• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবহ -তে প্রভাত মণ্ডল (পর্ব – ৩)

ইছামতীর সন্তান – ৩

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর কামাল, হেদো,ভুলোর বাপেরা বাহান্ন ঘর এসে সরকারি খাস জমিতে আশ্রয় গ্ৰহণ করলেও সন্তান সন্তুতি মিলে আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও সেই বাহান্ন ঘর কি তারও কম ঘরের বসতি।যারা এদেশে আসার সময় হাতে পুঁজি সম্বল করে এসেছিল কিংবা যারা টাকা পয়সা জোগাড় করতে পেরেছে যে কোনও উপায়ে,তারা প্রায় সকলেই অন‍্যত্র জমি কিনে বসত বাড়ি গড়েছে।আর যাদের আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল নয়,তারাই রয়ে গেছে এই পল্লীর অন্ধকারে,সরকারি খাস জমিতে।এখানে আগে সকলেরই পাটকাঠির ছাওয়া ঘর ছিল।পাঠকাঠি দিয়েই তার চারিপাশ ছিলঘেরা।এখন খেঁটে-খুঁটে উপার্জন করে যারা টাকা-পয়সা গোছাতে পেরেছে, তারা কেউ কেউ টিনের ছাউনি দিয়ে নিয়েছে।না হলে এখনো অনেকেই সেই পাটকাঠির ছাউনি আর বেড়ার ঘরে থাকে।
নিজস্ব জমি জায়গা বলতে এদের কিছুই নেই,দিন আনা দিন খাওয়া।বাড়ির নারী পুরুষেরা উভয়ে মিলে ঘোষ,কাপালিদের জমিতে দুবেলা শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে।মেয়েরা কেউ কেউ পরের বাড়িতে গৃহস্থালীর কাজ করে।আবার নৃপেন,সুনীল,ভগলা,গোলোক এরা যায় শহরে কাজ করতে।যখন যে কাজ হয়,সেই কাজই করে এরা।পুজোর সিজেনে প‍্যান্ডেলের কাজ,অন‍্য সময়ে পাকাবাড়ি নির্মাণের কাজ করে।কেউ কেউ মাছ বিক্রিও করে।শহরে যাতায়াত করে,কাজ করে বলে ওরা একটু নিজেদের অন‍্যরকম উঁচুমানের ভাবে।গ্ৰামে কাজ করা নারী-পুরুষদেরকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করে,হেঁয় করে,কথায় কথায় উপহাস করে।গোলোক বলে ——
আমাগে একটা সম্মান আলাদা।শহরের বাবুগো সাতে যোগাযোগ।তোগে মত গ‍্যারামে পইর‍্যা থ‍্যাকি না,হঅঅঅ,বুজচিস?আর আমাগো মালিক যা খাবার দ‍্যায়,আমরা যা সব খায়, তুরা এই জনমে চোহে দেহিস নাই,তা খাইবি কি?
কামালের আত্মসম্মানে লাগে বড়ই,মেজাজ বিগড়ে যায় তার—-
হঅঅঅঅ,তোগে মালিক শহরে থাহে,আর আমাগো বাবু এমি পাশ করা।শুনচিস কহনো এমি কারে কয়?কলকেতা থেইক‍্যা পইড়‍্যা আইচে।আমারে কইচে ছলডারে পড়াইতে ভালো কইর‍্যা।আমার ছলডা বড়ো হোক,তহন দেহায় দিমু তোগে কি খাওয়া জোটে আর আমরা কি খায়।
গোলোকের বউ হুহু করে ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে বলে —-
হ , হ , দেহা যাবেনে।ঝত বড় মুক লয় তত বড় কতা?থাহিস মাটে ঘাটে আবার এত বুক ফুলায় গা দুলায় কতা কইস,লজ্জা করে না?
