রম্য রচনা-তে সুনৃতা মাইতি

“ইলিশ কিংবা  চিংড়ি !”

শুনলুম পুজোর আগ দিয়ে নাকি ইলিশে  ছেয়ে যাবে বাজার ! তা ভালো! তবে শুধু ইলিশ কেন বাঙালির মৎস্য প্রীতি নিয়ে কথা বলাই বাহুল্য। আদি বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে হালফিলের ব্লগ সবেতেই মৎস্য বিলাসের ছড়া-ছড়ি।  সেই কবে কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখে গিয়েছিলেন….
“ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি
সকল,
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল ।”
তবে মৎস্য প্রিয় বাঙালির মধ্যে ইলিশ আর চিংড়ি বিভাজন যে কবে থেকে শুরু হয়েছিল  তার  হিসেব মেলা দুষ্কর।  ঘটি- বাঙাল এবং তার হাত ধরে আগত মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল এর দ্বৈরথে যথাক্রমে  চিংড়ি  ও ইলিশ এর নাম কিভাবে জড়িয়ে গেল সেটাও ভারী রহস্যময় ! তবে কি ঘটিমানুষ ইলিশ মাছ খাননা ? কিংবা বাঙালবাবু চিংড়ি মাছ দেখলেই নাক শিঁটকোন? সে গুড়ে বালি! পেট পুরে সব খাওয়া বাঙালির আনন্দঘন ঢেঁকুরের শব্দের ঘটিত্ব কিংবা বাঙালত্ব  নির্ধারণ করা অসম্ভব। তবে বাঙালির “ইলিশ নাকি চিংড়ি” বিবাদ নিয়ে শত শত কথার চাষ হয়ে গেছে। সেগুলোকেই ঝেড়েঝুড়ে এই প্রসঙ্গের অবতারণা ।
ইলিশ মাছ।জলের উজ্জ্বল  শস্য । যার রূপের ছটায় মুগ্ধ হয়ে বাঙালি কবির কলমে একদা ইলিশ প্রশস্তির বান ডেকেছিল। তার বহু আগে স্বয়ং দেবভাষার কবি লিখে গেছেন
“ইল্লিশো মধুরো স্নিগ্ধ রেচনা বহ্নিবর্ধন”
শুধু  তাই নয়।একই অঙ্গে তার কত নাম। পাল্লা, উল্লাম,ইলিহি, হিলসা, পালা, সাবালো,তেনুয়ালোসা…। ২৫টি ভাষায় ‍১১০টি নাম।
তবে বাঙালির কাছে ইলিশের মহিমা অন্য ।  আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে আকাশ থেকে দু-তিন ফোঁটা পড়তে না পড়তেই কশ্চিৎ  “ইলিশ” বিরহগুরূনা স্বাধীকার প্রমত্তঃ বাঙালির হা-হুতাশ শুরু হয়ে যায়।ইলিশ কি যেমন তেমন কথা! একটি মাছকে নিয়ে গোটা একখানা গ্রন্থ! হ্যাঁ, সেটাও সম্ভব হয়েছে এই মায়াবিনী ইলিশের কুহক স্বাদের দাক্ষিণ্যে । সৌজন্যে ইলিশপুরান।
ইলিশ প্রজাতি যেন বাঙালির ইতিহাস বইয়ের চিরপরিচিত ফা হিয়েন কিংবা হিউ এন সাং এর স্বগোত্রীয়। নোনা জলের মাছ অথচ প্রজনন করতে আসে হাজার মাইল উজিয়ে মিষ্টি জলের জলাশয়ে । ছানাপোনা বড় করে গুষ্টিসহ ঝাঁক বেঁধে প্রত্যাবর্তনের সময় জালে আটকে পড়া । তারপর বাঙালির সরষে তেলে আত্মাহুতি। আর নারী ইলিশ! সে ছন্নছাড়া সহজিয়া সুন্দরী বাঙালির প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। সে এমন রূপসী ললনা যে গর্ভবতী হলে তার কদর যায় আরো বেড়ে ।
বাঙালির ইলিশ  দুপ্রকার। গঙ্গার ইলিশ আর পদ্মার ইলিশ । কারণ মোটের ওপর ইলিশ গঙ্গা ,পদ্মা আর মেঘনা হয়েই বঙ্গভূমে প্রবেশ করে। তারও আবার বঙ্গীয় পাদটিকা আছে মশাই! আহা! গঙ্গার ইলিশের সুগন্ধ! পদ্মার ইলিশের স্নেহ মায়া ! এছাড়াও স্হানভেদে ইলিশ মহিমা ভিন্ন বইকি!  আছে কোলাঘাটের ইলিশ, ফারাক্কার  ইলিশ, তমলুকের ইলিশ, দামোদরের ইলিশ । একদা ছিল বাগবাজারের মায়ের পায়ে জবা  হয়ে ফুটে ওঠা ইলিশ। তার স্বাদই ছিল আলাদা। তেমনি “জয় শ্রীরাম” সুলভ  হলেও শ্রীরামপুরের ইলিশ গেল দুর্লভ হয়ে।

তবে এটা অনস্বীকার্য যে বাঙালির হেঁশেল শিল্প ইলিশকে নব নব রূপে মহীয়ান করেছে । সরষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশের ঝাল- ঝোল ,কচুপাতার ইলিশ ইলিশ পোলাও…তালিকা অতি দীর্ঘ ।সব রমণীয় কিছুতেই যেমন অল্প বেদনা থাকে তেমনই আছে ইলিশের কাঁটা। তবে আশার কথা যে পাঁচতারা হোটেলের শেফের কৌশল নাকি তাকে কণ্টকমুক্ত করতে পেরেছে। আম আদমির ঘরে সে কৌশল কবে পৌঁছবে সুপর্ণা !

