণ্ঠে নিজেকে সুদর্শনচক্রের মতো আততায়ী বলে মনে হয়…
শাল্মলি বৃক্ষের নিগূঢ়তম প্রদেশে অপার বাৎসল্য ছায়া ঘেরা আজন্ম লালিত শৈশবের দ্বারপ্রান্ত থেকে শুরু হওয়া যজ্ঞের আহুতি, বিচিত্র বাউণ্ডুলেপনা সব একসঙ্গে মিলে মিশে মেঘ-মলিনতা মুছতে উদ্যত! কণ্ঠে লেগে থাকা সুধারস চাটতে চাটতে ক্রমশ নগ্নতা পেয়ে বসে; শৈশব বড়ো হলে নগ্নতা ছোটো হতে হতে বিন্দুতে মেশে। কণ্ঠ জুড়ে তুমি শিশিরের পরশ ছড়িয়ে দাও। আমরা এখনই সুঠাম অমরত্বের আকাশী বসন্তে উপবেশনের মোহ অবলীলায় ত্যাগ করেছি। ভৈরবীর মালা হাতে পুরুষবুকের ভেতর যে রুদ্রাক্ষ খোঁজা হয় সেই চিরহরিৎ বিশ্বাস রমণীনাভিতে চিরচঞ্চল তপ্ত নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুবকের আত্মোৎসর্গকে চিনে রাখে। হয়তবা যুবতীরও…

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।