কামালের বউও ছুটে আসে,স্বামীর অপমান তার সহ‍্য হয় না।লোকে তাকে দু-দশ কথা শোনাক,সে নির্দিধায় সবটা মেনে নিতে পারে কিন্তু পতি অপমান সে কোনোভাবেই সহ‍্য করে না।হাতের আঙুল নাড়িয়ে সে বলে—-
বিটাগো মদ‍্যি কতা হইতেচে তুই মাজে কতা কওনের ক‍্যাডা?হঅঅঅ,আর ভাতার গুলানও বলিহারি,ছ‍্যারে দি রাকচে বউগুলানরে।
আকাশে মেঘ জমেছে অনেক ক্ষণ।সেদিকে কারো বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই ঝগড়ার চোটে।ঝমঝম করে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়।যে যার ঘরে চলে যায়।চৈত্রের দাবদাহ শূন্য করে প্রতিটি বৃষ্টি ফোঁটা যেন অমৃত সমান।ঝোড়ো হাওয়া বইতে থাকে।বিদ‍্যুতের ঝলক সমস্ত আকাশটার সাথে সখ‍্যতা গড়ে তোলে।কিন্তু এই অমৃত সমান বৃষ্টিই যেন এই বাহান্নটি পরিবারের বুকে ভীতির সঞ্চার করে,আর ঝোড়ো হাওয়া বইলে তো কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট।ভারী বৃষ্টি হলেই পাটকাঠির চাল ভেদ করে বৃষ্টি দেবতা যেন নির্লজ্জভাবে ঘরে প্রবেশ করতে একটুও দ্বিধা বোধ করে না।ঘরের সামান‍্য বিছানা, দু-একটি আসবাবপত্র সমস্তই ভিজিয়ে দেয় মনের আত্মপ্রসন্নতায়।
ঝোড়ো হাওয়া বইলে রামের মাথায় চিন্তা বেশি।রাম,যাকে এলাকায় সবাই মাস্টার বলে চেনে।এই বাহান্ন পরিবারের মধ‍্যে তার পেটেই বিদ‍্যা-বুদ্ধির যথেষ্ট পরিচয় মেলে।আর বিনিময় প্রথার আগে সে বাংলাদেশে থাকার সময় পড়াশুনা করেছে।হারমোনিয়াম বাজাতে পারে,লোকগান গায়।ধীর, স্থির,সৎ,বিবেকবান, ন‍্যায়বাদী শান্তশিষ্ট একজন মানুষ।বয়স বাহান্ন থেকে পঞ্চান্ন এর মধ‍্যে।একমাত্র সন্তানের পিতা।তবে অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তার স্বভাবসিদ্ধ।এলাকায় ছোটোখাটো সমস‍্যা হলে বিচারের ভার তার কাঁধেই পরে।
সামনেই চৈত্র সংক্রান্তি, গাজনের পরব।শত দারিদ্র্য আর কষ্টের মাঝেও ওরা বছরের এই সময়টাতে হৈচৈ করে,আনন্দ করে।তাদের জীবনে উৎসব বলতে চড়ক,কুমীর পুজো আর কালীপুজো।দূর্গাপুজো তাদের জীবনে আনন্দের উৎস বটে কিন্তু এই সময়টাতে যে যার কাজে ব‍্যস্ত থাকে দুটো উপার্জনের আশায়।অনেকে শহরে যায় প‍্যান্ডেলের কাজে,ইয়ং ছেলে ছোকরার দল যায় লাইট-মাইকের কাজে,আর বাকিরা গ্ৰামের ছোটোখাটো পুজোতে মিষ্টির দোকান,ফুচকার,এগরোলের,পাঁপড়ের দোকান,আবার ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘুগনী আর বেলুনের দোকান দেয়।বাজির দোকান নিয়েও বসে কেউ কেউ।সারা বছরে এই সময়টার জন‍্য অপেক্ষা থাকে ছেলে বুড়ো সকলের।যা কিছু রোজগার হয়,তা দিয়ে আর রাস্তায় চাঁদা তুলে নিজেরা করে কালীপুজো।নিজেরাই বাঁশ বাঁধে,প‍্যান্ডেলের কাপড় লাগায়,মেয়েরা পুজোর আগের দিন গোবর ছরা দিয়ে আলপনা আঁকে।আলপনা শুধু মণ্ডপে নয়,এই সময়টাতে আর কুমীর পুজোর সময়,অনেকে যাকে বাস্তু পুজো বলেও জানে সেই সময়ে প্রতিটি বাড়ির ছোট্ট উঠোন আলপনায় রেঙে ওঠে।আলপনায় তাদের হাত আছে।এরা পূর্ব পুরুষ পরম্পরা এভাবেই আলপনাতে সিদ্ধহস্ত।অনেক বড় বড় চিত্রশিল্পীও হার মানতে বাধ‍্য হবে এদের আলপনা আঁকার দক্ষতার কাছে।বড়ো করে বিপুল আয়োজনে তাদের পুজো না হলেও আনন্দ থাকে অনেক।