আর চিংড়ি ! সে তো বিশ্বজনীন । সারা বছরের শিল্পী । তার আবার একই নামে বহুবিধ রূপ। সায়েবি কেতার প্রণ ,শ্রিম্প কিংবা লবস্টার তো আছেই, তার সাথে খোদ এই   বাংলাতেই আছে প্রায় ৫৬ রকমের চিংড়ি প্রজাতি। কুচো , বাগদা , মেতি , চাপড়া , কত রকম যে তার প্রকারভেদ!  আমাদের পাড়ার নির্ভেজাল বাঙাল পানুকাকু ছোটকে  বলতেন “ছুট” আর পোকাকে বলতেন “পুকা”। মোহনবাগান আর ঈষ্টবেঙ্গলের ম্যাচ চলাকালীন অবধারিতভাবে চিংড়ির কথা উঠলেই তিনি ত্রিকালদর্শী মত বিধান দিতেন,

“হেডা কি মাছ নাকি! জলের    পুকা ।”

তা হবে। সাধে কি আর সংস্কৃতে চিংড়িকে বলে জলবৃশ্চিক! দেবভাষায় চিংড়িকে  চিঙ্গট বা মহাশুল্কও বলা হয়ে থাকে। তবে জলের পোকা হোক বা অন্যকিছু; গ্ল্যামারে সে সেরা। আর ওই “ইয়ে” অ্যাপিলও তার বেশ জোরদার। তবে বাঙালির পাতে তার পদচারণা খুব একটা  আধুনিক কিন্তু নয়।মনসামঙ্গল কাব্যে কবি লিখেছেন…
“ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জুড়ায়ে সুতা;
তৈলে পাক করি রান্ধে চিংড়ির মাথা।”
হালফিলের কেতের কুলিনারী শিল্পের বাপ ঠাকুদ্দা নয় কিনা বলুন? পুরো আগুন রেসিপি! তবে স্বীকার করতেই হবে যে উদাসিনী ইলিশের মত নাকউঁচু ভাবখানি মোটেই নেই  চিংড়িবালার। সর্বঘটের কাঁঠালীকলার মত সে সর্বত্রই  নিশ্চিন্তে সেঁধিয়ে যায়। তারপর  নিজের ষোলকলা মাখিয়ে সে পদটিকে করে তোলে মহার্ঘ্য। ছ্যাঁচড়া বল কিংবা লাউ; সবাই চিংড়ি পরশের মেকওভারে স্বাদোত্তমা হয়ে ওঠে। এহেন মিশুকে, গ্ল্যামারাস  আধুনিকার  ছলাকলার সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠা কি সহজ ! পোস্ত, নারকেল,সর্ষে র সাথে তার নিবিড় সখ্যতা তো আছেই, মেয়োনিজ,  হোয়াইট স্যস,বেসিল, অলিভ অয়েল, গোলমরিচ কিংবা বালসেমিক   ভিনিগারের সাথেও ইয়ারী কম নেই। ডাবচিংড়ি , এঁচোড় , মালাইকারি  থেকে শুরু করে প্রণ লাসানিয়া কিংবা ক্রুস্তিনী ; মেনুদের ক্যাটওয়াকে সর্বদাই তার শো স্টপার উপস্থিতি। চিংড়ির একটাই বেদনা।  বরিশালের পান্তিদিদা চিংড়ি ধুতে ধুতে প্রায়ই আক্ষেপ করতেন..

“ইচা, ইচা,ইচা, ধুইতে গেলে মিছা ,কাটতে গেলে নাই..”

বাজার থেকে যত বেশিই আনা যাক না কেন ;চিংড়ি কোটাধোয়ার পর হয়ে যায় স্বল্প। তবে আশার কথা যতটুকই হোক না কেন তার স্বাদগন্ধের কমতি নেই। তাই,
“খাইতে গেলে আবার পাই”।
ইলিশ বা চিংড়ির দ্বৈরথে কে শ্রেষ্ঠ সেটা নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মুশকিল। সহজ সুন্দরী ইলিশ? নাকি গ্ল্যামারাস চিংড়ি? কে জানে? তবে বেঁচে থাক বাবা কাঁকড়া বৃত্তি বাঙালির এইসব ঝগড়া-বিবাদ । সেটাই তো বাঙালির শেষ পারানির কড়ি বাপু। কাজেই ,বাঙালি জাতটা থাকবে অথবা নেই হয়ে যাবে; সেটা প্রশ্ন নয় । প্রশ্ন হল যুক্তি- তক্কো আর গাল-গল্পে কতটা মুখ নাড়ানো গেল ।

তথ্যসূত্র ….

-রূপায়ন ভট্টাচার্য্যর ব্লগ
-রজতেন্দ্রনাথ   মুখোপাধ্যায়ের লেখা
-রূপক চক্রবর্তীর ব্লগ
-ইন্টারনেট
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।