চরের মাঠের প্রাচীন একমাত্র বট গাছের নীচেই শ্মশান ছিলো আগে।গাঁ’এর সাধারণ মানুষজন এখানেই শবদেহ দাহ করত।শুধুমাত্র অবস্থা সম্পন্ন ঘোষ-কাপালিরা নবদ্বীপ শ্মশান কিংবা গঙ্গার কোনো ঘাটে মরদেহ দাহন করবার জন‍্য নিয়ে যেত।গঙ্গার জল শরীরে পেলে,গঙ্গার বুকে অস্থি বিসর্জিত হলে তবেই নাকি পুণ্য লাভ হবে,এমনটাই মানুষের বিশ্বাস।এ বিশ্বাস তো গোটা হিন্দু সমাজের।তবে অভাব আর দারিদ্র্যতা সমস্ত ধর্ম বিশ্বাসকে,প্রাচীন রীতিনীতিকে যেন বুড়ো আঙুল দেখায়।বটগাছটার পাশেই হাত কুড়ি দূরে ইছামতীর ঘাট।এ ঘাট থুমার ঘাট নামেই পরিচিত।এখন আর সেভাবে শবদেহ দাহ না করলেও মাঝে মাঝে দরিদ্র পরিবার গুলো এখানেই শবদেহ দাহ করে‌।
এই থুমার ঘাট,প্রাচীন বটবৃক্ষ, শ্মশান – এসব সম্পর্কে বহু গল্প শোনা যায় বয়স্কদের মুখে।হালদারদের বৃদ্ধ ও প্রাচীন মানুষ, যে একশো বছরেরও বেশি বেঁচে থাকার পর গত পাঁচ বছর আগে মারা গেল,সেই নন্দ হালদার বলতো —-
আমরা যকন জুয়ান ছিলাম, সেই সুমায় সব মাচ ধরতি যাতাম।খ‍্যাবলা জাল,সিটকি এসব নিয়ে।একদিন বলে রেকেচি সবাইকে ভোর চাট্টে নাগাদ বেরোবো।পেঁচো আমার বাড়ি এসে ডাকলি পরে আমাদের একসাতে বেরোনোর কতা।একনকার দেনের মত তকন তো অত ঘড়ি টরি সে সুমায় ছেলো না।পূর্ণিমা আসতে চলেচে তাই চাঁদের আলো অতটা ফুটফুটে না হলিও বেশ ভালোই দেকা যায়।মুক দূরির থেকে দ‍্যাকা যায় না ভালো!তা শরীল দেকলি বুজা যায় কিডা।আগের দিনির কতামত পেঁঁচো এসে আমার ডাকতি লাগল।উটে একবার ভাবলাম এত তারাতারি রাত পুয়ে গেল!তা অতশত না ভেবে হাঁড়ি,জাল আর সিটকি নে বেড়িয় পড়লাম।দুজন মিলে যাচ্চি।এ কতা সে কতা — আমি নানা কতা বলচি,ও মোটে উত্তুর টুত্তুর কিচ্চু দেয় না।আমি যে কতায় বলি ও খালি হ‍্যাঁ হুঁ করে কাটায়।হাঁটতি হাঁটতি থুমার ঘাটের ওই সুজা এট্টু আগে হেবলো মণ্ডল এর চরের কাচে গে আমরা জলে নামলাম।মাতায় লুঙ্গি খান বেঁদে নিচি ভালো করে।ওর মদ‍্যি দিশলাই আর বিড়ির প‍্যাকেটটা রেকে দিয়ে খ‍্যাবলা জালখানা গাঙ কাদায় রেকে সিটকি নিলাম।তাও পেঁচোর মুকে কতা নেই।ভাবলাম বউএর সাতে হয়তো রাগ-ঝাল করি এইচে তাই এমন করচে।সে সুমায় চিংড়ি আর গোচি মাচ খুব ভালো উটচিলো।অন্দকার রাতি কারো মুক সেভাবে দেকা যাচ্চিলো না।কোমোর জলে নেমে দু টান দে সিটকি ওপরে তুলতিই চিংড়ি,গোচি,পাকাল মাচ বেশ উটেচে।মাচ রাকা হাঁড়িকান টেনে সিকটি থেকে মাচ হাঁড়িতি তুলতি যাবো,ওমনি দেকি টপাটপ টপাটপ মাচ গালে পুরচে।বুজতি অসুবিদে হল না,এ অপদেপতা,আমাদের পেঁচো না।শরীল কাঁটা দে ওটচে,গলা শুকিয় গেচে তাও বুকি সাহস রেকে চুপচাপ কিচু না বলে মাতার লুঙ্গি খুলে বিড়ির প‍্যাকেটের তে বিড়ি বের করে দিশলাই দিয়ে ধরিয় নিলাম বিড়িখান।সেই যে ঘুরলাম,পেচন পানে একবারও আর তাকায়নি।সুজা বাড়ি।গিন্নিরে ডাক দিয়ে তুলে এটটু আগুন করতি বললাম।হাত পা ধুয়ে আগুনে হাত পা সব ছেকে নিলাম।গিন্নির বুজতি বাকি নেই যে কিচু এট্টা হয়েচে।শুয়ে পড়লাম।ভোরে এসে পেঁচো ডাকলি উটে পড়লাম।গিন্নিরে বললাম লম্পখান ধরাতি।লম্প ধরালি তার পরে উটে পেঁচো আর বউয়ের সাতে সব বললাম।পাঁচদিন ধরে জ্বর ছিলো।
সারারাত টুপটাপ করে বৃষ্টি।পরদিন সকালে মাস্টারের বাড়িতে এসে হাজির কামালের স্ত্রী।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।